হরতালে হরতালে অতিষ্ঠ রোজাদার ও ব্যবসায়ীরা by রাজীব আহমেদ ও এম সায়েম টিপু

সময় কাটার কথা ছিল চূড়ান্ত ব্যস্ততায়। দোকানে পণ্য তোলা, ক্রেতাকে দেখানো, দামে মিললে বিক্রি করে টাকা বুঝে নেওয়া- অন্তত রোজার এক মাসে দিনভর ফুরসত মেলার কথা নয় দোকানকর্মীদের।
কিন্তু গত তিন দিনের চিত্র একদম ভিন্ন। দোকান খোলা থাকলেও ক্রেতাদের দেখা মেলেনি রাজধানীর শপিং মলগুলোতে। ফলে ঈদবাজারে ক্রেতাদের ভিড় সামলাতে বাড়তি কর্মী নিয়োগ দিয়ে অলস সময় কাটিয়েছেন দোকান মালিকরা। আজও দিন কাটবে আলসেমিতে। কারণ আজও হরতাল।
বছরজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা আর হরতালের পর ঈদবাজারে বাড়তি বিক্রি করে সারা বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশায় ছিলেন খুচরা দোকান মালিকরা। তবে সে আশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিয়েছে জামায়াত। মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের দুই নেতার রায় ঘিরে চার দিন খুচরা দোকান মালিকদের রুটি-রুজির পথ বন্ধ করে করে দিয়েছে তারা।
গত সোমবার ছিল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের দিন। ওই দিন হরতাল পালন করে জামায়াত। পরের দিন গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ফাঁসি না হওয়ায় গণজাগরণ মঞ্চ থেকে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। একই দিন হরতাল পালন করে জামায়াত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গতকাল বুধবার জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মামলার রায়ের দিন ঠিক করেন। গতকালও জামায়াত হরতাল পালন করে। গতকাল বিকেলে মুজাহিদের ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবারও হরতালের ডাক দেয় জামায়াত।
হরতাল পালনের ধরনও পাল্টেছে। যা মানুষকে আগের চেয়ে বেশি আতঙ্কিত করেছে। হঠাৎ হামলা চালিয়ে গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, মানুষকে জখম করা, শান্ত রাস্তায় অতর্কিত ককটেল হামলা, পণ্যবাহী গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাগুলো বাংলাদেশে নতুন। তাই ঢিলেঢালা হরতালেও কখন কী হয় সেই ভয়ে রাস্তায় বের হতে ভয় পাচ্ছে মানুষ।
টানা হরতাল রোজার মধ্যে নানা ধরনের দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে সাধারণের জীবনে। ঈদের মাসে তাদের আয়ের পথ যেমন বন্ধ হয়েছে, তেমনি রোজাদারদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। হরতাল হলেও অফিস কামাই দেওয়ার সুযোগ নেই সরকারি কর্মচারীদের। পাশাপাশি ঈদের বাজারে কোনো কর্মীকেই অফিসে আসা থেকে ছাড় দিতে নারাজ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু রাস্তায় পর্যাপ্ত পরিবহন নেই। ফলে বাসে ঝুলে অনেক রোজাদারকে অফিসে যেতে দেখা গেছে। দিন শেষে তৃষ্ণার্ত রোজাদারদের পরিবহন পেতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে রাস্তায়। গরমে বাসের ভেতরে গাদাগাদি করে ফিরতে হয়েছে বাসায়।
গতকাল দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেটে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মধ্যবয়সী নারী হালিমা খাতুন। ফার্মগেটের একটি কোচিং সেন্টারে অফিস সহকারীর কাজ করেন তিনি। ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকেও মিরপুরগামী বাসে উঠতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ পরপর বাস এলেও তাতে ওঠার উপায় নেই। দৌড়ে বাসের সামনে গিয়ে বারবার দরজা থেকে ফেরত আসতে হচ্ছিল তাঁকে। তিনি বলেন, মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বাসায় যেতে বাসই একমাত্র ভরসা। কিন্তু বাসে সিট তো দূরের কথা, ওঠারই উপায় নেই। ১২০-১৫০ টাকা রিকশাভাড়া দিয়েও তাঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।
উপায়হীন, অসহায় ভঙ্গিতে হালিমা খাতুন বলেন, 'এখন দিন বড়। ১৫ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হয়। তার মধ্যে এত কষ্ট করা যায় না।'
সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে পরিবহন খাতের শ্রমিকরা। মাস শেষে তাদের কোনো বেতন নেই, কাজ করলে আয়, নইলে নেই। চার দিন কাজ করতে না পেরে বড় অঙ্কের লোকসান হয়েছে তাদের। শহরের ভেতরে কিছু বাস চললেও দূরপাল্লার গাড়ি টার্মিনাল ছেড়ে যায়নি। গাবতলী বাস টার্মিনালের বলাকা পরিবহনের একজন কর্মী বলে, এক দিন কাজ করলে তার বেতন ৩৫০ টাকা। এর ওপর উপরি হিসেবে আরো শ দুয়েক টাকা হয়। কিন্তু হরতালের দিন আসে না এক টাকাও। চার দিনে প্রায় দুই হাজার টাকার লোকসান হয়েছে তার।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে উৎসব উপলক্ষে কত টাকার কেনাবেচা হয় তার হিসাব থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের হিসাব তৈরি করছে না পরিসংখ্যান ব্যুরো। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির মতে, সাধারণ সময়ে দেশে খুচরা ও পাইকারি দোকানে দৈনিক প্রায় ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু ঈদবাজারে তা চার গুণ বেড়ে যায়। অবশ্য সোমবার থেকে আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বেচাবিক্রি ছিল তলানিতে।
