সুশীল সমাজের নিরপেক্ষ অবস্থানই কাম্য by ইকতেদার আহমেদ

সুশীল সমাজকে বলা হয় জাতির বিবেক। দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নীতিবান, নাগরিক-অধিকার সচেতন, দেশ ও জনগণের স্বার্থে আপসহীন, সত্যবাদী, ন্যায়নিষ্ঠ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, সৎ ও সাহসী ব্যক্তির সমন্বয়ে সুশীল সমাজ গঠিত হয়ে থাকে। জাতির যে কোনো দুর্যোগে সুশীল সমাজ সর্বাগ্রে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে উদ্যোগী হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বিকশিত হতে না পারায় সুশীল সমাজ আজ ডান ও বাম ঘরানায় দ্বিধাবিভক্ত। কোনো সুশীল সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সরকার বা বিরোধী দলের লেজুড়বৃত্তি করলে তাকে আর সুশীল সমাজ বলা যায় না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের নিরপেক্ষ অবস্থান কাম্য। ডান ও বাম ঘরানার বাইরে আমাদের সুশীল সমাজের মধ্যে মধ্যবর্তী একটি ঘরানার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। বর্তমানে আমাদের সুশীল সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তি নিরপেক্ষ অবস্থান হারিয়ে সরকারি বা বিরোধী জোটের মতাদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন। এ ধরনের সম্পৃক্ততা সুশীল সমাজের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের মোটামুটি নিরপেক্ষ বলা গেলেও বর্তমানে তাদের সংখ্যা নগণ্য এবং ডান ও বাম ঘরানার সুশীল সমাজের প্রভাবে বলতে গেলে তারা অনেকটা কোণঠাসা। সুশীল সমাজের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যারা এনজিও’র সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতিটি এনজিও’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। আমাদের দেশে বর্তমানে দু’ধরনের এনজিও’র কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। এর একটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিত্বকারী এনজিও, অপরটি হচ্ছে দেশীয় চিন্তা-চেতনা ও ভাবধারাকে কাজে লাগিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত এনজিও। প্রথমোক্ত এনজিওগুলোর কার্যক্রমের শতভাগই বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট। অপরদিকে শেষোক্ত এনজিওগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে অনুদান প্রাপ্ত হয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি দেখা গেল, শতভাগ বিদেশী সাহায্যপুষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিত্বকারী একটি স্বনামধন্য এনজিও (যেটি দুর্নীতি নির্মূলের নামে সোচ্চার) স্ব অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে, এর কতিপয় কর্ণধার বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে মানববন্ধন, মতবিনিময় সভা ও সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের বিশেষ দলের মতাদর্শের আজ্ঞাবহে পরিণত করেছেন। ৫-৭ বছর আগে এ এনজিওটির কর্ণধার হিসেবে যারা ছিলেন, তাদের কেউ কখনও কোনো ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অংশীদার হয়ে মানববন্ধন, মতবিনিময় সভা ও সংবাদ সম্মেলন করতে দেখেননি। তাছাড়া তাদের সততা, একাগ্রতা, আন্তরিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, যোগ্যতা, দক্ষতা, নৈতিকতা, মানবতা, আদর্শবাদীতা প্রভৃতি ছিল প্রশ্নাতীত।
সুশীল সমাজের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যারা পেশাগতভাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী। সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলে তাদের অনেকে দেশের দুস্থ, নিপীড়িত, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কার্যক্রম যতটুকু না জনকল্যাণমুখী, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রচারমুখী। সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে সরকার থেকে তারা যে হারে কর রেয়াত নেন, তাদের এ কর রেয়াত না দিয়ে সরকার যদি নিজস্ব উদ্যোগে রেয়াত সংশ্লিষ্ট অর্থ ব্যয় করত, তাহলে সেটা আরও বেশি অর্থবহ হতো বলে দেশের সচেতন নাগরিকরা মনে করেন। এসব ব্যবসায়ীর অনেকে নিজ নামে অথবা নিজ পিতা-মাতা অথবা শ্বশুর-শাশুড়ি-আত্মীয়ের নামে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে নিজেকে দানশীল ও সমাজ হিতৈষী বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা ও উন্নয়ন ব্যয় সরকারি ও বিদেশী সাহায্য নির্ভর।
