সরকারের ১৭ বিভাগে ৬২০০ কোটি টাকার অনিয়ম -৫ বছরের অডিট রিপোর্ট

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ১৭টি বিভাগের অডিটে ৬২০০ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। অনিয়মের খোঁজ করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১১ আর্থিক সালে করা এসব অডিট রিপোর্টের এ অনিয়ম চিত্র উঠে এসেছে। তবে বিভিন্ন খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির এ চিত্র চূড়ান্ত রূপ নয়। এটা কেবল নমুনা মাত্র। এই ১৭টি বিভাগের মধ্যে অনিয়মের শীর্ষে অবস্থান করছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এরপরই আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়েছে ব্যাংকিং খাতে। গতকাল সোমবার রাজধানীর কাকরাইরে অডিট ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর  জেনারেল (সিএজি) মাসুদ আহম্মেদ। এই সিএজি দায়িত্ব গ্রহণের পর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অনিয়মের তথ্য প্রকাশ করার ঘটনা এটাই প্রথম। এ সময় ডেপুটি অডিটর জেনারেল শ্যামল কান্তি চৌধুরীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক অনিয়মের খবর প্রকাশিত হলেও সংস্থাটি এই মন্ত্রণালয়ে আর্থিক অডিট করেনি। সেখানে পারফরমেন্স অডিট করেছে তারা। অর্থাৎ সেখানে বিদ্যুৎ বিভাগের আর্থিক অনিয়মের অডিট না করে পারফরমেন্সড় অডিটে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা ও সিস্টেম লসের নামে অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৭টি অডিটের মাধ্যমে ৬২০০ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম খোঁজে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর  জেনারেল (সিএজি) অফিস। ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সময়ে করা এসব অডিট রিপোর্টের মধ্যে বেশি অনিয়ম ধরা পড়েছে ব্যাংকিং খাতে। এ আর্থিক অনিয়মের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ৪টি অডিটের মাধ্যমে ৩৫০০ অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।, সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ১৭টি অডিটে মোট ২৭৪টি আপত্তির বিপরীতে এ পরিমাণ আর্থিক অনিয়ম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি রয়েছে পারফরমেন্স অডিট। যেখানে আপত্তি রয়েছে ১১টি। অডিট রিপোর্ট অনুসারে, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) একটি অডিটের মাধ্যমে ২ হাজার ৬২৮ কোটি টাকার অনিয়ম উদ্ঘাটিত হয়েছে। অনিয়মের বিবরণে বলা হয়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানি ওয়ারিদ ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিকে লাইসেন্স প্রদানে অনিয়ম ও শর্ত ভঙ্গ করার পরও পারফরমেন্স ব্যাংক গ্যারান্টি বাজেয়াপ্ত করা হয়নি। কমমূল্যে শেয়ার হস্তান্তর ও স্ট্যাম্প মূল্য আদায় না হওয়া, বিভিন্ন চার্জ আদায় করা হয়নি। একই সঙ্গে কোম্পানিটি অবৈধ ভিওআইপ ব্যবসা করার সঙ্গে জরিমানা আদায় ও লাইসেন্স এর চুক্তি অনুসারে রাজস্ব প্রদান করেনি কোম্পানিটি। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ৪টি অডিটের মাধ্যমে ৩ হাজার ৫৩ কোটি ৩১ লাখ টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে। অডিট হিসেবে, এ খাতেই অনিয়মের পরিমাণটা বেশি বলা যায়। