বেঁচে থাকলে খুশি হতেন তাঁরা by আজাদুর রহমান চন্দন

১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বেশি ছিল রাজধানী ঢাকায়। নগরীতে সেনাবাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল তো ছিলই, তার ওপর নগরবাসীর কাছে আরেক আতঙ্ক ছিল অবাঙালি বিহারিরা।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ভাষায়, 'প্রায় প্রায়ই গুজবের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে- মোহাম্মদপুর-মিরপুর থেকে বিহারিরা দলে দলে বেরিয়ে পড়ে এদিকপানে আসবে। একটা তাৎক্ষণিক হৈচৈ পড়ে যায় চারপাশে।' পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী, বিহারি আর স্থানীয় রাজাকার-আলবদরদের হাতে পুরোপুরি নজরবন্দি অবস্থায় ছিল ঢাকায় থেকে যাওয়া বাঙালিরা। এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ- রাত নামলেই ব্ল্যাকআউট, কারফিউ আর বাড়ির দরজায় আতঙ্কজনক কড়ানাড়া, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। এমন এক অবরুদ্ধ, অন্ধকার, আতঙ্কের নগরীতে একরাশ আলোর ঝলকানি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন একদল মুক্তিপাগল মেধাবী তরুণ বাঙালি। তাঁদের দলের নাম ছিল ক্র্যাক প্লাটুন। অনেকেই বলত 'বিচ্ছু বাহিনী'। বদি, রুমী, জুয়েল, স্বপন, কামাল, আজাদ, আলম, আলতাফ মাহমুদ... একঝাঁক উজ্জ্বল তারকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল সেই বিচ্ছু দল। তাঁদের কেউ নামকরা ছাত্র, কেউ সুরকার, কেউ খেলোয়াড়।
একাত্তরের আগস্টে ঢাকার বুকে একের পর এক গেরিলা অভিযান চালিয়ে হানাদার বাহিনীর বুকে রীতিমতো কাঁপন ধরিয়েছিল ওই বিচ্ছু বাহিনী। ৭ আগস্ট সন্ধ্যার পর ফার্মগেটে মিলিটারি চেকপোস্টে পৌনে তিন মিনিটের গেরিলা অপারেশনেই পাঁচ খানসেনা ও ছয় রাজাকার খতম। ওই অপারেশনে ছিলেন ছয় বিচ্ছু- বদিউল আলম বদি, হাবিবুল আলম, কামরুল হক স্বপন, জুয়েল, পুলু ও সামাদ (সম্ভবত তওহিদ সামাদ)। বিচ্ছুরা ১১ আগস্ট তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরেও বিস্ফোরণ ঘটান। ১৪ আগস্ট তাঁরা গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকার আকাশে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান অনেকগুলো। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বিচ্ছুদের। সে লক্ষ্যে ১৯ আগস্ট রাতে দুটি নৌকায় করে রেকি করতে গিয়েছিলেন কাজী কামাল, বদি, জুয়েল, রুমীসহ (শাফী ইমাম) কয়েকজন। সামনের নৌকায় ছিলেন কাজী, বদি ও জুয়েল। পাওয়ার স্টেশনের আশপাশ দেখার সময় তাঁরা পড়ে যান সেনাদের একটি নৌকার সামনে। পূর্বনির্দেশনা অনুযায়ী অন্যদের স্টেনগান নৌকার পাটাতনে লুকানো থাকলেও বদি তা রাখেননি। স্টেনগানটি ছিল তাঁর কোলের মধ্যে। সেনাদের দেখেই অস্ত্র তুলে ব্রাশফায়ার করে পুরো ম্যাগাজিন খালি করে দেন বদি। কয়েকজন সেনা গুলিতে মারা যায়, অন্যরা পানিতে ঝাঁপ দেয়। নৌকাটিও যায় উল্টে। বিচ্ছুদের সবচেয়ে বড় ও দুঃসাহসিক অভিযানটি ছিল ২৫ আগস্ট ধানমণ্ডি এলাকায়। দিনের আলোয় দুটি গাড়িতে করে অভিযানে নেমে তাঁরা ধানমণ্ডি ২০ নম্বর রোডে কাউকে না পেয়ে ১৮ নম্বরে গিয়ে আট সেনাকে খতম করেন। অভিযান শেষে ফেরার পথে ৫ নম্বর রোডের মুখে সেনা কর্ডনে পড়েও সব কজনকে খতম করে নিরাপদে আস্তানায় ফেরেন তাঁরা।
ধানমণ্ডি অপারেশনের কয়েক দিন পরই ঢাকার বেশির ভাগ গেরিলাকে আটক করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিছু স্থানীয় বিশ্বাসঘাতক দালালের সহায়তায়।
প্রথমে ধরা পড়েন বদিউল আলম। তাঁর এক বন্ধু ছিলেন ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষের ছেলে। ওই বন্ধুর বাসায় ছিলেন বদি। কিন্তু বন্ধুটি গোপনে খবর জানিয়ে দেয় আর্মিকে। ফলে ২৯ আগস্ট দুপুরের দিকে ওই বাসা থেকেই বদিকে ধরে নিয়ে যায় সেনারা। এরপর দুই দিনের মধ্যে একে একে ধরা পড়েন শাফী ইমাম রুমী, আবুল বারক আলভী (শিল্পী), আলতাফ মাহমুদ (সুরকার), জুয়েল (ক্রিকেটার), হাফিজ, চুন্নু, বেলায়েত, জহির উদ্দিন জালালসহ অনেকেই। রুমীর বাবা শরীফুল আলম ইমাম ও ভাই জামীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে তাঁরা ছাড়া পান। কিন্তু আর ফেরেননি বদি, রুমী, জুয়েল, আলতাফ মাহমুদসহ অনেকেই। তাঁদের লাশও ফেরত পাওয়া যায়নি। কবে কাকে হত্যা করা হয় সেই তারিখও নির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব হয়নি।
