প্রবীণদের প্রতি অবহেলা যেন বাড়ছেই by আঞ্জুমান আরা বেগম

বৃদ্ধাশ্রমের ট্র্যাডিশনটা আমাদের দেশে কিন্তু খুব বেশিকাল আগে থেকে শুরু হয়নিÑ বড়জোর বছর দশেক বা তার কম। আমরা যারা আটপৌরে বাঙালি তারা প্রথাটা মেনে নিতে পারিনি। অর্থাৎ টাকা-পয়সা খরচ করে নিজের বাবা-মাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। কারণ হিসেবে ওরা বলছে কাজের চাপ, বাবা-মাকে দেখাশোনা করতে গেলে স্ত্রী-সন্তানদের অসুবিধা, নিজের কাজের হ্যাম্পার হয়। তাই প্রপার চিকিৎসা ও সেবাযতেœ যাতে সমস্যা না হয় তাই তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তা না হলে দশ সন্তান থাকলেও বাবা-মাকে দেখাশোনা কে করবে, এ নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবে। বাবা-মা সন্তানকে যখন পৃথিবীতে জন্ম দেন তখন কিন্তু তারা কোনোভাবেই সন্তানকে বুকের কাছ থেকে আলাদা করতে চান না। খেতে দেন নিজে না খেয়ে। অথচ বৃদ্ধ হলে সন্তান সে কর্তব্যটুকু করা থেকে বিরত থাকে স্বার্থপরের মতো।
ঘটনা-১
মাদারীপুরের বাসিন্দা বৃদ্ধ জমিলা খাতুনের বয়স ৯০ বছর। ছেলের বউ একটি সরকারি কলেজের প্রভাষক। মাত্র ১৫ বছর বয়সে শাশুড়ি জমিলা খাতুন তাকে পুত্রবধূ করে ঘরে এনে পড়াশোনা করান নিজের মেয়ের মতো। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে চাকরি পান। সাথে সাথে ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেন একমাত্র শাশুড়িমায়ের আদরযতœ আর মমতায়। কারণÑ বৃদ্ধ জমিলা নাতি-নাতনীদেরও সমান যতেœ বড় করেন। যার কারণে পুত্রবধূ পড়াশোনা ও চাকরি করার সুযোগ পান। তেমনি পুত্রবধূও বৃদ্ধ জমিলা খাতুনকে খুবই যতœ করেনÑ নিয়মিত ওষুধ খাওয়ানো, গল্প করা, সময়মতো সব রকম  সেবাযতœ নিজ হাতেই করতেন। তাই বৃদ্ধা কখনো তার অন্য ৯ মেয়ের বাসায় বেড়াতে যেতে চাইতেন না। কারণ হিসেবে বলতেন, ‘আমার বউমা আমাকে যে যতœ করতে পারে তা তোমরা পারো না।’ বৃদ্ধার মেয়েরা এতে মনে সাময়িক কষ্ট পেলেও আসলে ছোট ভাইয়ের বউয়ের প্রতি বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন। কিছু দিন আগের কথা বৃদ্ধা মৃত্যুশয্যায়, ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনীরা চার পাশ ঘিরে বসে আছে। বৃদ্ধা বারবার পুত্রবধূকে ডাকছিলেন আর বলছিলেন, মারে তোর হাতে পানি খাবোÑ হ্যাঁ পুত্রবধূর হাতের পানি খেয়েই লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলতে বলতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। পুত্রবধূ আজো শাশুড়িমায়ের কথা বলতে বলতে চোখ মুছতে থাকেন আর বলেন, ছেলেবেলায় মাকে হারিয়ে বিয়ের পর শাশুড়িমাকে পেয়ে মায়ের অমন স্নেহমমতা পেয়ে নিজের মায়ের অভাব আমি কখনো টের পাইনি। তাই আমি প্রার্থনা করি বাঙালির প্রতিটি বউয়ের ভাগ্যে যেন এমন শাশুড়িমা জোটে।
ঘটনা-২
শর্মিষ্ঠা দত্ত বয়স ৭০ বছর। অল্প বয়সে স্বামী মারা গেলে ছোট ছোট চার ছেলে ও দুই মেয়েকে তিনি চাকরি করে ও স্বামীর রেখে যাওয়া কিছু ব্যাংক ব্যালান্স দিয়ে মানুষ করেন। এতে চার ছেলেই বিদেশে পাড়ি জমান উচ্চশিক্ষার্থে। কিন্তু তারা পড়াশোনা শেষে বাড়ি বা দেশে ফেরার কথা একদম ভুলে যান। এ দিকে মেয়ে দুটোকে তিনি তার শেষ আশ্রয়টুকু বিক্রি করে বিয়ে দেন। ফলে বৃদ্ধ বয়সে মাথা গোঁজার ঠাঁইও তিনি হারান। