আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হঠাৎ ফেরায় নানা প্রশ্ন- গ্রেপ্তার নিয়ে স্পিকার ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ভিন্ন মত by সাজেদুল হক

কেন হঠাৎ দেশে ফিরলেন ‘সাম্রাজ্য হারানো’ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী? বিলিয়ন ডলারের এ প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে সর্বত্র। যদিও এক পর্যবেক্ষক আগেই নিশ্চিত করেছিলেন, লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে ঘটনাপ্রবাহ সহজে শেষ হবে না। প্রায় দুই মাসের নাটকীয়তার পর রোববার রাতে সাবেক এই মন্ত্রী যখন দেশে ফিরলেন তখন ওই পর্যবেক্ষকের কথাই যেন সত্য প্রমাণ হলো। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে এক আলোচনা সভায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), হজ এবং তাবলীগ জামায়াত নিয়ে কটূক্তি করেন লতিফ সিদ্দিকী। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়েও বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেন। লতিফ সিদ্দিকীর এ মন্তব্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি ওঠে সব মহল থেকে। প্রধানমন্ত্রী তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার করেন। পরে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম এবং সাধারণ সদস্য পদ থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও সংসদ সদস্য হিসেবে এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন তিনি। কলকাতায় অবস্থানরত লতিফ সিদ্দিকী এক পর্যায়ে দেশে ফিরতে চাইলেও তাকে দেশে এলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বলে একাধিক সরকারি নীতিনির্ধারক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তাকে দেশে না ফিরতেও পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী ইস্যু যখন মিইয়ে যাওয়ার পথে তখন হঠাৎ করেই ফিরে এলেন তিনি। লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুও ফিরে এলো। তিনি গ্রেপ্তার হন আর না হন এ ইস্যু এখন দীর্ঘদিন জীবিত থাকবে। একটি সূত্র জানাচ্ছে, লতিফ সিদ্দিকী কেন দেশে ফিরলেন তা সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে নিশ্চিতভাবেই সরকারের কোন না কোন অংশের গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই তিনি দেশে ফিরেছেন। ওই অংশটি তিনি যেন বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার না হন তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। গতকাল দিনভর তার উচ্চ আদালতে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তার সত্যতা মেলেনি। লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে দেশে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। এমন এক সময়ে এ পরিস্থিতি তৈরি হলো যখন বিএনপি নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে, জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ-ের রায়ও কার্যকরের অপেক্ষায় রয়েছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুতে সরকারের লাভ ও ক্ষতি দুই ধরনের সম্ভাবনাই রয়েছে। সরকার তাকে দল ও মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার করলেও তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে কোন মামলাও  করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তি বাদী হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী জানিয়েছেন, এসব মামলা ত্রুটিযুক্ত। প্রথমত, একই অপরাধে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মামলায় সরকারের অনুমোদনের প্রশ্ন রয়েছে। লতিফ সিদ্দিকীর ফেরার কারণে বেশ কিছু ইস্যু এখন ধামাচাপা পড়ে যাবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও ছাত্রলীগকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল তা এখন অনেকটাই তলিয়ে যাবে। লতিফ সিদ্দিকীকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের কোন আন্দোলন গড়ে উঠলে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ‘মৌলবাদী ব্যান্ডিং’ হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। হঠাৎ করে বাংলাদেশ ও ভারতে বাংলাদেশকেন্দ্রিক জঙ্গিদের তৎপরতার অতিরঞ্জন  সেই প্রকল্পের অংশ বলেও কোন কোন পর্যবেক্ষক মনে করেন। লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুর স্পর্শকাতরতার কারণেই বিএনপি এ নিয়ে খুব বেশি সরব নয়। তবে কেউ কেউ মনে করেন, সরকারের ভেতরেরই কোন অংশ দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চান। যে কারণে লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুটি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে এক সময় হজ  পালনকারী লতিফ সিদ্দিকী কেনই বা হজের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন তা-ও এখন পর্যন্ত পরিষ্কার হয়নি। ইতিহাসে তার নাম বহিষ্কৃত না স্বপক্ষত্যাগী হিসেবে লেখা থাকবে তা-ও নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও আসেনি। তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, শিগগিরই এ আখ্যানের শেষ হচ্ছে না।
অজ্ঞাতবাসে লতিফ: দেশে ফেরার পর অজ্ঞাতবাসে লতিফ সিদ্দিকী। কেউ জানে না তিনি কোথায় অবস্থান করছেন। দেশজুড়ে তাকে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা, গুঞ্জন। বলা হচ্ছে, তিনি উচ্চ আদালতে জামিনের জন্য গেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আদালতপাড়ায় দেখা যায়নি। রোববার রাতে দেশে ফিরেছেন তিনি। এরপর বিমানবন্দর থেকে নির্বিঘ্নে বের হয়ে গেছেন অজ্ঞাতবাসে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের নির্দেশনা নেই। তাই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেনি। তবে তিনি গোয়েন্দাদের নজরদারিতে রয়েছেন। সরকারের গ্রিন সিগন্যাল পেলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যাবে যে থানা এলাকায় তার বাসা সেই থানায়। থানা পুলিশ যদি তাকে গ্রেপ্তারে গোয়েন্দাদের সহযোগিতা চায় তবেই সহযোগিতা করা হবে। এছাড়া, লতিফ সিদ্দিকী এখনও এমপি। সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তারে স্পিকারের অনুমতি প্রয়োজন হয় বলে কারও কারও মত রয়েছে। সর্বোপরি সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারে কোন ধরনের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ আসেনি। তাই তাকে গ্রেপ্তারে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, সিগন্যাল পেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।
স্পিকার ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দুই মত: আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারের আইনি দিক নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, লতিফ সিদ্দিকী এখনও সংসদ সদস্য পদে বহাল রয়েছেন। এ কারণে তাকে গ্রেপ্তার  করতে হলে স্পিকারের অনুমতি লাগবে। অন্যদিকে স্পিকার বলেছেন, লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারে তার অনুমতির দরকার নেই। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আইনি জটিলতার কারণে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্পিকারের অনুমতি ছাড়া একজন সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা যায় না। তবে পরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য নাকচ করে দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে তার কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী শুধুমাত্র সংসদ লবি, গ্যালারি ও চেম্বার  থেকে কোন সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে স্পিকারের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এছাড়া, কোন অনুমতি লাগে না। তবে কোন সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হলে স্পিকারকে অবহিত করার বিধান রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.