বলিউড ভাগ মিলখা ভাগ

১৯৪৭ সাল। দেশভাগের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জীবনের অন্তিমক্ষণে সিং পরিবার। মিলখা সিং-এর বয়স তখন মাত্র ১২ বছর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কিশোর মিলখার চোখের সামনেই মেরে ফেলা হলো বাবা-মা, ভাইবোনদের।
মারা যাওয়ার আগে বাবা শেষবার চিৎকার করে বললেন, ‘ভাগ, মিলখা ভাগ!’ জীবন বাঁচাতে মিলখা সেই যে দৌড় দিলেন, আর তাঁকে থামানো যায়নি। রুক্ষ প্রান্তর দিয়ে পেছনে টায়ার বেঁধে দৌড়াতে দৌড়াতে কৈশোর পেরিয়ে সেই শিখ যুবক একদিন পৌঁছেছেন অলিম্পিকের ট্র্যাকেও। হ্যাঁ, গল্পটা সেই মিলখা সিংয়ের। এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জেতা, অলিম্পিকে ইতিহাস তৈরি করা ভারতের জীবন্ত কিংবদন্তি অ্যাথলেট মিলখা সিং। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই অলিম্পিয়ানের জীবন নিয়েই মুক্তি পেল পরিচালক রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার নতুন ছবি। মৃত্যুপথযাত্রী বাবার অন্তিম সেই উক্তি দিয়েই ছবির নাম ভাগ মিলখা ভাগ।
প্রতিভাবানদের জীবনের গল্প সব সময় কি এমনই হয়? বারোতেই সব হারিয়েছেন। ঘর ছিল না। খাওয়াও জুটত না রোজ। ছোটখাটো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। ব্যর্থতার অতলে তলিয়ে গেছেন। তবে মিলখা সিংয়ের অদম্য লড়াই তাঁকে ব্যর্থতার অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে। রাস্তার রেস্তোরাঁর বয় থেকে ভারতীয় আর্মিতে, অতঃপর রেসের ট্র্যাকের ‘উড়ন্ত শিখ’। অনবদ্য এই ক্রীড়াপ্রতিভার জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সংগ্রাম আর অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প নিয়েই ছবিটি বানিয়েছেন রং দে বসন্তীখ্যাত নির্মাতা রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা। আর মিলখা সিং নিজের জীবনের এই অনন্য গল্প বিক্রি করেছেন মাত্র এক রুপির বিনিময়ে। মিলখা সিংয়ের জীবনের প্রায় সব ঘটনাই অবিকৃতভাবে ছবিতে রেখেছেন নির্মাতা।
ছবিতে মিলখা সিংয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন হালের মেধাবী চলচ্চিত্র পরিচালক, সেই সঙ্গে প্রযোজক, অভিনেতা ও গায়ক ফারহান আখতার। তবে ছবি শুরুর আগে পরিচালক প্রকাশ মেহরার রাতের ঘুম প্রায় হারাম হয়ে গিয়েছিল কাকে মিলখা সিং চরিত্রে নেবেন, ঠিক করতে না পেরে। ফারহান আখতারকে নেওয়ার পর পুরোপুরি টেনশনমুক্ত হয়েছিলেন গুণী এই চিত্রনির্মাতা। বলিউডের গতানুগতিক নায়কোচিত ইমেজের বাইরে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের চরিত্রে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হয়ে ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছেন ফারহান। চরিত্রটিকে দর্শকদের সামনে উপস্থাপনে ফারহান তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা কাজে লাগিয়ে সফল হবেন, তেমনই আস্থা ছিল প্রকাশ মেহরার। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তা-ই। মিলখা সিং চরিত্রটি পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে ফারহান নিজের চেহারাই পাল্টে ফেলেছেন। শারীরিক দিক দিয়ে, স্টাইলের দিক দিয়েও। মন প্রাণ ঢেলে শিখেছেন পাঞ্জাবি ভাষাও। ছবিতে সত্যিকারের একজন অ্যাথলেটই মনে হয়েছে ফারহানকে। দৌড়গুলোও ছিল জীবন্ত, মনে হয়নি সাজানো। ফারহান বলেন, ‘মিলখা সিং চরিত্রে অভিনয়ের মহা সুযোগ পেয়ে সম্মানিত বোধ করছি। প্রথম ছয় মাস নিজেকে শারীরিকভাবে তৈরি করেছি। যখন সকলে বলেছে, আমাকে স্ক্রিনে ফারহান কম আর মিলখা সিং বেশি মনে হচ্ছে, তখন খুব ভালো লেগেছে। এ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে ব্যক্তিগত আবেগ, অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি ঝেড়ে আমাকে একজন অন্য মানুষ হয়ে উঠতে হয়েছে। মিলখা সিংয়ের জীবন আমাদের অনেক কিছুতে শিক্ষা দেবে, উৎসাহিত করবে, অনুপ্রাণিত করবে, জীবনে কিছুই অসম্ভব নয়—তেমন অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তুলবে সবার মনে।’
ফারহান আখতারের অভিনয়ে মুগ্ধ মিলখা সিং স্বয়ং। ফারহানের অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ৭৭ বছর বয়সী মিলখা সিং বলেন, ‘ফারহানকে দেখে বোঝার উপাই নেই যে তিনি আসল মিলখা সিং নন। আমি কীভাবে দৌড়াতাম, দাঁড়াতাম—সব যেন হুবহু একই। যেন পর্দায় আমি নিজেকেই দেখছি! অসাধারণ কাজ করেছেন ফারহান। তাঁর অভিনয় আমাকে কাঁদিয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম আমাকে আশা জাগায়। আমি চাই, তারা এই ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হোক।’
অন্যদিকে মিলখা সিংয়ের স্ত্রী ও ভারতীয় ভলিবল দলের অধিনায়ক নির্মল কওরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সোনম কাপুর। প্রায় তিন ঘণ্টা লম্বা ছবিতে সোনম পর্দায় আছেন বড়জোর আধঘণ্টা। এত ছোট ভূমিকায় অভিনয় করলেও প্রশংসিত হয়েছে সাধারণ পোশাকে সোনমের অভিনয়। ছবির আরও একটি আকর্ষণ হচ্ছে শক্তিমান অভিনেতা প্রকাশ রাজ, যিনি প্রথম কোনো বলিউড ছবিতে পজিটিভ চরিত্রে অভিনয় করলেন। অন্যদিকে মিলখার কোচের ভূমিকায় ছিলেন ক্রিকেটার যুবরাজের বাবা যোগরাজ সিং। ছবিতে অধিকাংশ অভিনেতা-অভিনেত্রী বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। ফারহান আখতারও নামমাত্র পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। আর সোনম কাপুর তো নিয়েছেন মাত্র ১১ রুপি।
 সাজিদুল হক
জিনিউজ, ইন্ডিয়া টাইমস, বক্স অফিস ইন্ডিয়া, বলিউড হাঙ্গামা, মুম্বাই মিরর, উইকিপিডিয়া, আইএমডিবি অবলম্বনে

No comments

Powered by Blogger.