ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য এক ইসরাইলির লং ওয়াক by গোলাপ মুনীর

বিডিএস মুভমেন্ট। পুরো কথায় ‘বয়কট, ডাইভেস্ট অ্যান্ড স্যাঙ্কশন মুভমেন্ট’। এটি ইসরাইলি বিরোধী একটি গ্লোবাল ক্যাম্পেইন। একটি নন-ভায়োলেন্ট তথা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। অনেকটা গান্ধীর অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মতো। এই আন্দোলনের সারকথা হচ্ছে- যত দিন ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলবে না, লঙ্ঘন করে চলবে ফিলিস্তিনিদের অধিকার, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা দেবে না; তত দিন ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিরোধী বর্জন, পরিত্যাগ ও নিষেধাজ্ঞা (বয়কট, ডাইভেস্ট ও স্যাঙ্কশন) জারি রাখতে হবে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য, বিডিএস মুভমেন্টের বর্ণিত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ইসরাইলের ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়িয়ে তোলা। এ আন্দোলনের দাবি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর থেকে দখলের অবসান ঘটাতে হবে, থামাতে হবে ইসরাইলি উপনিবেশ গড়ার প্রক্রিয়া। ইসরাইলের আরব-ফিলিস্তিনি নাগরিকদের সম-অধিকার কার্যকর করতে হবে। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে আসার অধিকারের প্রতি পূর্ণ সম্মান দেখাতে হবে।  এই আন্দোলনের সূচনা ২০০৫ সালের ৯ জুলাই। ১৭১টি ফিলিস্তিনি এনজিও ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বয়কট, ডাইভেস্ট ও স্যাঙ্কশন কার্যকর করার দাবি নিয়ে এ আন্দোলনের সূচনা করে। জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব ও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী যুগের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের বিষয়টি মাথায় রেখে বিডিএস আন্দোলনকারীরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে এই বয়কট আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের সমালোচনাকারীরা বলে- এই আন্দোলন ইসরাইল রাষ্ট্রকে অবৈধ করতে চায়; কিন্তু বিডিএস সমর্থকেরা বলছে- বর্ণবাদী যুগে দক্ষিণ আফ্রিকা-বিরোধী একই ধরনের বয়কট আন্দোলন চলেছে। দশকের পর দশক ধরে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার মৌল অধিকার অস্বীকার করে চলেছে। সম-অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এখানে ভূলুণ্ঠিত। চলছে জাতিনিধন প্রক্রিয়ায় উপনিবেশ গড়ে তোলার যাবতীয় উদ্যোগ। জাতিগত বৈষম্য, সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারি। ইসরাইলি নীতির বারবার নিন্দা এসেছে জাতিসঙ্ঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিখ্যাত সব মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে। এর পরও বিশ্বসমাজ ইসরাইলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেনি। ইসরাইলকে বাধ্য করতে পারেনি আইনের মৌলনীতিগুলো মেনে চলতে। বরং ইসরাইল যুদ্ধাপরাধের মতো অপকর্ম করে বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনি সুশীলসমাজ এ ব্যাপারে বিশ্বনাগরিকদের সাড়া কামনা করে। আন্তর্জাতিক আদালতে অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দেয়াল