বাংলাদেশে ব্যাংক ডাকাতি by তাহমিমা আনাম

‘আমাদেরও আছে’- বাংলাদেশে আমরা কখনও কখনও এ খেলাটি খেলি। বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে এটা খেলা যায়। এ খেলাতে আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি আমাদের এখন কোন একটি নির্দিষ্ট জিনিস আছে যেটা শুধু এর আগে অন্যান্য দেশে পাওয়া যেতো। নব্বইয়ের দশকে ছিল স্যাটেলাইট টেলিভিশন (আমাদের এমটিভিও আছে!); ২০০০ সাল ও পরবর্তী দশকের দিকে ছিল শপিং মল, উঁচুতল ভবন আর মালটিপ্লেক্স সিনেমা। আর এ বছর ছিল, হলিউড স্টাইলে ব্যাংক ডাকাতি। জানুয়ারিতে সোহেল নামের এক ব্যক্তি ও তার সহযোগী ইদ্রিস রাজধানী ঢাকার ৭০ মাইল উত্তরে কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে প্রায় ১৭ কোটি টাকা চুরি করে। পরে সোহেলকে ইউসুফ মুন্সি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে, তার ভাই ইদ্রিস মুন্সি ও অন্য সহযোগীদের ডাকাতির কয়েক দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হলেও এর পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ এটাই ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ওই ডাকাতির বিস্তারিত সামনে আসে। প্রবল আগ্রহ নিয়ে আমরা ঘটনার ইতিবৃত্ত জানতে পারি। কিভাবে মি. মুন্সি ওই ব্যাংক ডাকাতি করার পরিকল্পনা করেছে দু’বছর ধরে, কিভাবে ব্যাংকের পাশে বাসা ভাড়া নিয়েছে আর ব্যাংকের সিন্দুক পর্যন্ত ৩০ ফুট দীর্ঘ সুড়ঙ্গ কেটেছে। এমনকি এমন প্রতিবেদনও এসেছিল- তার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যাংকের এক কর্মচারীর সঙ্গে সম্পর্ক ফেঁদেছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ‘দ্য ব্যাংক জব’-এর মতো নানা হলিউড মুভির সঙ্গে তুলনার ঝড় ওঠে। মনে হচ্ছে মি. মুন্সি একটি ধারার সূত্রপাত করেছে। মার্চ মাসে বগুড়াতে সোনালী ব্যাংকের আদমদীঘি শাখা থেকে ৩০ লাখ টাকা চুরি হয়। নিকটবর্তী একটি আসবাবের দোকান থেকে ব্যাংকের সিন্দুক পর্যন্ত সুড়ঙ্গ কেটে একই কায়দা ব্যবহার করে চোরেরা। আর গত মাসে জয়পুরহাটের একটি ব্র্যাক ব্যাংক শাখা থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা নিয়ে ভেগে যায় অপরাধীরা। এ দফায় পাশের ভবন থেকে ছিদ্র কেটে সংঘটিত হয় ডাকাতি। ব্যাংকের পাশের ঘর ভাড়া নিতে গিয়ে ডাকাতরা দাবি করেছিল তারা পুওর ডেভেলপমেন্ট নামক একটি অলাভজনজক সংস্থার কাজ শুরু করছে। আর হ্যাঁ, বাংলাদেশে আমাদের বিড়ম্বনাও আছে। আমাদের মনোযোগ যখন সিনেমা স্টাইল ডাকাতির দ্রুত বিস্তারের দিকে তখন সব থেকে বড় বিড়ম্বনা হলো, মি. মুন্সি ও তার নকলবাজ অপরাধীরা সত্যিকারের ব্যাংক ডাকাত নয়। বড় চোরেরা চোখের সামনে লুকিয়ে আছে। আর তাদের অনুমোদন দিয়েছে ওই ব্যাংকগুলোই। তারা হলো ঋণখেলাপি: ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যারা ব্যাংকের থেকে অর্থ ঋণ নেয় ফেরত দেয়ার কোন অভিপ্রায় ছাড়াই। সমস্যা মনে হয় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াতে। দু’ধরনের ব্যাংক রয়েছে: বেসরকারি ব্যাংক, যেগুলোর তত্ত্বাবধান করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর রাষ্ট্র পরিচালিত বাণিজ্যিক ব্যাংক যেগুলো সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় চলে। বেসরকারি ব্যাংকে তো ঋণখেলাপিরা আছেই (কখনও তারা এসব ব্যাংকের বোর্ডের আসনে আসীন), সরকারি ব্যংকগুলোও যে হারে এমন ঋণের অনুমোদন দিয়েছে তা অভাবনীয়। ঋণখেলাপের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বর্তমানে ২ থেকে ৩ শতাংশ। বাংলাদেশে এটা ১২ শতাংশেরও ওপরে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যাংকগুলোতে বকেয়া ঋণের হার ২৯ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। ২০১৩ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্বল অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, দুর্বল কর্পোরেট শাসন ব্যবস্থা, ঋণ মানদণ্ডের শিথিলতার ফলে ঋণ অনুমোদনে অনিয়ম দেখা দিয়েছে। এটা রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যাংকগুলোকে তাদের অর্ধ বিলিয়ন ডলারের বেশি পরিমাণ ঋণকে খেলাপি ঋণ তালিকাভুক্ত করতে বাধ্য করেছে। গত ছয় বছরে রাষ্ট্র পরিচালিত প্রধান ৪টি ব্যাংক ঋণ খেলাপি বৃদ্ধি দেখেছে। ওই চার ব্যাংকে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২.৪৫ বিলিয়ন ডলার। (এর মধ্যে ইতিমধ্যে ক্ষতির তালিকাভুক্ত প্রায় ২ বিলিয়ন অন্তর্ভুক্ত নয়)। এর অর্থ হলো বড় অংকের অর্থ ব্যাংকিং প্রক্রিয়া থেকে নেয়া হয়েছে। আর চড়া সুদের হারের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাধ্য হতে হয়। বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোতে সুদের হার প্রায় ৯ থেকে ১৬ শতাংশ। পক্ষান্তরে জমা রাখার ক্ষেত্রে আয় ৬ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বেসিক ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান লজ্জাজনকভাবে শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপির তালিকায় স্থান পেয়েছেন, যিনি প্রায় ১৫০ কোটি ডলার ঋণ নেয়া এক শীর্ষ অভিযুক্ত। ব্যাংক এ ঋণের কিছুটা উদ্ধার করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মূলত অসফলই হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আইনের আশ্রয় নেয়া গেছে সামান্যই। কেননা বিচার ব্যবস্থা সাংঘাতিকভাবে ভারাক্রান্ত। আদালতে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ৮ লাখেরও বেশি মামলা চলমান রয়েছে। রাষ্টায়ত্ত ব্যাংকে এ ধরনের অবস্থা পরিবর্তন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে সমপূর্ণ পৃথক একক একটি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে আসা। যে সব ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ রাজনৈতিকভাবে নিয়োগকৃতদের হাতে নিয়ন্ত্রিত এবং যাদের কোন নিরপেক্ষ সংস্থা কতৃক নিরীক্ষার ঝুঁকি নেই সেসব ব্যাংকে সবসময়ই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রক্রিয়া সৃষ্টি হবে। মুন্সি ভাইদের হাতে চুরি হওয়া অর্থ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন উদ্ধার করার পর প্রায় ২ কোটি টাকা পাওয়া যাচ্ছিল না। ইউসুফ মুন্সি দাবি করেছিলেন, এ অর্থ স্থানীয় এক ধর্মীয় নেতার জন্য এক ট্রাক চাল কিনতে ব্যয় করা হয়েছে। এ টাকা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুন্সির এ ঘটনার পর, বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার পরামর্শ দেয়। ও হ্যাঁ, এটা অনেকটা এমন শোনাচ্ছিল, তাদের ভল্টগুলোতে আরও কিছুটা সিমেন্ট ব্যবহার করা হবে। যখন আমরা ব্যাংকের শাখাগুলোতে প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা নিতে পারছি, তখন আমাদের উচিত, ব্যাংকের ভেতরে থেকে যারা চুরি করে, সে সকল স্যুট পরা ব্যবসায়ীদের প্রতিহত করার পদক্ষেপ নেয়া, যারা দিন দুপুরে আমাদের ব্যাংকগুলো লুণ্ঠন করে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ

No comments

Powered by Blogger.