মিরপুর বেনারসি পল্লীর হানিফ সিল্কের মালিক মো. হানিফ কালের কণ্ঠকে জানান, এবারের ঈদ উপলক্ষে তাঁর দোকানে বাড়তি কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভালো কেনাবেচার আশায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগও করেছেন তিনি। কিন্তু পরিস্থিতি মোটেও সুখকর নয়। ঈদের কেনাকাটার শুরু থেকেই বেচাবিক্রি ভালো ছিল না। হরতাল আরো ক্ষতি করছে।
মো. হানিফ জানান, ঈদ মৌসুমে সাধারণভাবে দৈনিক দুই-আড়াই লাখ টাকার কেনাবেচা হয় দোকানে। হরতালের তিন দিন দোকান খুলে রেখেও লাভ হয়নি।'
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির মহাসচিব এস এম কাদের কিরণ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এক দিন হরতাল হলে মূলত তিন দিন নষ্ট হয়। হরতালের আগের দিন অতর্কিত হামলা আর ককটেলবাজিতে মানুষ ঘর থেকে বের হতে চায় না। হরতালের পরের দিন থাকে প্রচণ্ড যানজট। হরতালের দিনও ভয়ে মানুষ বের হয় না।'
কাদের কিরণ জানান, দোকান মালিকরা গত তিন দিনের হরতালের মতো আজকের হরতালও প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রতিদিনই দোকানপাট খোলা ছিল। কিন্তু ক্রেতা মেলেনি। ফলে সারা বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ মিলছে না।
গতকাল রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকা, বসুন্ধরা সিটি, মিরপুর বেনারসি পল্লী, মৌচাকসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শপিং মল ও দোকানপাট খোলা, কিন্তু ক্রেতার অভাব। বিক্রেতারা জানান, এবার রোজার কিছুটা আগে থেকেই ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ব্যবসা ভালো হতো।
শান্তিনগর টু ইন টাওয়ারের কিউ জি ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ড ম্যানেজার আহমেদ বিন আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের মাসে প্রচুর খরচ। বেতন-বোনাসসহ প্রায় তিন মাসের খরচ দিতে হয় কর্মচারীদের। পাশাপাশি প্রায় ৮০ শতাংশ বিনিয়োগই ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে করতে হয়। তাই টানা হরতালে তাঁদের বিক্রি কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। তিনি ঈদের আগে কর্মচারীদের বেতন-বোনাস দেওয়া নিয়ে শঙ্কিত।
লোকসান শুধু বিক্রেতাদের নয়, ক্রেতাদের ভোগান্তিও চরমে। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজনের পোশাক কিনে দিতে তাদের অপেক্ষায় দিন গুনতে হচ্ছে। কাল শুক্রবার তাদের অপেক্ষা আপাতত শেষ হচ্ছে। কিন্তু ওই দিন মার্কেটকেন্দ্রিক প্রচণ্ড যানজট, ভিড় আর পরিবহন সংকটে ভুগতে হবে নগরবাসীকে।
এফবিসিসিআই সহসভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, 'রমজান সামনে রেখে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, পাইকারি ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়। এ সময় টানা হরতাল ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রচণ্ড হতাশা সৃষ্টি করেছে। আমাদের পক্ষ থেকে সরকার ও বিরোধী দলকে আইন করে হরতাল বন্ধ করার অনুরোধ করা হলেও কেউ তা কানে তোলেনি। সবাই এটাকে গণতান্ত্রিক অধিকার বলে এড়িয়ে গেছে।'
বাজারে মাছ-সবজি কিনতে গিয়েও দুর্গতি রোজাদারদের। বাজারে মাছ-সবজির দাম বেড়ে গেছে। কিছু পণ্যের আমদানি খরচ কমে যাওয়ায় দাম কমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাইকারি বাজার থেকে পণ্য খুচরা বাজারে ছড়িয়ে পড়ায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে হরতাল। এ কারণে ওইসব পণ্যের দাম কমছে না।
হরতালের কয়েক দিন মাছ কেজিপ্রতি ৫০-১০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। আর কয়েক ধরনের সবজির দাম কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে ক্রেতাদের। বিক্রেতারা এর জন্য হরতালের কারণে ট্রাক ভাড়া বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।
কারওয়ান বাজারকেন্দ্রিক ফড়িয়া ব্যবসায়ী আবদুর রহমান জানান, উত্তরাঞ্চল থেকে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে যে ট্রাক ঢাকায় আনা যেত, হরতালে সেই ভাড়া ২০ হাজার টাকার ওপরে উঠে যায়। গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ভয়ে মালিকরা ট্রাক রাস্তায় নামাতে চান না। কেউ কেউ রাজি হলেও ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। যে কারণে পণ্যের দামও বেশি পড়ছে।
ওই ব্যবসায়ী বলেন, মোকাম ও আড়তে বেগুন, কাঁচা মরিচ, শশাসহ সবজির দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু মানুষ কম দামে পাচ্ছে না হরতালের কারণে।

No comments

Powered by Blogger.