নির্মাণকে অবৈধ ঘোষণা করার এক বছর ২০০৫ সালের ৯ জুলাই ফিলিস্তিনি সুশীলসমাজ আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানায় ইসরাইল বর্জনের। এর মাধ্যমে সূচিত হয় বিডিএস আন্দোলন। বিডিএস মুভমেন্টে ব্যাপকভাবে তিন ধরনের ফিলিস্তিনিরা সংশ্লিষ্ট হন : শরণার্থী, দখল করা পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরাইলি দখলাধীনে থাকা ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইলে বসবাসরত ফিলিস্তিনি। বিডিএসের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মূলত তিনটি দাবি তোলা হয় : এক. ১৯৬৭ সালের জুনে দখল করা সব আরব ভূমি থেকে দখল ও উপনিবেশের অবসান ঘটাতে হবে এবং ইসরাইলের তোলা তথাকথিত নিরাপত্তা দেয়াল ভেঙে ফেলতে হবে; দুই. ইসরাইলে বসবাসরত আরব-ফিলিস্তিনি নাগরিকদের পূর্ণ সমানাধিকারের ভিত্তিতে মৌল অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি এবং তিন. জাতিসঙ্ঘের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের তাদের আবাসভূমিতে ফিরে আসার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। বিডিএসের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে ১৭০টি ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন ও আন্দোলন। এ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এর আহ্বান প্রথম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় ২০০৭ সালের নভেম্বরে রামাল্লায় অনুষ্ঠিত প্রথম ফিলিস্তিন বিডিএস সম্মেলনে। এ সম্মেলনে বিডিএসের আন্দোলন কর্মসূচি সমন্বয় করার জন্য গঠন করা হয় বিডিএস ন্যাশনাল কমিটি (বিএনসি)। বিএনসি বিশ্বব্যাপী বিডিএস কর্মসূচির সমন্বয় করছে। বিএনসির সমন্বয় সূত্রে এ পর্যন্ত পৃথিবীর অসংখ্য দেশে অসংখ্য কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল।
গত ২ অক্টোবর ছিল ইন্টারন্যাশনাল ডে অব নন-ভায়োলেন্স। ওই দিনটিতে গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের আদলে বিডিএস আন্দোলনের ন্যায্যতার প্রতি সমর্থন জানানোর একক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করলেন এক ইসরাইলি। ওই দিনটিতে এই ইসরাইলি শিক্ষাবিদ ও রিফিউসেনিক (ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় ফিলিস্তিন-বিরোধী নীতি মেনে নিতে অস্বীকারকারী) ড. মার্সেলো ইসভিরস্কি পৌঁছলেন তার লক্ষ্যে- অস্ট্রেলীয় পার্লামেন্টে। উদ্দেশ্য, অস্ট্রেলীয়দের স্বাক্ষর করা একটি পিটিশন পার্লামেন্টে পেশ করা। এ পিটিশনে অস্ট্রেলীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বিডিএসের দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে। ড. মার্সেলোর এই বিডিএস মিশনের আওতায় তিনি সিডনি থেকে ক্যানবেরা পর্যন্ত ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন। তার এই লং ওয়াক সম্পন্ন করতে সময় লেগেছে ১০ দিন। তিনি তার এই লং ওয়াক শুরু করেন আইকোনিক সিডনি অপেরা হাউজ থেকে। এরপর চলতে শুরু করেন উপকূল বরাবর দক্ষিণ দিকে, এরপর দেশমধ্যবর্তী এলাকা পার হতে চলেন পশ্চিম দিক বরাবর। তাকে পার হতে হয়েছে অনেক ঝোপঝাড় ও পল্লী এলাকার ভূখণ্ড। কখনো তাপমাত্রা ১ ডিগ্রিতে নেমে এসেছে, আবার কখনো উঠে গেছে ৩০ ডিগ্রিতে। এ সময়ে ঘটেছে নানামাত্রার বৃষ্টিপাত। কখনো প্রবল ঝড়োবাতাস, আবার কখনো কড়া রোদের প্রতিকূল পরিবেশে তাকে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