বদিউল আলমের সহযোদ্ধা মনু বন্দি ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাশাপাশি সেলে। ঘটনাচক্রে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। মনু জানান, সেনাদের নির্যাতনে বদির একটি হাতের জয়েন্ট খুলে যায় এবং হাড় ভেঙে ঝুলে গিয়েছিল। মনুরও পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
কিশোরগঞ্জের মরহুম আবদুল বারী ও রওশন আরা খানমের ছয় ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বদি। তাঁদের বাসা ঢাকার মনিপুরীপাড়ায়। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়। বদি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে স্টার মার্কসহ মাধ্যমিক এবং মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করে। ১৯৭১ সালের মার্চেই তিনি করাচি থেকে ঢাকায় ফেরেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অফিসার হিসেবে নিয়োগপত্র হাতে পান, কিন্তু যোগ দেননি। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে মনস্থির করেন। শুরুতে মা রওশন আরা খানম কিছুটা আপত্তি করেছিলেন। তখন বাবা আবদুল বারী সাহেব তাঁকে বলেন, 'তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিয়েই দিলে।' বদির মা আর আপত্তি করেননি। মেধাবী ছাত্র বদি অল্পদিনের মধ্যে হয়ে ওঠেন পাকিস্তান বাহিনীর আতঙ্ক। তাদের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় নাম ওঠে বদির। তাঁদের ঢাকার বাসাটি গোলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বাড়িও।
দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ সালে সরকার শহীদ বদিউল আলমকে বীরবিক্রম খেতাব দেয়। শহীদজননী রওশন আরার এটুকুই সান্ত্বনা। মনিপুরীপাড়ার বাসিন্দাদের দাবি ছিল- এলাকার প্রধান সড়কটি বদির নামে নামকরণ করার। দাবি পূরণ হয়নি। বদির বাবার একমাত্র চাওয়া ছিল গ্রামের জীর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নাম তাঁর শহীদ সন্তানের নামে রাখার। বিনিময়ে বিদ্যালয়টি সংস্কার করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর চাওয়াও অপূর্ণ থেকে যায় আইনি জটিলতায়। মা রওশন আরার একটি প্লট ছিল বর্তমান সোনারগাঁও হোটেলের পশ্চিমাংশে। জায়গাটি সরকার অধিগ্রহণ করলেও বিনিময়ে রওশন আরা কিছুই পাননি। এরশাদের আমলে একবার শহীদজননী হিসেবে রওশন আরাকে ডিআইটির একটি মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দিতে চেয়েছিল সরকার। রওশন আরা এতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, 'ছেলেকে দিয়েছি দেশের জন্য। ছেলের বিনিময়ে কিছু চাই না। নিজের জমির বিনিময়ে জমি পেলে তাতেই ছেলের নামে কিছু করব।' রওশন আরা সেই জমিও পাননি, ছেলের নামে কিছু করাও হয়ে ওঠেনি। অবশেষে ২০০৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন এই শহীদজননী। এত বছর পর তাঁর ছেলে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত একজনের সাজা হয়েছে বিচারে। রওশন আরা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন এ খবর শুনে।
শহীদ শাফী ইমাম রুমীর কথা জানেন অনেকেই। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী। শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হন। সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে শহীদ হওয়ায় বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়া আর হয়ে ওঠেনি। মা জাহানারা ইমাম নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিচার তিনি দেখে যেতে পারেননি। উল্টো তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জড়ায় তখনকার বিএনপি সরকার। সে অবস্থায়ই তিনি ইন্তেকাল করেন ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন।
হানাদার বাহিনীর প্রধান দোসর রাজাকার-আলবদর শিরোমণি গোলাম আযমের মানবতাবিরোধী অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল গত সোমবার। তবে বয়সের কারণে দয়া দেখিয়ে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। জাহানারা ইমাম বেঁচে থাকলে এ রায় শুনে ব্যথিত হতেন এবং গর্জে উঠতেন স্বাভাবিকভাবেই। তবে নিজের সন্তান হত্যায় জড়িত একজন হিসেবে আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের সাজা হওয়ায় শহীদজননী খুশি হতেন বলেই মনে হয়। যদিও রুমী, বদি, জুয়েল, আলতাফ মাহমুদদের নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি, দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে অন্য একাধিক অভিযোগে এই আলবদর প্রধান ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.