গাজীপুরে আজ ‘জাতীয়’ নির্বাচন by শরিফুল হাসান ও মাসুদ রানা

জাতীয় নির্বাচন বলতে যা বোঝায় তার সবই আছে। শুধু নেই নৌকা আর ধানের শীষ প্রতীক। এর বদলে আছে দোয়াত-কলম আর টেলিভিশন।
প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব ও নাটকীয়তা, জোট-মহাজোটের পাল্টাপাল্টি দোষারোপের রাজনীতি,
এরশাদকে নিয়ে সেই পুরোনো টানাহেঁচড়া, কেন্দ্রীয় নেতাদের অবিরাম দৌড়ঝাঁপ—সবকিছু মিলিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়ে উঠেছে ‘জাতীয়’ এক নির্বাচন।
আজকের এই ভোটাভুটির দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশের মানুষ। কারণ, আজকের ফল বলে দিতে পারে আগামী জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি। গত ১৫ জুন অনুষ্ঠিত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও এ রকম আবহ তৈরি হয়েছিল। এ নির্বাচনে অবশ্য সরকারি দলের চার মেয়র প্রার্থীই পরাজিত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, চার সিটির নির্বাচনের ফল দলের নেতা-কর্মীদের দারুণভাবে হতাশ করেছে। তবে আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে পরিচিত গাজীপুরে এ রকম ফল তাঁরা আশা করেন না। এখানে জয় ছাড়া অন্য কিছু তাঁরা ভাবছেন না। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপি বলছে, এই নির্বাচনেও জয়ী হয়ে তারা প্রমাণ করতে চায়, এ সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা নেই।
নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এই নির্বাচনে ভোটার ১০ লাখ ২৬ হাজার ৯৩৯। ৩৯২টি কেন্দ্রে আজ সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং এজেন্ট মিলিয়ে প্রায় আট হাজার কর্মকর্তা নির্বাচনের কাজে যুক্ত আছেন। আর র্যাব-পুলিশ-বিজিবি-আনসারসহ সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়ে ১১ হাজার সদস্য থাকবেন নিরাপত্তার দায়িত্বে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হয় গত ৭ জানুয়ারি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ২২ মে। তবে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ এখানে জয় পেতে দলের সর্বশক্তি কাজে লাগায়। একই ধারাবাহিকতায় মাঠে নামে বিএনপি। শুরু হয় দুই দল আর জোটের লড়াই।
আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক সাংসদ আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি সত্যি, যেকোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চেয়ে গাজীপুরে আমরা সর্বোচ্চ শ্রম দিয়েছি। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতারা এখানে এসেছেন। সারা দিন কাজ করেছেন। সব দেখে মনে হতে পারে, এটি জাতীয় কোনো নির্বাচন। তবে একটি বিষয় হলো, গাজীপুর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এখানে বিজয়ী হয়ে আমরা সারা দেশে একটা বার্তাই দিতে চাই, দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষেই আছে।’
গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বলেন, চার সিটির নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় জয়ী হওয়ার জন্য বিএনপি গাজীপুরের নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে নাটক: স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী মনোনায়ন নিয়ে দলের দ্বন্দ্ব এবং নাটকীয়তা যে জাতীয় নির্বাচনকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে, তার উদাহরণ গাজীপুর। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে সব দ্বন্দ্ব ভুলে এককভাবে প্রার্থী ঠিক করতে পারলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বেশ নাটকীয়তা লক্ষ করা যায়।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিল ১৭ জুন। এর মাত্র দুই দিন আগে চার সিটিতে পরাজয়ের কারণে ক্ষমতাসীন দল হঠাৎ তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু ততক্ষণে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ বলে খ্যাত গাজীপুরে দলের প্রার্থী হয়ে গেছেন দুজন। টঙ্গীর সাবেক পৌর মেয়র আজমত উল্লা খান দলের সমর্থন পেলেও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আদালতের নির্দেশে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে টিকে ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। অতঃপর প্রার্থী সমস্যা নিরসনের জন্য ১৮ জুন নাটকীয়ভাবে জাহাঙ্গীরকে ঢাকায় তুলে নিয়ে যান ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের নেতারা ঘোষণা দেন, আজমত উল্লাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে গেছেন জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু জাহাঙ্গীরের নেতা-কর্মীরা তখনো নির্বাচনের মাঠে।