সুশীল সমাজের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যারা আইন পেশার সঙ্গে জড়িত এবং দেশের শীর্ষ আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃত। তাদের অনেকে শিক্ষা ও সেবামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু স্ব পেশার প্রতি অনুগত থেকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার নৈতিক দায়িত্ব ছিল, তা থেকে তারা আজ অনেক দূরে। তাদের বিপুল অর্থের বিনিময়ে সমাজের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্তদের আইনি সহায়তা দেয়ার চিত্র থেকেই এটা ফুটে ওঠে। অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধ্যাপনা ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে সম্পৃক্ত হতে দেখা যেত না। এখন তাদের এক বিরাট অংশ সরকারি ও বিরোধী দলের ছত্রছায়ায় থেকে নিজেদের অধ্যাপনা পেশাকে গৌণ বিবেচনায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাজ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। বর্তমানে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিম্নমুখী। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মানের ছাত্রছাত্রীর আগমন ঘটে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের মেধা বিকাশে মনোনিবেশ না করে শুধু ভালো ফলাফলের আশায় শিক্ষকদের অনুগামী হওয়ার ব্যাপারে বেশি সচেষ্ট থাকে। এতে করে লেখাপড়া না করেও তারা ভালো ফলাফল ঠিকই করে, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এলে দেখা যায় তারা শুধু নামেই ডিগ্রিধারী, মেধার মান ডিগ্রির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
চিকিৎসকরা মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে চিকিৎসা পেশায় আÍনিয়োগ করেন। শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসকদের বেশ কয়েকজন বছরে একবার নিজ এলাকায় চিকিৎসা শিবির করে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকেন। তবে কতিপয় চিকিৎসক নিয়মিত বিভিন্ন সমাজ গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে সুশীল সমাজের অংশ হিসেবে সুনামের ভাগিদার হলেও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় বিভিন্ন আর্থিক কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়ে পুরো চিকিৎসক সমাজকে বিব্রতকর অবস্থায় নিপতিত করেছেন। পদস্থ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা নিয়মিত টকশো, গোলটেবিল বৈঠক, মতবিনিময় সভা প্রভৃতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে যদিও নিজেদের সুশীল সমাজের সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট, কিন্তু তাদের দু’-একজনের অতীত খুঁজতে গিয়ে জানা যায় নানা আর্থিক অনিয়মে বিজড়িত হওয়াসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বন উজাড়ের চাঞ্চল্যকর কাহিনী।
সরকারের পদস্থ সচিব পদমর্যাদার যারা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের অবস্থান গড়ে তুলেছেন, তাদের দ’ু-একজনের চাকরিকালীন বিভিন্ন অনিয়ম বিষয়ে অবহিত হওয়ার পর অনেককেই বলতে শোনা গেছে, সরকারি পদে বহাল থাকাকালীন দেশকে কিছু দেয়ার পরিবর্তে তারা শুধু দুর্নীতিলব্ধ সম্পদ আহরণে মত্ত ছিলেন। আর তাই তাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা সমাজকে প্রতারণা করার শামিল। বরেণ্য প্রকৌশলী, স্থপতি ও কৃষিবিদদের কয়েকজন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সুপরিচিত। সমাজের সব ধরনের গণসংযোগ কার্যক্রমে তাদের সফল পদচারণা। কিন্তু যখন শোনা যায়, তাদের কেউ কেউ চাকরিরত অবস্থায় নির্ধারিত অংকের সম্মানী দ্বারা সন্তুষ্টি ব্যতিরেকে ঠিকাদারের বিলে স্বাক্ষর করতেন না, তখন তাদের অতীত আচরণ তাদের সহকর্মীদের লজ্জায় ফেলে দেয়।
