বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা প্রত্যাশিত by ড. আনু মাহ্মুদ

সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল প্রথম ভারত-বাংলাদেশ হাইকমিশনারস সম্মেলন। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে ভারতে। এ বৈঠকটি একাধিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সম্মেলনে বাংলাদেশ ও ভারতের হাইকমিশনারদের নিয়ে যে ‘অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন’ গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে এ সমিতির কার্যকারিতা আরও বাড়বে বৈকি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নে এবং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই আমরা। এর ফলে জিটুজির (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) বাইরে পিটুপি (পিপলস টু পিপলস) সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। এর প্রভাব নিশ্চয়ই পড়বে দুই
দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে। বৈঠকে উভয় দেশের মৈত্রী শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি অমীমাংসিত নানা বিষয়ের নিষ্পত্তি এবং দ্বিপক্ষীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। একে সচেতন নাগরিকরা শুভ লক্ষণ হিসেবেই দেখতে
চাইবেন এবং এ উদ্যোগের সাফল্য কামনা করবেন। তবে শুধু করণীয় নির্ধারণ নয়, কর্মসূচি কীভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, সে বিষয়েও অভিজ্ঞ এ কূটনীতিকদের পরামর্শ
প্রত্যাশা করেন সবাই।
আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রাক-টু ডিপ্লোম্যাসি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ঢাকায় দুই দেশের সাবেক হাইকমিশনারদের এ বৈঠককে আমরা বলতে পারি এ ধারায় অভিনব সংযোজন। নিজ নিজ দায়িত্ব পালনকালে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি বর্তমানের করণীয় বিষয়াদিও উঠে এসেছে আলোচনায়। আমরা আশা করব, এ ধারাবাহিকতায় উভয় দেশের সরকার, বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগে সরকার ঢুকে পড়লে সবসময় কাক্সিক্ষত ফল মেলে না; কিন্তু সরকার নিশ্চিতভাবেই এর পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা দিতে পারে। ঢাকা ঘোষণায় দু’দেশের সরকারকে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যু ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। সম্পর্ক জোরদারে এর বিকল্প নেই। দুটি দেশই ‘সার্ক’ ও ‘বিমসটেক’ জোটের সদস্য। উপআঞ্চলিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ের বিভিন্ন ফোরামেও ঢাকা ও দিল্লিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়। ঢাকা ঘোষণায় দু’দেশকে পারস্পরিক স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ ও ব্যবহার এবং নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির আহ্বান জানানো হয়েছে।
এক দেশের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে অন্য দেশের পররাষ্ট্রনীতির পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতেও রয়েছে অনেক ভিন্নতা। তবে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের স্বার্থে একে অন্যের প্রতি আস্থার প্রতিফলন ঘটাতে সমস্যা নেই। সেক্ষেত্রে দু’দেশেরই উচিত পারস্পরিক স্বাথের্র বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া। কিন্তু বাস্তবে লক্ষ করা যায়, বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভারত বরাবরই উন্নাসিক। তবে হাইকমিশনার সম্মেলনে ‘উন্নয়নের জন্য একে অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে, কেউ কাউকে বাদ দিয়ে নিজেদের উন্নয়ন করতে পারবে না’- নীতিনির্ধারকদের এ উপলব্ধি আমাদের আশান্বিত করে। এ ইতিবাচক উপলব্ধির বাস্তবায়নই প্রত্যাশিত।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাধীনতার পর এ দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কখনও উষ্ণ হয়েছে, আবার কখনওবা এর ওপর জমেছে তিক্ততার বরফ। সেই বরফ গলতে সময়ও লেগেছে। তবে ভারতের বিগত কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষ করা গেছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় কখনও কখনও সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলোর নিষ্পত্তির ব্যাপারে ভারত সরকার কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এমনকি প্রতিশ্র“তি দিয়েও ভারত তা রক্ষা করেনি। এক্ষেত্রে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়ার বিষয়টি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে লক্ষ করেছি, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার মুখে তা নস্যাৎ হয়ে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মতবিরোধের বিষয়টিই তখন উচ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এককভাবে শক্তিশালী হওয়ায় অতীতের সমস্যা আর নেই, ফলে বাংলাদেশের জনগণ এখন দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর নিষ্পত্তির আশা করতেই পারে। বিষয়টি ভারত সরকারকে গভীরভাবে বিচেনায় নিতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ, ছিটমহল সমস্যা এবং সন্ত্রাস দমনের প্রশ্নে নানা মতভিন্নতা রয়েছে। অন্যদিকে তিস্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির বিষয়েও রয়েছে মতানৈক্য, যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এ বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছেন। দেশ দুটির দ্বিপক্ষীয় অমীমাংসিত বিষয়গুলো দ্রুত সমাধানের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। ভারতের বর্তমান সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। এখন একে কার্যকর করতে কূটনীতিকদের যথাযথ ভূমিকা রাখা দরকার।
একটি বিষয় স্পষ্ট, বাংলাদেশ ও ভারতের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হলে এর দ্বারা উভয় দেশের মানুষই উপকৃত হবে, বিশেষ করে তা সীমান্তবর্তী ও ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষের দারিদ্র্য নিরসনে সহায়ক হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে কাজ করছে, তা ভবিষ্যতে আরও গতিশীল হবে। এসব সমস্যার নিরসন তাই জরুরি হয়ে উঠেছে। আমরা মনে করি, সম্পর্কোন্নয়নের জন্য উভয় দেশকেই সদিচ্ছার পরিচয় দিতে হবে। পারস্পরিক বিশ্বাস ও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নিতে হবে উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। বাংলাদেশের জনগণ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা প্রত্যাশা করে, যেখানে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কেরই প্রতিফলন ঘটবে।
ড. আনু মাহ্মুদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.