সমস্যা সমাধানে নানা দেনদরবারের পর ২৩ জুন জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুরে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। এরপর আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লার পক্ষে কাজ শুরু করেন তিনি।
জোটের রাজনীতি: জাতীয় নির্বাচনের মতোই জোটের রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে গাজীপুরে। ১৮ দলের শরিক জামায়াতে ইসলামী বরাবরের মতোই বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানকে সমর্থন দেন। তবে গোল বাধে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে। এরশাদকে নিয়ে শুরু হয় টানাহেঁচড়া। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়েছিলেন জাপার জেলা সভাপতি কাজী মাহমুদ হাসান। ১৭ জুন তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। এরপরই জাতীয় পার্টির সমর্থন পেতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই মরিয়া হয়ে ওঠে।
জাতীয় পার্টিকে পাশে রাখতে জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা এবং দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানসহ নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করে সমর্থন চান। কিন্তু এরশাদ তখনো সমর্থন ঘোষণা করেননি। ইতিমধ্যে জেলা জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে একটি বড় অংশ বিএনপির দিকে আরেকটি অংশ আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে ৩০ জুন এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান। দুই দিন পর বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানও দেখা করেন এরশাদের সঙ্গে। তিনি দুজনকেই দোয়া দেন। এরপর নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনে গত বৃহস্পতিবার এরশাদ মহাজোটের প্রার্থীকেই সমর্থন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, এবার গাজীপুরের স্থানীয় নির্বাচনে ‘স্বৈরাচারী’ এরশাদকে নিয়ে যেভাবে টানাটানি হলো, তাতে করে জাতীয় রাজনীতিতে তিনি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন। জাতীয় পার্টি ছাড়াও হেফাজতে ইসলামকে নিয়েও দুই দল টানাটানি করেছে।
কেন্দ্রীয় নেতাদের দৌড়ঝাঁপ: অতীতে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দুই দলের প্রভাবশালী এত নেতাকে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা যায়নি। চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ গাজীপুরে জয় পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নির্বাচনের সার্বিক দিক নিয়ে খোঁজখবর রাখা শুরু করেন। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানককে সার্বক্ষণিকভাবে খোঁজখবর নেওয়ার দায়িত্ব দেন। নির্বাচনী প্রচারণার জন্য গাজীপুরের ৫৭টি ওয়ার্ডে ৫৭ জন সাংসদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা পড়ে ছিলেন গাজীপুরে।
একই অবস্থা বিএনপিতে। খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেই গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে সার্বক্ষণিকভাবে নেতা-কর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় সব নেতা ও সাংসদ তাঁদের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নেমেছিলেন সর্বশক্তি দিয়ে। পাশাপাশি ছাত্রদল, যুববদলসহ বিএনপির সব অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরাও ছিলেন মাঠে।
রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি দুই দলের সংস্কৃতিকর্মী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ীরাও নির্বাচনী মাঠে ছিলেন।
গুরুত্ব পেয়েছে জাতীয় বিষয়: স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্থানীয় সমস্যাগুলো সেভাবে আলোচিত হয়নি। এর বদলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেমন দুই দল পরস্পরের বিরুদ্ধে বলে এখানেও তেমনটিই হয়েছে।
বিরোধী দল শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হল-মার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, মতিঝিলে হেফাজতের বিরুদ্ধে অভিযানসহ সরকারের ব্যর্থতার নানা দিক তুলে ধরে প্রচার করে। আর আওয়ামী লীগ তুলে ধরেছে গত সাড়ে চার বছরে তাদের সাফল্যের কথা। পাশাপাশি তারা বিএনপির অতীতের দুর্নীতি, তারেক-কোকোর দুর্নীতি, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছে।

No comments

Powered by Blogger.