সৌদি আরবে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে বিদেশী শ্রমিক

সৌদি আরবে নিয়োজিত বিদেশী শ্রমিকদের সঙ্গে ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করেন অনেক নিয়োগকর্তা। তারা শ্রমিকদের স্বাধীনতার বিষয়ে তোয়াক্কা করেন না। তাদেরকে নিজের ইচ্ছেমতো দেশে ফিরতে দেন না। কিছু নিয়োগকর্তা কেন এমনটা করেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মক্কার সালেহ জায়েদ। এ নিয়ে গত শুক্রবার তিনি একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। এর শিরোনাম ‘হোয়াই ডু সাম সৌদিস ট্রিট এক্সপ্যাট ওয়ার্কার্স লাইক স্লেভস?’। উল্লেখ্য, সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন বেশ কয়েক লাখ বাংলাদেশী। সালেহ জায়েদ যাদের বিষয়ে লিখেছেন তার মধ্যে এসব শ্রমিকও পড়েন। বাংলাদেশী এ সব শ্রমিকের মধ্যে আবার অনেকে গৃহপরিচারিকা। তারাও এমন আচরণের শিকার হন। মাঝে মাঝেই খবর পাওয়া যায় নারী পরিচারিকাদের ওপর গৃহকর্তার নৃশংস শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা। ওই প্রতিবেদনে জায়েদ লিখেছেন, শ্রমিকদের সঙ্গে অশোভন আচরণের বিষয়টি বিস্ময়কর মনে হতে পারে, কিন্তু এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে সৌদি আরবে। উত্তরাঞ্চলের শহর হেইলে এক শ্রমিককে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সৌদি আরবে আটকে রেখেছিল তার নিয়োগকর্তা। তারপরই সম্প্রতি রিয়াদে সে রকমই এক ঘটনার খবর জানতে পেরেছে কর্তৃপক্ষ। সালেহ জায়েদ তার প্রতিবেদনে লিখেছেন- আমি বিস্ময়কর শব্দটি ব্যবহার করেছি। এর কারণ আছে। কারণটি হলো, কেউ প্রত্যাশা করে না যে ইসলামের সূতিকাগার সৌদি আরবে এমন ঘটনা ঘটুক। এই সৌদি আরব আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের বা রীতিনীতি অনুসরণের জন্য আইন অনেকটা উন্নত করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও’র একটি সক্রিয় সদস্য সৌদি আরব। মানবাধিকার নিয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে যে চুক্তিগুলো আছে তা মেনে নিয়েছে এ দেশ। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, মিডিয়া ও জনজীবনের উন্নতি সত্ত্বেও বিদেশী শ্রমিকদের সঙ্গে এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা অবিশ্বাস্য। সর্বশেষ এমন এক বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছে ভারতীয় গৃহপরিচারিকা নাজমুমের সঙ্গে। তিনি সৌদি আরবে গিয়েছেন ১৯৯৮ সালে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরের আগে পর্যন্ত দেশে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ছিল তার যোগাযোগ। সৌদি আরবে পৌঁছার চার বছর পরে ২০০২ সালে সৌদি আরবে তার সন্ধান শুরু করে তার পরিবার। এ পরিবারটির বসবাস তামিলনাড়ু রাজ্যে। তার নিখোঁজ হওয়ার খবর ভারতের একটি স্থানীয় টেলিভিশনে প্রচার করা হয়েছিল। এক পর্যায়ে এ বছরের শুরুর দিকে রিয়াদ থেকে শ্রীলঙ্কার এক গৃহকর্মী দেশে ফেরেন। তিনিই নাজমুমের পরিবারকে খবর জানান যে, তিনি নিখোঁজ নাজমুমকে রিয়াদে দেখেছেন। এ খবর পেয়ে ভারতীয় দূতাবাসের সহায়তায় তার ছেলে ও এক ভাই রিয়াদ যান তার সন্ধানে। কষ্টকর অনুসন্ধানের পর তারা নাজমুমকে খুঁজে পেতে সক্ষম হন। সেখানে দেখা যায়, কোন বেতন ছাড়াই ১৬ বছর ধরে তার স্পন্সরের জন্য কাজ করছেন।
 একই রকম আরেকটি করুণ কাহিনী প্রকাশ পায় ২০১২ সালের মার্চে। সেখানে মরুভূমিতে ভেড়া চড়ানোর জন্য হেইল এলাকায় নিয়োজিত ছিলেন এক ভারতীয় শ্রমিক। তার স্পন্সর তাকে ওই এলাকায় আটকে রেখে কাজ করতে বাধ্য করে ১৮ বছর। এ বিষয়টি ভারতীয় অন্য শ্রমিকদের নজরে পড়ায় তারা বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানান। তারা বলেন, ওই শ্রমিক অনেকবার পালানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই তাকে ফিরিয়ে নিয়েছে তার নিয়োগকারীরা। তাদের ভয় ছিল, যদি তিনি মুক্ত হন তাহলে সব কথা ফাঁস করে দিয়ে তাদের ওপর প্রতিশোধ নেবেন। তাই তারা তার ওপর প্রতিশোধ নিতে আটকে রাখে। ওই শ্রমিক মরুভূমিতে অবর্ণনীয় অবস্থায় ভেড়া চড়াতেন। এমনকি পানির পিপাসায় তিনি মারা যাওয়ার মতো অবস্থায় পড়েছিলেন অনেকবার। ওই শ্রমিককে পরে পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে। এরপর তিনি বলেন, তিনি কখনও ভাবেননি যে, তার স্পন্সরকে হত্যা করে নিজে মুক্ত হবেন। তবে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তিনি অনেকবার আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছেন। পুলিশ তাকে উদ্ধার করার পর তার প্রথম কথা ছিল, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি দেশে ফিরতে চাই। এই দু’টি ঘটনায় নিয়োগকারী ও শ্রমিকের মধ্যে যে সম্পর্ক দেখা যায় তা নিয়োগের যে শর্ত তার চরম ব্যত্যয়। এটা যে কোন মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এটা দমনমূলক ও দাসত্বের মতো সম্পর্ক। কোন অধিকারে এসব নিয়োগকর্তা তাদের অধীনস্থ কর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন? তাদের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেছেন? শপুর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করানো হয়- এমন আচরণ করার এক্তিয়ার তাদের কে দিয়েছে? এই দু’স্পন্সরকে কঠিন শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাদের মাসিক বেতন দেয়াতে হবে। এই দু’সৌদি স্পন্সর যে অপরাধ সংঘটিত করেছেন তার দায় এ সমাজের ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কারণ, তারা দু’শ্রমিককে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে স্পন্সর ও শ্রমিক সম্পর্কে ডাটা সংরক্ষিত রাখার জন্য ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা থাকা উচিত। এই ডাটা দেখে পরিষ্কার হয়ে যাবে কখন একজন শ্রমিকের নিয়োগের চুক্তি ও তার ইকামা নবায়ন করতে হবে। কখন তাদের বার্ষিক ছুটির সময়। জায়েদ লিখেছেন, স্পন্সরের খেয়ালখুশির ওপর বিদেশী শ্রমিকদের ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না আমাদের। আমাদের উচিত তাদের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা।

No comments

Powered by Blogger.