স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কর্মকর্তা বিরল এমন একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদধারী যদি অবসর পরবর্তী সুশীল সমাজের একজন হিসেবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভাব দেখান, তবে তা সাধারণ্যে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, এটা নিজ ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে মোটেও সহায়ক নয়। বর্তমানে সুশীল সমাজের মধ্যে বিভিন্ন পেশাধারী এমন অনেক আছেন, যারা নিজ গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার আকাক্সক্ষায় প্রথমত সুশীল সমাজের অতঃপর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আবরণে ভূষিত হওয়াকে কৌশল হিসেবে বেছে নিয়ে অনেকটা সফলতাও পেয়েছেন। আমাদের সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, লেখক ও কলামিস্টদের অনেকে সুশীল সমাজের খাতায় নাম লিখিয়ে দিব্যি নিজ ব্যক্তিত্ব, বিবেক ও মননশীলতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক জোটের যে কোনো একটির প্রতি অনুগত অবস্থানে তাদের নিয়ে গেছেন। মূলত দেশ ও সমাজ গঠনে সুশীল সমাজের যে ভূমিকা থাকা উচিত, তাদের কেউ এর ধারে-কাছেও নেই। তাদের একপেশে মনোভাবের কারণে জাতি আজ সংবাদ উপস্থাপন, বুদ্ধিভিত্তিক সাহিত্য চর্চা, লেখনী ও কলামে বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে পক্ষপাতদুষ্টতার প্রভাব অবলোকন করছে। আমাদের সমাজে বর্তমানে রাজনীতি প্রতিটি শ্রেণী ও পেশার মধ্যে এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে দলীয় রাজনীতির প্রতি অনুগত না হলে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা, সততা সবকিছুই অর্থহীন। বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মধ্যে রাজনীতির এ করালগ্রাসী থাবার কারণে এমন অনেকে আছেন যারা ন্যায্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন ভেবে বাম বা ডান ঘরানার পেশাজীবী হিসেবে সুশীল সমাজের মধ্যে আÍপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। এভাবে বিভিন্ন পেশাজীবী দুটি বিশেষ ঘরানার সুশীল সমাজ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কারণে তারা একদিকে যেমন নিজেদের পেশাদারিত্ব হারিয়েছেন, অন্যদিকে নিজ প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করে এর ঐতিহ্য ও সুনামের প্রতি কালিমা লেপন করেছেন।
কয়েক বছর পর আমরা যখন আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব, এর প্রাক্কালে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আমাদের সুশীল সমাজ কি দেশের প্রয়োজনে নিজ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ অবস্থান অথবা মধ্যপন্থা ধরে রাখতে পেরেছেন? অতি সম্প্রতি ডান ও বাম ঘরানার সুশীল সমাজ নামধারী কতিপয় ব্যক্তি আমাদের বড় দুই রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরে নিজেদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব উপস্থিতি ঘটানোর ব্যাপারে সচেষ্ট হয়েছিলেন। বছরব্যাপী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের বর্তমান বিবদমান পরিস্থিতিতে তারাই একমাত্র বিকল্প হিসেবে বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দলের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন- এমন অভিনব চিন্তা-চেতনা নিয়ে জনগণের সামনে উপস্থিত হলেও তাদের এ উদ্যোগের সফলতা পেয়েছেন কি-না তা বোধগম্য নয়। সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি সরকারের বিতর্কিত রাজনৈতিক কর্মসূচির স্বপক্ষে কথা বলার পর তিনি কি নিজেকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ভাবতে পারেন? এটি আজ একটি মৌলিক প্রশ্ন। অনুরূপ বক্তব্য দেশের প্রধান বিরোধী দলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে সুশীল সমাজ গণতন্ত্র বিকাশ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। সে কারণেই ভারতে আজ গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। আমরা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমৃদ্ধি চাইলে আমাদের গণতন্ত্রের চর্চা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব, যখন আমাদের সুশীল সমাজ নিরপেক্ষভাবেই সবকিছু বিচার করবে।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিমকোর্ট

No comments

Powered by Blogger.