রাজাকার কমান্ডার মোবারকের ফাঁসি

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। সোমবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন-বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। মোবারকের বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আনা ৫টি অভিযোগের মধ্যে দুটি (প্রথম ও তৃতীয়) প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে এক নম্বর অভিযোগটি ছিল গণহত্যার। এ অপরাধে ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আবদুল খালেক নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার তৃতীয় অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে। বাকি তিনটি (দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম) অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। প্রথম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২২ আগস্ট মোবারক হোসেনসহ অন্য রাজাকাররা আখাউড়ার টানমান্দাইল গ্রামে হাজী নূর বকশের বাড়িতে সভা ডাকেন। বেলা দুইটা-আড়াইটার দিকে ১৩০-১৩২ জন গ্রামবাসীকে ওই বাড়িতে জড়ো করা হয়। তখন মোবারক ও তার সহযোগীরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামবাসীদের আটক করে গঙ্গাসাগর দীঘির কাছে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখেন। মোবারক ও তার সহযোগীরা আটক গ্রামবাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করেন। তিনি টানমান্দাইল গ্রামের ২৬ জন ও জাঙ্গাইল গ্রামের সাতজনসহ ৩৩ জনকে বাছাই করে তেরোঝুড়ি হাজতখানায় নিয়ে যান। ২৩ আগস্ট পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ওই ৩৩ জনকে দিয়ে গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে একটি গর্ত খোঁড়ায়। পরে তাদের গুলি করে হত্যার পর ওই গর্তেই মাটিচাপা দেয়া হয়। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
তৃতীয় অভিযোগটি ছিল আবদুল খালেক হত্যার। এ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১১ নভেম্বর রাত ৮টা-৯টার দিকে মোবারক তার সশস্ত্র রাজাকার সহযোগীদের নিয়ে ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেককে অপহরণ করে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। ওই রাতেই খালেককে তিতাস নদীর পশ্চিম পাড়ে বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগটিও প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। বাকি অভিযোগগুলো প্রমাণ না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল মোবারককে খালাস দিয়েছেন।
মোবারকের বিরুদ্ধে আনা দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ও অন্য স্বাধীনতাবিরোধীরা মিলে ‘আনন্দময়ী কালীবাড়ী’ নামের একটি হিন্দু মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর ও মালামাল লুটের পর সেটি দখল করেন। পরে মন্দিরটির নাম রাখেন ‘রাজাকার মঞ্জিল’। ২৪ অক্টোবর মোবারক শিমরাইল গ্রামের আশুরঞ্জনকে অপহরণ করে আহতাবস্থায় চার দিন রাজাকার মঞ্জিলে আটকে রাখেন এবং ২৮ অক্টোবর তাকে কুড়লিয়া খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৪-২৫ নভেম্বর বেলা দুইটা-আড়াইটার দিকে মোবারকের নেতৃত্বে রাজাকারের একটি দল খরমপুর গ্রামের খাদেম হোসেন খানকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার স্টেশন রোড থেকে অপহরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে স্থাপিত সেনাক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। ৬ ডিসেম্বর অন্য কয়েকজন বন্দির সঙ্গে তাকেও কুড়লিয়া খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৮-২৯ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মোবারক খড়মপুর গ্রামের আবদুল মালেক ও আমিরপাড়া গ্রামের মো. সিরাজকে অপহরণ করেন। ৬ ডিসেম্বর সিরাজকে কুড়লিয়া খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ তিনটি অভিযোগ প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত এক ও তিন নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এক নম্বর অভিযোগে আনীত গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোবারকের সংশ্লিষ্টতা ছিল। এ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে অপহরণ, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। অপরাধের মাত্রা ও তীব্রতা বিবেচনায় এক নম্বর অভিযোগে তার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য। রায়ে বলা হয়েছে, যখন তার ‘মৃত্যুদণ্ডের আদেশ’ কার্যকর হয়ে যাবে তখন যাবজ্জীবন দণ্ডের আদেশটি ওই মৃত্যুদণ্ডের আদেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে।
ন্যায়বিচার পাননি দাবি করে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানিয়েছেন মোবারকের আইনজীবী তাজুল ইসলাম। রায় ঘোষণার পর তিনি বলেন, ‘যে তথ্য-প্রমাণ আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে, আমরা মনে করি সেটি বিশ্লেষণে ট্রাইব্যুনাল ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ করেননি। এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা হবে।’