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ও রূপালী ব্যাংকে ঋণ পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফ কার্যক্রমের উপর অডিট ৮৮০ কোটি ৫৩ লাখ টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরের এ অডিটে আপত্তির সংখ্যা ছিল ২৮টি। এতে বলা হয়েছে, ব্যাংক দু’টি সঠিকভাবে গ্রাহক নির্বাচন না করে পর্যাপ্ত জামানতবিহীন ঋণ মঞ্জুর করে। এছাড়া ঋণ মওকুফ ও পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রেও অনিয়ম করেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জনতা, সোনালী, অগ্রণী, রূপালী, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, আইসিবি, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের উপর করা অডিটে ৭৯৬ কোটি ৯ লাখ টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে। এ ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে মোট অডিট আপত্তির সংখ্যা ছিল ৪৫টি। একই সঙ্গে, অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল ও  সুদ মওকুফের উপর করা আলাদা আলাদা অডিটে যথাক্রমে ৭১৩.৫২ কোটি ও ৬৬৩.১৭ কোটি টাকার অনিয়ম পওয়া গেছে। এদের বিরুদ্ধে মোট আপত্তির সংখ্যা ৪৬টি। এছাড়াও অন্যান্য অডিট রিপোর্টের মধ্যে পল্লী উন্নয়ন সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগে ১৪৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, রেল মন্ত্রণালয়ে ১৫৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা, পল্লী বিদ্যুৎ ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে ৮৮ কোটি, দেশের বিভিন্ন কাস্টমস এ ৪১ কোটি ৫২ লাখ, শুল্ক বিভাগে ১২ কোটি, নৌ মন্ত্রণালয়ে সাড়ে ৭ কোটি টাকার অনিয়মের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে মাসুদ আহম্মেদ বলেন, আর্থিক অনিয়মের এ অর্থ পরবর্তীতে আদায় ও  সমন্বয় করা হবে। প্রতি বছর বিভিন্ন খাতে অনিয়ম উদঘাটন করে গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার অর্থ আদায় ও সমন্বয় করা হচ্ছে। তিনি জানান, ২০১৩-১৪ অর্থবছরেই অনিয়মের ৭ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার আদায় ও সমন্বয় করা হয়েছে। বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির এ চিত্র চূড়ান্ত রূপ নয়। এটা শুধু নমুনা মাত্র। সরকাররের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অনিয়মের কারণ হিসাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মকর্তাদের বদলির হার অনেক বেশি। এজন্য অনেক কর্মকর্তা তাদের উপর উর্পিত দায়িত্বের কাগজপত্র সঠিকভাবে হস্তান্তর করতে পারেন না। অনেক সময় এ কারণেও অনিয়মের চিত্র পাওয়া যায়। এজন্য সবাইকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। মাসুদ আহম্মেদ বলেন, অনিয়ম হলেও আমরা এটাকে দুর্নীতি বলতে পারি না। আইনে এ ক্ষমতা আমাদের দেয়া হয়নি। আর অনিয়মে সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত থাকলেও কাগজ পত্র বা সরকারি নথিতে এর কোন রেকর্ড থাকে না। এজন্য এটা প্রমাণ করা যায় না। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিএজি ৫৭টি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, অধিদপ্তর, সকল স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, বিধিবদ্ধ সংস্থাসমূহ, ন্যূনতম ৫০ ভাগ সরকারি মালাকাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহে মোট ২২ হাজার ৪৩১টি ইউনিট সাংবিধানিক অডিটের আওতাভুক্ত। এছাড়াও বিদেশে অবস্থিত ৬৯টি বাংলাদেশ দূতাবাস, হাইকমিশন, কনস্যুলেট, ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বৈদেশিক শাখা ও বাংলাদেশ বিমান এর ১৭টি বৈদেশিক শাখা, উন্নয়ন বাজেটের সম্পূর্ণ ব্যয় অডিট করে রিপোর্ট প্রদান করাও সিএজি কার্যালয়ের দায়িত্ব। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এর পরিমাণ ৬৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা যার মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য ২১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা যা উন্নয়ন বাজেটের ৩২ দশমিক ৩২ শতাংশ। অডিট কার্যত্রম ছাড়াও বেসামরিক, সামরিক ও রেলওয়ে বিভাগ কর্তৃক উপযোজন হিসাব ও সরকারের আর্থিক হিসাব প্রত্যয়ন করেন সিএজি।

No comments

Powered by Blogger.