তাজরীন অগ্নিকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্তদের পুরো ক্ষতিপূরণ দেয়ার আহ্বান

তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের দু’বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও কারখানাটিতে সম্পৃক্ত আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো তেমন সহায়তা দিতে এগিয়ে আসেনি। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা এখনও দুর্দশায় দিনাতিপাত করছে। উপার্জন সক্ষম হয়ে উঠতে পারেন নি অনেকে। এসব ব্র্যান্ডের উচিত কারখানার শ্রমিক ও মৃতদের পরিবারবর্গকে অবিলম্বে পূর্ণ ও সুষ্ঠু ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দেয়া। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এ আহ্বান জানিয়েছে। নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক এ সংস্থার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কারখানায় সম্পৃক্ত ১৬টি প্রতিষ্ঠানের মাত্র দু’টি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠান কিছুই দেয় নি। তাদের দাবি কারখানাটিতে তাদের অবগতি বা অনুমোদন ছাড়াই পণ্য উৎপাদন বা মজুত করা হয়। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো অপ্রকাশিত অনুদানের প্রস্তাব দিয়েছে। ২০১২ সালের ২৪শে নভেম্বর রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারের তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকা-ে ১১২ জন কর্মী নিহত হন। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের বিপদসঙ্কেত ভুল বলে শ্রমিকদের কারখানা থেকে বের হতে বাধা দেয় ব্যবস্থাপকরা। এছাড়া, বহির্গামী পথগুলো পণ্যভর্তি কার্টনে আটকা ছিল। জ্বলন্ত কারখানার উপরের তলা থেকে শ্রমিকরা নিচে লাফ দিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করায় তারা বাজেভাবে আহত হয়েছেন। শ’ শ’ শ্রমিক এখনও তাদের জখম নিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। চিকিৎসা চালানোরও সামর্থ্য নেই তাদের। এই সাভারেই পাঁচ মাস পর রানা প্লাজা ভবন ধসে ১১ শতাধিক কর্মী নিহত হন। এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকারদের মতো তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ভিকটিমদেরও বড় অঙ্কের সহায়তা প্রয়োজন। অনেকে হয়তো আগুন থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন। কিন্তু তাদের জীবনে বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, এসব মানুষকে সাহায্য করার দায়িত্ব বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর আর এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। সাক্ষাৎকারে জানা গেছে, ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ও বিজিএমইএ থেকে ১ লাখ টাকা পেয়েছেন ভিকটিমরা। কিন্তু দুর্ঘটনার এক বছরের মধ্যেই চিকিৎসা ব্যয়ে শেষ হয়ে গেছে ওই অর্থ। জাতিসংঘের ব্যবসা ও মানবাধিকারবিষয়ক নীতিমালা অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকা-, পণ্য, সেবা বা তাদের ব্যবসায়িত সম্পর্কের সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রতিকূল মানবাধিকার প্রভাব প্রতিহত বা লাঘব করা ওই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। ওই প্রভাবে তারা সরাসরি অবদান না রাখলেও এটা তাদের দায়িত্ব। জাতিসংঘ নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে যে, তারা বিরূপ প্রভাব ঘটিয়েছে বা তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে তাদের উচিত বৈধ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা প্রতিকার নিশ্চিত বা সহায়তা করা। তাজরীন কারখানায় সম্পৃক্ত ৫টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে (ইউএসএ’র ডিকিস, সিয়ার্স, ডিজনি, ওয়ালমার্ট ও ফ্রান্সের টেডি) ২০১৩ সালের নভেম্বরে যোগাযোগ করে এইচআরডব্লিউ। তাদের কাছ থেকে এখনও কোন জবাব মেলেনি। তবে ডিকিস এক বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছে, তারা অনেক আগেই ওই কারখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় ইতি টেনেছিল। বাকিরা বিভিন্ন সময়ে বলেছে, তাদের অনুমোদন বা অবগতির বাইরে সেখানে তাদের পণ্য ছিল বা উৎপাদন হচ্ছিল। ব্রাড অ্যাডামস বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য তাজরীনে থাকার বিষয়টা তারা অবগত ছিল না শুধু এ কারণে ভিকটিমদের প্রতি তাদের কোন দায়িত্ব নেই- এমনটা তাদের দাবি করা উচিত নয়। জাতিসংঘ নীতিমালায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, সাপ্লাই চেইনের সর্বত্র যথাযথ দায়িত্ব পালন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত যে কাউকে প্রতিকার দেয়ার দায় সকল প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। তাজরীনে অগ্নিকা-ের পর সেখানে যাওয়া বাংলাদেশী মানবাধিকার কর্মীরা- সিঅ্যান্ডএ (বেলজিয়াম), এডিনবরা উলেন মিল (ইউকে), এল কোর্টে ইঙ্গলস (স্পেন), শন কম্বস/এনিস (ইউএস), কার্ল রিকার ও কেআইকে (জার্মানি), লি অ্যান্ড ফাং (হংকং) এবং পিয়াজা ইতালিয়ার (ইতালি) লেবেল, পোশাক বা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পেয়েছে। এইচআরডব্লিউ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাছে লিখেছে। কিন্তু এক বছর পরও কেউ কোন জবাব দেয়নি। এদের মধ্যে কার্ল রাইকার, পিয়াজা ইতালিয়া, এডিনবরা উলেন মির, কেআইকে, এল কোর্টে ইঙ্গলস এবং এনিস বলেছে তারা আমস্টারডামভিত্তিক ক্লিন ক্লোদস ক্যাম্পেইন অনুযায়ী ভিকটিমদের দাতব্য অনুদান দেবে বা দিয়েছে। তবে তারা আদৌ কোন অনুদান দিয়েছে বা কি পরিমাণ দিয়েছে সেসব বিষয় প্রকাশ করেনি। ক্লিন ক্লোদস ক্যাম্পেইনের তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র ইউরোপের সিঅ্যান্ডএ এবং হংকংয়ের লি অ্যান্ড ফাং ক্ষতিপূরণ দেয়ার লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা নিয়েছে। তাদের বিশ্বাস রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ক্ষতিপূরণের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও যেমন তহবিল গঠনের পদক্ষেপ নিয়েছে তাজরীন অগ্নিকা-ের জন্যও একই রকম পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এইচআরডব্লিউ তাজরীন অগ্নিকা- ভিকটিমদের জন্য এমন একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠনে আইএলও’র প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ব্রাড অ্যাডামস বলেন, সঠিক মানুষের কাছে সঠিক পরিমাণ সহায়তা যাচ্ছে তা নিশ্চিত করার জন্য একটি ব্যবস্থা চালু করা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, তাজরীন ফ্যাশনস আর রানা প্লাজা বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য প্রয়োজন ও প্রাপ্য।

No comments

Powered by Blogger.