তবে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী সাহিদুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। দুুটি অভিযোগে মোবারক দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। আমরা সন্তুষ্ট। তিনি যে রাজাকার ছিলেন- এটি আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে বোঝাতে পেরেছি।’ প্রসিকিউশনের ব্যর্থতায় তিনটি অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে সাহিদুর রহমান বলেন, ‘তিনটি অভিযোগে কেন তাকে খালাস দেয়া হল তা পূর্ণাঙ্গ রায় বিশ্লেষণ করে বোঝা যাবে।’
২০০৯ সালের ৩ মে মোবারকের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় মামলা করেন একাত্তরের শহীদ আবদুল খালেকের মেয়ে খোদেজা বেগম? মোবারক হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান? পরে স্থানীয় আদালত এ মামলা ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করেন। মোবারকের বিরুদ্ধে যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত চলছিল, তখন এ ট্রাইব্যুনাল তাকে জামিন দিয়েছিলেন। গত বছরের ২৫ ফেব্র“য়ারি রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে? একই বছরের ১২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিয়ে মোবারকের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠান?
যুদ্ধাপরাধের পাঁচ ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল মোবারকের বিচার শুরু হয়। একই বছর ২০ মে তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের মোট ১২ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। গত বছরের ২৫ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ এবং আসামিপক্ষের জেরা শেষ হয়।
এ মামলায় আসামিপক্ষে সাফাই সাক্ষী দিয়েছেন মোবারক হোসেন নিজে ও তার বড় ছেলে মোহাম্মদ আসাদ উদ্দিন। সাক্ষ্য ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনাল-১ ২ জুন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। দীর্ঘ পাঁচ মাস পর সোমবার এ মামলার রায় ঘোষণা করা হল। এটি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ১৩তম মামলার রায়। গতকাল বেলা ১১টার দিকে মোবারককে নেয়া হয় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায়। বিচারপতিরা এর কিছুক্ষণ পরেই রায় ঘোষণা করেন। ৯২ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পড়ে শোনানো হয়।
যুদ্ধের পর ভোল পাল্টান মোবারক : একাত্তরে স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার হলেও পরে তিনি ভিড়ে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগে। জানা যায়, মো. মোবারক হোসেন ওরফে মোবারক আলীর জন্ম ১৯৫০ সালের ১০ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার নয়াদিল গ্রামে। তার বাবার নাম শাহাদত আলী, মা নজিবুর নেসা। ট্রাইব্যুনালের নথিপত্র অনুযায়ী, মোবারক অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। পেশায় ব্যবসায়ী হলেও এলাকার মানুষ তাকে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর দালাল হিসেবেই চেনেন। স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বের বিশদ বর্ণনা উঠে এসেছে ট্রাইব্যুনালের রায়েও।
প্রসিকিউশনের বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোতে মোবারক জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তার নেতৃত্বেই রাজাকার বাহিনী সে সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অপহরণ, লুটপাট, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায়। স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াত আবার রাজনীতি করার সুযোগ পেলে মোবারক ইউনিয়ন জামায়াতের রুকনের দায়িত্ব পান। পরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়ান এবং একপর্যায়ে আখাউড়ার মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। তিন বছর আগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
আখাউড়ায় আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ : আখাউড়া প্রতিনিধি জানান, রায় শুনেই আনন্দে ফেটে পড়েন আখাউড়া পৌরশহরের খরমপুর সড়কে অবস্থিত উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা জনসাধারণের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেন। আখাউড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মো. আবু সাঈদ মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা শাহাদৎ হোসেন পাখি, মিজানুর রহমান, ইসমাইল হোসেন, ইদ্রিস মিয়া, আবদুল হাফিজ ভূঁইয়া, মীর মোশারফ হোসেন, আ. রাজ্জাক প্রমুখ দ্রুত রায় কার্যকরের আহ্বান জানান। সরেজমিন গতকাল দুপুরে নয়াদিল গ্রামে মোবারক হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাড়িজুড়ে স্তব্ধ পরিবেশ। বাড়ির সব দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে পরিবারের সবাই অবস্থান করছেন। সংবাদকর্মী বা এলাকাবাসী কারও সঙ্গে পরিবারের কোনো সদস্য কথা বলেননি। কেবল একটি ঘরের ভেতর থেকে একটু পর পর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, রাজাকার মোবারকের ফাঁসির রায়ের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে যুবলীগ। দুপুরে সদর উপজেলা যুবলীগের আয়োজনে শহরের লোকনাথ ট্যাংকের পাড় থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি শহর প্রদক্ষিণ শেষে স্থানীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক সমাবেশ করে।

No comments

Powered by Blogger.