কি অপরাধ দিনমজুর মইদুরের?

দিনমজুর মইদুর আলী (৫৫)। পেটের দায়ে কাজের নেশায় এলাকার অন্যদের সঙ্গে এসেছিলেন নরসিংদী জেলার বেলাবো থানার বাড়ৈচা এলাকায়। গত ৬ বছর ধরেই শীত মওসুমে তিনি এ এলাকায় দিনমজুরি করতে কিশোরগঞ্জের ইটনা থেকে আসেন। এবারেও এসেছিলেন। কিন্তু পুলিশের নির্মম বর্বরতার শিকার হলেন মইদুর আলী। যে নির্মমতায় ইতিমধ্যে তার জীবন বাঁচাতে ডান পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। তবে পা কেটে ফেললেও এখনও আশঙ্কামুক্ত নন তিনি। নিরীহ পথচারী মইদুর আলীকে ডান পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেছিল পুলিশ। কাটা পা নিয়ে তিনি এখন জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল)-এর ইআর ওয়ার্ডের ১২ নম্বর বেডে কাতরাচ্ছেন। হতদরিদ্র আলীর চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে ইতিমধ্যে তার স্ত্রী জোবেদা খাতুন ছোট মেয়ে আল্পনা (৮)-কে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষায় নেমেছেন। পুলিশের বর্বরতার শিকার নিরীহ দিনমজুর মইদুর আলীর পরিবার দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি’র (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ) হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বর্বর এই ঘটনাটি ঘটেছে গত ৯ই নভেম্বর নরসিংদীর বেলাবোর বাড়ৈচা এলাকায়। ওইদিন সন্ধ্যায় তাবলীগ জামাত, এলাকাবাসী ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষের মাঝে পড়ে পাশেই বটতলার একটি দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন মইদুর আলী। সেখানে পুলিশ সদস্যরা টেনেহিঁচড়ে কিছুদূর নিয়ে ডান পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার মৃগা ইউনিয়নের কালীপুর। প্রতি বছরই শীত মওসুমে কাজের সন্ধানে তিনি নরসিংদীর বেলাবোর বাড়ৈচা আসেন। সেখানে তিনি ওঠেন স্থানীয় ইদ্রিস মাস্টারের বাড়িতে। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়েন। কোন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন বলে জানান মইদুর আলী। ঘটনার দিন ময়লা একটা পাঞ্জাবি ও টুপি পরে গিয়েছিলেন স্থানীয় জামে মসজিদে এশার নামাজ আদায় করতে। স্ত্রী জোবেদা খাতুনের ভাষায় এই পাঞ্জাবি ও টুপি পরাই কাল হলো তার। মইদুর আলী জানান, নামাজ পড়ে তিনি স্থানীয় একটি পান দোকানে বসে পান খাচ্ছিলেন। এ সময় শুনতে পান বাড়ৈচা এলাকায় গ-গোল হচ্ছে। গোলাগুলি ও সংঘর্ষ হচ্ছে। ভয়ে তিনি পান দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়েন। কিছুক্ষণ পরেই সেখানে হাজির হয় ইউনিফর্ম পরা কয়েকজন পুলিশ। তাদের একজন লুকিয়ে থাকা মইদুর আলীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে ‘ওই টুপি আর পাঞ্জাবিওয়ালারে ধর!’ এসময় মইদুর আলী পুলিশের উদ্দেশ্যে কাকুতি মিনতি করে বলতে থাকেন ‘বাবারা, আমি কামলা দেই। গরিব মানুষ। আমি কিছু জানি না। নামাজ থেকে ফিরছি। তোমরা আমার ছেলের বয়সী। আমারে ছাইড়া দেও।’ একথা বলার পরপরই ৪ থেকে ৫ জন পুলিশ তার চুলের মুঠি ধরে কিল, ঘুষি, থাপ্পড় দেয়। এরই মধ্যে একজন পুলিশ পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। মইদুর আলী বাঁচার জন্য দৌড়ে গিয়ে পাশেই একটি লেগুনার পাশে আশ্রয় নেন। তখনও ভয়ের চোটে তিনি বুঝতে পারেননি তার পায়ে গুলি করা হয়েছে। কোমরের নিচে রক্তে ভেসে গেছে। হঠাৎ নিচে তাকিয়ে দেখেন রক্তে ভেসে যাচ্ছে সব। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সেখানেও হামলে পড়ে পুলিশ। তাকে টেনে বের করে আবারও নির্যাতন শুরু করে তারা। এক পর্যায়ে নির্যাতনের মাত্রা কিছুটা কমে এলে কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাকে চ্যাংদোলা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লেগুনাতেই তুলে দেয়। পাঠিয়ে দেয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ১৬ই নভেম্বর তার ডান হাঁটুর ওপর থেকে পায়ের বেশির ভাগ অংশ কেটে ফেলে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এখন পর্যন্ত সেখানেই চিকিৎসাধীন আলী। পঙ্গু হাসপাতালের ইআর ওয়ার্ডের ১২ নম্বর বেডে স্বামীর পাশে বসে অঝর ধারায় কাঁদছিলেন জোবেদা খাতুন (৫০)। কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘বাবা আমরা গরিব মানুষ। স্বামীর টেকায় সংসার চলে। উনি যদি পা হারাইয়া ঘরে বইসা থাকে তাহলে পোলাপানরে কি খাওয়ামু। নিজেরা কি খামু?’ জোবেদা জানান, স্বামীর চিকিৎসা খরচ যোগাতে ছোট মেয়ে আল্পনা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে ইতিমধ্যে তিনি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষায় নেমেছেন। প্রতিদিন ভিক্ষা করে ২শ’/৩শ’ যা পান তাই দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা খরচ চলছে। তিনি জানান, তার পাঁচ ছেলেমেয়ে। বহু কষ্টে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে কাজল স্ত্রী নিয়ে থাকে সিলেটে। মইদুর আলী বলেন, ‘যে পুলিশগুলা আমার পায়ে গুলি করছে তাদের কাছে হাতজোড় করেছি। বলেছি, বাবারা তোমরা আমার ছেলের মতো। আমি কোন অন্যায় করি নাই। আমার কথা না শুনে পায়ে গুলি কইরা দিলো। আমি এর বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পুলিশের আইজি, এলাকার এমপি’র কাছে বিচার চাই। যদি বিচার না পাই তাইলে আল্লাহর কাছে বিচার চাইবো।’ আহতের ছেলে কাজল মিয়া বলেন, ‘আমরা নিরীহ মানুষ। তার পিতার চিকিৎসায় নরসিংদী পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে দেয়া ১০ হাজার টাকার মধ্যে মাত্র ৩ হাজার টাকা তাদেরকে দিয়ে বাকি টাকা দিতে টালবাহানা করছে পুলিশ।’ বেলাবো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বদরুল আলম এবিষয়ে বলেন, ঘটনার বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.