উচ্চশিক্ষায় বাধা : জালিয়াতি ও ফল বিপর্যয় by মো: তোফাজ্জল বিন আমীন

দেশ ও জাতি গঠনে শিার কোনো বিকল্প নেই। শিা জাতির মেরুদণ্ড। সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ধারাকে মজবুত করা সম্ভব নয় শিার আলো ছাড়া। আগামী প্রজন্মই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেবে এটাই সবার প্রত্যাশা। সুতরাং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সুশিায় শিতি হওয়ার সুযোগ দেয়া রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার মানকে ছোট কিংবা খাটো করে দেখানো এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এ লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন প্রজন্মের মেধাবীদের ফল বিপর্যয় সম্পর্কে একটি ভাবার সুযোগ সৃষ্টি। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়েও লিখেছি। এবারের বিষয়টি হচ্ছে প্রশ্নপত্র জালিয়াতি ও ভর্তি পরীার ফল বিপর্যয় নিয়ে। মেধাবীদের তালিকায় থাকতে কার না ইচ্ছে করে; কিন্তু সবার নাম মেধাবীদের তালিকায় ওঠে না। যারা মেধাবী তারাই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। তরুণ প্রজন্মের মেধাবীদের কাছ থেকে প্রথমেই মা চেয়ে নিচ্ছি। কারণ, যারা মেধাহীন তাদের ব্যাপারে আমার কোনো প্রশ্ন নেই; কিন্তু যারা জীবনের দু’টি পাবলিক পরীায় গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে মেধাবীদের তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তাদের বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করার চেষ্টা করব। মেধাবী বন্ধুরা যদি এ লেখা পড়ে কষ্ট পান তাহলে কিছুই করার নেই। কারণ এ লেখা লিখছি বিবেকের তাড়নায়।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দেখতে পেলাম প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীায় ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হতে ইচ্ছুক যোগ্য শিার্থী মাত্র দু’জন। বিষয়টি শুধু উদ্বেগেরই নয়, লজ্জারও। ঢাবি’র খ ইউনিটের ভর্তি পরীার ফল অনুযায়ী ইংরেজি বিভাগে ভর্তিতে যোগ্যতার শর্ত পূরণ করতে পেরেছেন মাত্র দুইজন ভর্তিচ্ছু শিার্থী। বিভাগের ১৫০ আসনের মধ্যে ১২৫ জন খ ইউনিট থেকে ভর্তির নিয়ম রয়েছে। এ অবস্থায় ভর্তি পরীায় ‘যোগ্যতাসম্পন্ন’ শিার্থী না পাওয়ায় বিকল্প উপায় খুঁজছে কর্তৃপ। লীগ সরকারের এবারের মতায় আসা নিয়ে আছে বৈধতা কিংবা অবৈধতার বিতর্ক। এ সরকারের অতীত শাসনামলেও অভিনবভাবে পাসের হার বেড়েছে; কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়, প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা যদি ভালো ফল করে মেধার বিকাশ ঘটায় এর চেয়ে আনন্দের বার্তা আর কী হতে পারে! কিন্তু আসলে কি তা হচ্ছে? দেখা যাচ্ছে জিপিএ ৫ পাওয়া এই ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।  শুধু পাসের হার এবং জিপিএ ৫ এর বিচারেই নয় রাজনৈতিক কৌশলেও গত বছরের তুলনায় এবারের এইচএসসি ও সমমানে পাসের হার বেড়েছে ৪ দশমিক ০৩ ভাগ। আর জিপিএ ৫ বেড়েছে ১২ হাজার ৪০৫। এবারের রেকর্ড পাসের নেপথ্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। এর বাইরে পরীার উত্তরপত্র মূল্যায়নের েেত্রও উদারনীতি অবলম্বনের নির্দেশনা। নাম প্রকাশ না করে একাধিক পরীক জানিয়েছে, নম্বর কম দিয়ে খাতা জমা দেয়ার পর প্রধান পরীকের প থেকে পরে খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির জন্য খ ইউনিটের ভর্তি পরীায় ২০১৪-২০১৫ শিাবর্ষে ৪০ সহস্রাধিক শিার্থী অংশ নিলেও পাসের হার মাত্র ৯ দশমিক ৪৫ ভাগ। এ বছর এইচএসসি পরীায় উত্তীর্ণ শিার্থীদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার। তাদের মধ্যে আবার ইংরেজি বিষয়ে রেকর্ডসংখ্যক নম্বরধারী শিার্থীর সংখ্যা কয়েক হাজার। পাবলিক পরীার এই অভাবনীয় ফলের পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীার েেত্র এই করুণ চিত্র ফুটে উঠায় শিার্থীদের মেধাস্তর নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। শিার মান নয় বরং জিপিএ ৫ পাওয়া ছাত্রদের সংখ্যা কিংবা পাসের হারই যে এ দেশের শিাব্যবস্থায় এখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ এই ফলাফল তারই একটি নিদর্শন মাত্র। গত ২০১২-২০১৩ শিাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদের অধীনে খ ইউনিটের ভর্তি পরীায় জিপিএ ৫ পাওয়া শিার্থীদের ৯০ ভাগই ফেল করেছে। এর মধ্যে ইংরেজি ও বাংলায় ৩০ নম্বরের মধ্যে পাস নম্বর ছিল ৮। এই দুই বিষয়ে ফেল করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় শতাধিক। ২০১০ ও ২০১১ সালে এই ফেলের হার ছিল যথাক্রমে ৫২ ও ৬২ ভাগ। ঢাবির ভর্তি পরীায় ১২০ নম্বরের মধ্যে পাস নম্বর হলো ৪৮। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফল করছে কিভাবে? তারা কি লেখাপড়া করছে না। তাহলে সে প্রশ্নের উত্তর হবে অবশ্যই করেছে। মন্ত্রী, শিার্থী বা অভিভাবক সবাই যেখানে খুশি পাসের হিড়িক দেখে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীায় ইংরেজিতে ৩ বা ৪ নম্বর পেলে কার বা কী আসে যায়।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে ভর্তি পরীার ডিজিটাল জালিয়াতি। পরীা শুরু হতে না হতেই প্রশ্নপত্রের সব সেট চলে যায় জালিয়াত চক্রের হাতে। এরা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে মোবাইল ফোন, হেডফোন, ব্লুটুথ ডিভাইস, ঘড়ি সদৃশ ক্যামেরার মাধ্যমে ঘটছে ডিজিটাল প্রশ্নফাঁস। প্রযুক্তির এসব উপকরণের চরম অপব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে অপোকৃত কম মেধাবী ও প্রতারকেরা। অপর দিকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত মেধাবী শিার্থীরা। প্রতিটি পরীায় এ ধরনের ঘটনা ভাবিয়ে তুলছে অভিভাকদের। উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক, শিার্থী ও বিশিষ্টজনেরা। তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে কেনা উত্তর দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন প্রতারণা আশ্রয় নেয়া ভর্তিচ্ছুরা। মেধাবীদের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিচ্ছে জালিয়াত চক্রের সদস্য ও প্রতারকেরা। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে জালিয়াতচক্র। যে চক্রে রয়েছেন মতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক, পরীা কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবং বিভিন্ন ভর্তি কোচিং সেন্টার ও তাদের শিক্ষকেরাও।
আমরা চাই, আমাদের শিার্থীরা শতভাগই পাস করুক। সবাই ভালো ফল করুক। তবে শুধু পাস করিয়েই নিশ্চয় দায়িত্ব শেষ হবে না। মানসম্মত শিার মান নিশ্চিত করতে হবে।
tofazzul1982@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.