তার এই ৩০০ কিলোমিটারের লং ওয়াকের একমাত্র লক্ষ্য বিডিএস আন্দোলন অধিকতর বেগবান করা। ডন মার্সেলোর ব্যাকপ্যাকে লেখা ছিল : ‘BOYCOTT ISRAEL, BDS Sydney to Canberra’- এ লেখা দেখে এ স্লোগানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এ পথ দিয়ে যাওয়া মোটর চালকেরা। বিকেলবেলা মফস্বল শহরে চলা স্বাগত সমাবেশে সমবেতরা প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন বিডিএসের প্রতি সহায়তা করার ব্যাপারে। এর মধ্যে কয়েক দিনে মার্সেলো সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন সাউদার্ন হাইল্যান্ডস প্যালেস্টিনিয়ান সাপোর্ট গ্রুপের তিন তরুণ ফিলিস্তিনি- তারেক হালাওয়া, ডেইন ডাউনেস ও নোয়েল ফারগুসনকে। এরা তার সাথে ছিলেন এক দিন। এর পর তারেক এবং মেলবোর্নের জন সেলিসবারি তার সাথে ছিলেন শেষ দুই দিন। এরা ক্যানবেরার একদম কিনারায় পৌঁছে সাক্ষাৎ পান অধ্যাপক স্টুয়ার্ট রেস, পল ডুফেল, জন ওয়াকার এবং গাজার ছাত্র শামিক ভদ্রের। এরপর সামনে এগিয়ে যাওয়ার পর দেখা পান আরো অনেকের। মার্সেলো পিটিশনটি সরবরাহ করেন পার্লামেন্টে, যা পার্লামেন্টে উপস্থিত হবে আগামী ২৭ অক্টোবর। মূলত পিটিশনগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল অনলাইনে। লক্ষ্য ছিল এই পিটিশনগুলো পার্লামেন্টে উপস্থাপন করবেন স্বতন্ত্র সিনেটর নিক জেনোফেন এবং গ্রিনস সিনেটর লি রিয়ানন, কিন্তু উভয়েই পিছু হটলেন। কারণ, অস্ট্রেলীয় সরকারে জায়নবাদীদের খুঁটির জোর বেশি।
সাবেক অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বব কার সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন তার পলিটিক্যাল ডায়েরি। এতে তুলে ধরা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ওপর ইসরাইলি লবির অতিরিক্ত মাত্রার প্রভাবের নানা বর্ণনা। তিনি উল্লেখ করেছেন, এই প্রভাবকে একটি ‘দুষ্টপর্যায়ে’ নিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে পার্টি ডোনেশন এবং এমপি ও সাংবাদিকদের ইসরাইল সফর করানোর কর্মসূচির মাধ্যমে। বব কার ঠিকই বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার কোনো রাজনীতিবিদ পার্লামেন্টে মার্সেলোর পিটিশন উত্থাপনের সাহস দেখাবে না। কার্যত ইসরাইলি লবিই এখন ‘ওয়ানস-বাট-নো-লঙ্গার-ডেমোক্র্যাটিক-সভরেন’ অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টের মালিক।
মাইকেল ড্যানবি এমপিকে সক্রিয়বাদীরা অভিহিত করে ‘মিনিস্টার ফর ইসরাইল’ অভিধায়। এই ফেডারেল এমপি একটি লেখার মাধ্যমে বিদ্রূপাত্মকভাবে ওলংগং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ ইসরাইলে জন্ম নেয়া ইহুদি ড. মার্সেলোর এই অকুতোভয় উদ্যোগের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্যপূর্ণ জট পাকানো সমালোচনা করেছেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মার্সেলো ইসভিরস্কিকে বিডিএসের দাবি সমর্থন করতে দেখে। সেই সাথে বলেছেন, ‘বিডিএসের প্রকৃত লক্ষ্য ইসরাইল রাষ্ট্রের পতন ঘটানো।’ অথচ ন্যায়নীতির অবস্থান থেকেই মার্সেলো এই বিডিএস সমর্থন অভিযানে নেমেছেন। এর উলঙ্গ সমালোচনা করে এমপি ড্যানবি তার মিথ্যাচার ও সঙ্কীর্ণতাকেই প্রকাশ করলেন। মার্সেলো কোনো উচ্চ অথচ অলীক আদেশের অনুগামী কুইক্সট নন, তাই তিনি উদ্দেশ্যহীনভাবে কোনো রাজনৈতিক উইন্ডমিলের পেছনে ছুটতে পারেন না। তিনি স্বীকার করেন, তিনি কোনো অর্বাচীন, অনভিজ্ঞ কাঁচা লোক নন। তিনি এমনটি প্রত্যাশা করেন না, অস্ট্রেলীয় পার্লামেন্ট তাৎক্ষণিকভাবে বিডিএসের প্রতি অনুসমর্থন জানাবে। তিনি আশা করেন, তার উদ্যোগের ফলে সেখানে সরকারিপর্যায়ে একটি রাজনৈতিক বিতর্কের সূচনা করবে এবং সূচনা করবে একটি ভবিষ্যৎ প্রক্রিয়ার, যার সূত্র ধরে ফিলিস্তিনি জনগণের রাজনৈতিক ও মানবিক অধিকারের প্রতি অস্ট্রেলিয়া এক সময় সমর্থন ঘোষণা করবে, ইসরাইলকে অন্ধভাবে সমর্থন করার অবস্থান থেকে সরে আসবে। মার্সেলো বলেন : ‘আমার এ কাজটিকে অস্ট্রেলিয়ায় ও বিশ্বব্যাপী বিডিএসের অর্থপূর্ণ কর্মসূচি বা কাজের সমুদ্রের মাঝে ছোট্ট একটি কাজ হিসেবেই আমরা দেখতে পারি। আমাদের কাজের তাগিদটা হচ্ছে আমাদের রাজনীতিবিদদের সহায়তা জোগানো, যাতে করে অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়নীতির পক্ষে অবস্থান নিতে পারে।‘
এ মানুষটি এক অকুতোভয় বীরের মতো ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতা ও যাবতীয় অধিকার আদায় আন্দোলনে একজন ইহুদি ফিলিস্তিনি হয়েও অন্যান্য সাধারণ ভূমিকা পালন করছেন, ইসরাইল থেকে এ বিষয়টিকে কিভাবে দেখা যেতে পারে? মার্সেলোর এই লং ওয়াক তার বৈশিষ্ট্যের একটি মেটাফোর বা রূপক। তার বাস্তব শক্তি হচ্ছে তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক সংহতি। ইসরাইলে কেউ ডিসিডেন্ট বা ভিন্নমতাবলম্বী হতে হলে তার চাই মনের ভেতরের পর্যাপ্ত শক্তি। কারণ সেখানে জন্মের পর থেকে প্রতিটি শিশুকে শেখানো হয় শত্রুকে ঘৃণা করতে- আর এই শত্রুটি হচ্ছে ফিলিস্তিন। ১৯৪৮ সালের পর থেকে ইসরাইলের প্রতিটি শিশুপ্রজন্মকে নিতে হয় সামরিক প্রশিক্ষণ। সামরিক শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ শেষে এদের ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করতে হয় সেনাবাহিনীতে। অতএব সংখ্যালঘু হোডিম ইহুদিদের (যারা সেকুলার ইহুদি রাষ্ট্রের বিরোধী) বাদ দিলে ইসরাইল একটি সৈনিক জাতি।
ইসরাইলে ভিন্নমতাবলম্বী (ডিসিডেন্ট) হওয়ার চেয়ে রিফিউসেনিক (সেই সচেতন সৈনিক যিনি মার্সেলোর মতো ফিলিস্তিনিদের অবরোধ ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিষ্ঠুরভাবে দখল করার কাজে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে) হওয়ার জন্য মনের ভেতরের আরো বেশি শক্তির প্রয়োজন। সে ধরনের মনোবল না থাকলে ফিলিস্তিনিদের ও প্রাত্যহিক অমানবিক দুর্ভোগ সৃষ্টির ইসরাইলি অপকর্মের বিরোধিতা করতে পারে না। এ ধরনের ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ার ঝুঁকির কথা জানিয়েছেন মহিলা রিফিউসেনিক মোসান সন্তাগ তার ভূমিকায়।
রিফিউসেনিক মার্সেলোকে দিতে হয়েছে সমাজচ্যুতির মূল্য। বিচ্ছিন্ন করে রাখা, মানসিক শাস্তি, শত্রুতামি করা, পারিবারিক অবজ্ঞা, বন্ধুবান্ধব ও জাতির কাছ থেকে অবজ্ঞা ইত্যাদি সবই জুটেছে মার্সেলোর কপালে। কারণ তিনি নিজেকে মানাতে পারেননি ইসরাইলি মনমানসিকতার সাথে। এটি করলে তিনি শ্রদ্ধাশীল হতে পারতেন না ফিলিস্তিনিদের প্রতি, দাঁড়াতে পারতেন না তাদের সুরক্ষার আন্দোলনের পক্ষে। মার্সেলো সেই জন যিনি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তির সার্বজনীনতার প্রতি ও সমগ্র মানবজাতির প্রতি।