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থাকেন বিধায় মাকে তাদের কাছে কিছু দিনের জন্য বেড়াতে নিয়ে রাখেন কিন্তু দীর্ঘ সময়ের জন্য আর রাখতে পারেন না। কারণ স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন মন্দ বলতে থাকে। নিরুপায় হয়ে দুই বোন ভাইদের কাছে চিঠি লেখে। ভাইরা বোনদের অনুরোধে দেশে আসে। বহু দিন পর মা তার ছেলেদের দেখে বুকে জড়িয়ে ধরেন। ভীষণ খুশি হন। ভাবেন এই বুঝি জীবনের সব যন্ত্রণার অবসান হতে যাচ্ছে। বৃদ্ধা ছেলেদের কাছাকাছি থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু নাহ! ছেলেরা সব কিছু বিবেচনা করে ঠিক করে মিরপুরে একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে মাসিক টাকার বিনিময়ে সেখানে মাকে তারা রেখে আসবে। ছেলেরা মাসে মাসে টাকা পাঠাবে। ছেলেমেয়েদের এই সিদ্ধান্তে মা ভীষণ কষ্ট পানÑ মনে মনে ভাবেন নিজের শরীরের রক্ত পানি করা শ্রম দিয়ে যে ছয়টি ছেলেমেয়েকে তিনি মানুষ করেছেন বিয়ে পর্যন্ত দিয়েছেন মাথা গোঁজার শেষ সম্বলটুকু দিয়ে। সে সন্তানদের আজ মাকে আশ্রয় দেয়ার সাহস নেই! এ কেমন নিয়তি।
ঘটনা-৩
দুই ছেলে দুই মেয়েকে মানুষ করে ৬৫ বছর বয়সের মিনতি রায়। চার ছেলেমেয়ের বাসায়ই পালাক্রমে ঘুরে বেড়ায় তার যখন যেখানে যেতে মন চায়। স্বামীর ভিটে বলতে একটি ফ্যাটে মিনতির মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। শক্তসমর্থ বৃদ্ধা সারা জীবন চাকরি করেছেন। কারো কাছে মাথা নত করার মতো মানসিকতা তার নেই। তাই সে একদিন মিটিং বসায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে। ঠিক করে মা কার কাছে থাকবেন? চারজন চার রকম কথা বলে। এ বলে ওর বাসায় ও বলে এর বাসায়। শেষমেশ ঠিক হয়Ñ “মা বাবার ভিটেতেই থাকবেন। তার সব খরচপাতি বেয়ার করবে ছেলেমেয়েরা। ছেলেরা নির্দিষ্ট একটি অ্যামাউন্ট দেবে, মেয়েরা দেবে তার অর্ধেক। এতে বৃদ্ধা দুটো চাকর রেখে গাড়ি মেনটেইন করে সুন্দর করে চলতে পারবেন। তবে বৃদ্ধা একটি শর্তারোপ করে বলেন যে, প্রতি সপ্তাহের একটি ছুটির দিন সবাইকে মায়ের সাথে সময় কাটাতে হবে এবং বৃদ্ধাও যখন যার বাসায় মন চায় বেড়াতে যাবেন। যেই কথা সেই কাজ শর্তানুযায়ী সবাই সব কথা মেনে চলে। বৃদ্ধা খুব খুশিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। কারো কোনো অভিযোগ অনুযোগ আর থাকে না।
ঘটনা-৪
ফুলবানু বয়স ৬০ বছর। ফরিদপুর জেলায় তার বসবাস। একমাত্র ছেলে জসিমউদ্দিনকে ভিক্ষে করে কোনোমতে খাইয়েদাইয়ে বড় করে তোলেন। কিন্তু লেখাপড়া করানো বা অন্য কোনোভাবে তাকে ডেভেলপ করা সম্ভব হয়নি। গরিব জসিমউদ্দিন রিকশা চালিয়ে নিজে চারটি ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ করতে হিমশিম খেয়ে যায়। তাই মাকে নিয়ে তার যত সমস্যা। জসিমউদ্দিনের বউ শাশুড়িকে একদম সহ্য করতে পারে না। প্রতিদিন বউ-শাশুড়িতে লাগে মহা গ্যাঞ্জাম সব মিলিয়ে গরিবের সংসারেও হয় মহাপ্রলয়। বেচারা জসিমউদ্দিন পড়েছে মহাবিপদে। তাই একদিন রাতে বুড়ি মাকে চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে একটি বস্তায় ভরে নদীর ধারে ফেলে রেখে আসে। ভোরে জেলেরা মাছ ধরতে এসে বৃদ্ধাকে তুলে নিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে যায়। কোর্টে সরকারিভাবে মামলা হয়Ñ সন্তানের বিরুদ্ধে সন্তান মাকে ফেলে আসার কথা স্বীকার করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মা ছেলের কান্না দেখে বলেÑ আমার ছেলেকে আপনারা কিছু বলবেন নাÑ আমি ভিক্ষে করে নিজের পেট চালাব। ছেলের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। ওকে আপনারা ছেড়ে দিন। বুড়ি তার মতো করে এ বাড়ি ও বাড়িতে ভিক্ষে করে দিনযাপন করতে থাকেন।

No comments

Powered by Blogger.