বিদ্যুৎ ভোগান্তিতে অতিষ্ঠ মানুষ

কাগজ-কলমে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় বেশি। অথচ বিতরণ কোম্পানিগুলোর চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। সবচেয়ে সঙ্কটে রয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। সংস্থাটির গ্রাহক সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৩ লাখ। এই সংস্থার চাহিদা ৩৮০০ মেগাওয়াট। কিন্তু দৈনিক ২৮০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ পাচ্ছে না পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনে থাকা ৭২টি সমিতি। প্রায় ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা কোন কোন এলাকায় বিদ্যুৎ অফিস ভাঙচুরসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন।
বিদ্যুৎ বিভাগের দেয়া তথ্য অনুসারে, গত শুক্রবার দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ৬৫০০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৭১০০ মেগাওয়াট। অথচ উৎপাদন ঘাটতি ছিল ৬০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে এ দিন লোডশেডিং না থাকলেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। পিডিবি সূত্র জানায়, গ্যাসের অভাবে প্রধানত বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্কট বেশি চট্টগ্রাম, সিদ্ধিরগঞ্জ, হরিপুর এলাকায়। সাংগুর গ্যাসক্ষেত্র বন্ধ থাকায় এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রামে গ্যাসের অভাবেই দৈনিক ৩শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। যদিও এখানে ৬শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। লোডশেডিংয়ের বিষয়ে পিডিবির কর্মকর্তারা বলেন, প্রায় সব সারকারখানা চালু করা হয়েছে। ফলে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বিদ্যুতের বাড়তি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিমাত্রায় গরম, সাব-স্টেশন ও অতিরিক্ত সংযোগের কারণে পল্লী এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে প্রায় সব সারখানা চালু করার কারণে গ্যাসের প্রাপ্যতা কমে গেছে। গ্যাস সরবরাহের অভাবে দৈনিক ১০০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। এজন্য বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে এটা সাময়িক বলে তারা দাবি করেছেন। সূত্র জানায়, দেশে মোট বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা এক কোটি ৫৭ লাখ। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ২৯ লাখ, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীন গ্রাহক সংখ্যা এক কোটি ৩ লাখ, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) অধীন ৯ লাখ, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ৬ লাখ এবং ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের অধীন ৮ লাখ। দেশের বিভিন্ন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, দিনের প্রায় বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে না। লক্ষ্মীপুর শহর ছাড়া জেলার বাকি সব এলাকায় বেশির ভাগ সময়ে বিদ্যুৎ থাকে না। ২০ থেকে ২৫ মিনিট পরপর লোডশেডিং হয়। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইদানীং ঈদুল আজহার আগের দিন থেকে চরম লোডশেডিং মুখে পড়ে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার প্রতিটি গ্রামে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে। প্রায় প্রতিটি রাতের চিত্র এমনই। গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় রামগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসে সামনের সড়কে উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়ে নাগরিক কমিটির ব্যানারে শ’ শ’ স্থানীয় এলাকাবাসী নিয়ে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। পরে মিছিল নিয়ে বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাওকালে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ফাঁকা গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে প্রায় ২০ জন আহত হয়। একই দিন রাতে লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়কের বাসাবাড়ি থেকে রাখালিয়া পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় গাছ ফেলে ও টায়ার  জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখে বিক্ষুব্ধ বিদ্যুৎ গ্রাহকরা।
শনিবার গ্রিড লাইনে ত্রুটির কারণে রাজশাহীর সর্বত্র বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় পুরো রাজশাহী অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শনিবার বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে রাজশাহী কাটাখালী পাওয়ার পয়েন্টের (বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র) বিদ্যুতের গ্রিড লাইন বিকল হয়ে পড়ে। এতে রাজশাহীর চারঘাট, কাটাখালী, বানেশ্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও মহানগরীসহ সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মাছিহাতা ইউনিয়নের পাঘাচং গ্রামে দিন-রাতে ৫-৭ বার বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়। প্রতিবারই এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। দীর্ঘদিন ধরেই এ অবস্থা চলছে বলে জানান, ওই গ্রামের মানুষ। কখনও কখনও রাতে  বিদ্যুৎ চলে গেলে আর আসেই না। পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন এই গ্রাম। আশপাশের গ্রামের অবস্থাও একই। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আধা দিনই বিদ্যুৎ থাকতো না নবীনগর উপজেলার বড়াইল ইউনিয়নের জালশুকা গ্রামে। এটি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন একটি এলাকা। গ্রামের আশরাফুল হক রিজেন ও রিয়াজুল হক রিতু জানান, মাস খানেক আগে এলাকার বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ছিল খুবই খারাপ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৬-৭ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ মিলেনি তাদের। জেলা শহরের পুনিয়াউট এলাকাটি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিতরণ বিভাগের অফিসের পাশেই। এই এলাকায় দিন কয়েক আগে দিনে ১৫-২০ বার লোডশেডিং হয়েছে। এখন সেভাবে না হলেও দিনে দু’-একবার বিদ্যুৎ বন্ধ থাকছে বলে জানান, ওই এলাকার বাসিন্দারা। এমন পরিস্থিতি ছিল সারা শহরেই।
গত দুই মাসে দেশে কমপক্ষে ৩০টি জেলায় বিদ্যুতের দাবিতে অফিসে হামলা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ কর্মীদের মারধর ও বিদ্যুতের গাড়িতে আগুনও দেয়া হয়েছে। বিদ্যুতের দাবিতে সমপ্রতি ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের লৌহজং উপজেলার মাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় অবরোধ হয়েছে। গাজীপুরে ৩-৪ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সূত্র জানায়, গাজীপুর গ্রিডের জন্য বিদ্যুতের মোট চাহিদা রয়েছে পিক আওয়ারে ১৩০ মেগাওয়াট এবং অফপিক আওয়ারে ১১০ মেগাওয়াট। অথচ চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ পাওয়া যায় মাত্র ২৫ থেকে ৩৫ মেগাওয়াট। প্রতিদিন গড়ে ১০-১৫ ঘণ্টা লোডশেডিং হয় এবং কখনও কখনও ২৪ ঘণ্টায় ৭-৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। বিদ্যুতের দাবিতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চান্দুরার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে সমপ্রতি এলাকাবাসী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এ সময় উত্তেজিত জনতা পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও লোডশেডিং বন্ধের দাবিতে গত মাসে চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে নগর বিএনপি। একই দাবিতে ঝিনাইদহে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় ভাঙচুর করেছে এলাকাবাসী। বর্তমানে চট্টগ্রামবাসী পাচ্ছেন মাত্র ৫০০ থেকে ৫৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অথচ চট্টগ্রামের বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট।
বিদ্যুতের দাবিতে খোদ গোপালগঞ্জেও পল্লী বিদ্যুৎ অফিস ও মহাব্যবস্থাপকের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায়ও সমপ্রতি বিদ্যুতের দাবিতে প্রায় ৬ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে স্থানীয় জনতা। এ সময় তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ উপকেন্দ্রের একটি টিনশেডের ঘর ভাঙচুর করে।

No comments

Powered by Blogger.