ইসরাইলিরা একটি জায়নবাদী মিথ্যাকে চিরস্থায়ী করতে চায়। এরা মিথ্যাচার করে বলে- ফিলিস্তিন ছিল একটি ‘এম্পটি ল্যান্ড’ এবং ফিলিস্তিনিরা হচ্ছে একটি ‘ইনভেনটেড পিপল’। মার্সেলোর নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিকে বদলে দেয়ার মধ্যে সীমিত নয়। তিনি সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন ‘আফটার ইসরায়েল’ নামের একটি বই। তার এই বইয়ে সাধারণ ইসরাইলিদের জন্য শান্তির পথনির্দেশ রয়েছে। এই শান্তির পথ হচ্ছে সামাজিকভাবে জায়নবাদ ও সামরিকবাদের উচ্ছেদ। ‘আফটার ইসরায়েল’ হচ্ছে একটি সেকুলার বই। এতে ধর্মীয় গোঁড়ামি তথা রিলিজিয়াস ডগমা হিসেবে জায়নিজমকে মেনে নিতে অস্বীকার করা হয়েছে। এই চমৎকার বইটির মাধ্যমে মার্সেলো সাহস দেখিয়েছেন জায়নিজম পাঠ করতে ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসের অধ্যায় এবং এই ভূখণ্ডে বসবাসরত দুই জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের পাঠ আমলে নিয়ে। বইটি কোনো ঈশ্বরলব্ধ জ্ঞানের প্রকাশ নয়, নয় কোনো প্রফেসি বা ভবিষ্যবচনও। এটি আজকের দিনের ইসরাইলি সরকারের কর্মকাণ্ডের স্বরূপ উন্মোচনের এক সাহসী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ।
অতি সম্প্রতি গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর ৫১ দিনের অসভ্য, বর্বর, নির্মম সন্ত্রাসী হামলার বেলায় আমরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসঙ্ঘ, চীন, রাশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশকেই নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। ফিলিস্তিনি জনগণ কোনো মতেই এমনটি ভরসা করতে পারছে না- বিশ্বশক্তিগুলো ফিলিস্তিনে শান্তি এনে দেবে, স্বাধীনতা এনে দেবে। বরং এখন ভরসা করতে পারে ‘পিপল পাওয়ার’-এর ওপর। বিডিএসের মাধ্যমে বিশ্বজনমতের প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে রাস্তায়, মার্সেলোর মতো বিবেকী মানুষদের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
সবশেষে বলব ‘BOYCOTT, DIVEST, SANCTION (BDS)’ নামের এই আন্দোলনে যখন বিশ্বব্যাপী জাতিধর্ম নির্বিশেষে বিবেকী মানুষেরা সংহতি প্রকাশ করে পালন করছে নানাধর্মী কর্মসূচি, তখন বাংলাদেশীরা এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে লজ্জাজনকভাবে। এখন সময় সে লজ্জা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার। সেই সাথে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও ফিলিস্তিনিদের অধিকার বাস্তবায়নের আন্দোলনকে আরো জোরদার করে তোলার। বিশ্বব্যাপী বিবেকী তরুণেরা আজ বর্জন করছে ইসরাইলি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বজুড়ে নগরে নগরে মানুষ রাজপথে নেমে আসছে ইসরাইলি বর্বরতার, অমানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে, স্বাধীন ফিলিস্তিন বাস্তবায়নের দাবি জানাতে। শুরু হয়েছে ইহুদিদের কোম্পানিগুলোর পণ্য বর্জনের হিড়িক। গড়ে উঠছে ইসরাইল-বিরোধী বিশ্বজনমত, সে পথেই আসবে ফিলিস্তিনে স্বাধীনতা, ফিলিস্তিনিদের অধিকার। এ বাস্তবতা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

No comments

Powered by Blogger.