বিপজ্জনক হয়ে উঠছে গ্যাস বিতরণ লাইন by অরুণ কর্মকার

যেনতেনভাবে নিম্নমানের অবৈধ লাইন বসিয়ে গ্যাস নেওয়ার চেষ্টা, বিদ্যমান লাইনে অননুমোদিত কমপ্রেসর ও বিশেষ ধরনের রেগুলেটর স্থাপনের কারণে গ্যাসের বিতরণ লাইনগুলো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এসব লাইনে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
পেট্রোবাংলা ও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সূত্রগুলো জানায়, গ্যাস-সংযোগ বন্ধ থাকাকালে বিদ্যমান লাইনের মধ্যে অবৈধ সংযোগ নেওয়া হতো। তবে সংযোগ চালু করার পর শুরু হয়েছে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বেপরোয়া অবৈধ লাইন বসানো।
সূত্রগুলো জানায়, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে যেকোনো শ্রেণীর ঠিকাদারের মাধ্যমে নিম্নমানের পাইপ দিয়ে এ ধরনের হাজার হাজার ফুট লাইন বসানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এর সঙ্গে তিতাসের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। অননুমোদিত এসব লাইন স্থাপনে যথাযথ নিরাপত্তা মানদণ্ড বজায় রাখা হচ্ছে না।
ঢাকার কেরানীগঞ্জে সরেজমিন দেখা গেছে, তিতাস গ্যাসের নেটওয়ার্কের বাইরেও গ্রামের পর গ্রামজুড়ে লাইন বসানো হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব লাইন নেওয়া হচ্ছে কতিপয় আবাসন কোম্পানির আবাসিক প্রকল্পের কাছে, যাতে ওই সব প্রকল্পে গ্যাস-সংযোগ দেওয়া যায়।
জানতে চাইলে তিতাসের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদ ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে লাইন বসানোর বিষয় তাঁরাও জানেন। একাধিক জায়গায় ওই কাজ বন্ধ করতে গিয়ে তাঁদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাঞ্ছিত হয়েছেন। কোথাও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের বাধা দিয়েছেন। অবশ্য এসব লাইন চিহ্নিত করে গ্যাস-সংযোগ না দেওয়া কঠিন হবে না।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিপুল অর্থ লেনদেনের বিনিময়ে এসব লাইন হচ্ছে। রাজধানীর ভাটারা থানার একটি আবাসিক প্রকল্পের ২৫০টি প্লটের প্রতিটিতে সংযোগের জন্য ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে লাইন বসানো হচ্ছে। ওই এলাকা তিতাসের নেটওয়ার্কের বাইরে। কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী প্রভৃতি এলাকায়ও তিতাসের নেটওয়ার্কের বাইরে লাইন বসানো হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, এসব লাইন রাখা যাবে না। কারণ, একদিকে এগুলো করা হচ্ছে সরকারি আদেশ অমান্য করে অবৈধভাবে। অন্যদিকে নিয়ম মেনে মানসম্পন্ন জিনিসপত্র ব্যবহার করে এগুলো করা হচ্ছে না। ফলে জননিরাপত্তার জন্য এই লাইনগুলো মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাই এসব লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। সময়মতো এ ব্যাপারে অভিযান চালানো হবে।
কমপ্রেসর ও রেগুলেটর: এদিকে অনেক শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহক বিদ্যমান গ্যাস লাইনে অবৈধভাবে ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কমপ্রেসর (গ্যাসের চাপ বাড়ানোর যন্ত্র) বসাচ্ছেন। যেসব এলাকায় গ্যাসের চাপ কম, সেখানে এই প্রবণতা বেশি।
তিতাসের সূত্র জানায়, গত সোমবার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি স্পিনিং মিলের ছাদ থেকে এ রকম একটি কমপ্রেসর আটক করা হয়। এটি আসলে এয়ার কমপ্রেসর। কিন্তু কারখানার লাইনে গ্যাসের চাপ বাড়ানোর জন্য সেটিই ব্যবহার করা হচ্ছিল, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ রকম আরও ঘটনার খবর পেয়ে স্থানগুলোতে গেলেও তা সহজে ধরা যায় না।
এ ছাড়া কোনো কোনো শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহক তাঁদের লাইনে ‘লো ডিফারেন্সিয়াল রেগুলেটর’ নামে বিশেষ ধরনের রেগুলেটর বসাচ্ছেন। এতে মূল লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকলেও তাঁদের প্রতিষ্ঠানে রেগুলেটরটি সঠিক চাপেই গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু এতে আশপাশের গ্রাহকের লাইনের চাপ আরও কমে যায়।
তিতাসের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, আজকাল কোনো কোনো গ্রাহক তাঁদের শিল্পে বা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের রেগুলেটর স্থাপনের জন্য অনুমোদনও চাইছেন। কিন্তু তা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এতে কোনো না কোনো গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ডিইপিজেডের লাইন থেকে চুরি: সাভারের ঢাকা ইপিজেডে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য দুটি লাইন আছে। দুটি লাইনেরই বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে ছিদ্র করে শাখা লাইন করে অন্যত্র গ্যাস নেওয়া হচ্ছে। এ প্রবণতা বাড়তে থাকায় এখন ইপিজেডের কারখানাগুলো সঠিক চাপে গ্যাস পাচ্ছে না। এ জন্য ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি লাইন স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই ব্যয় ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বহন করছে।
নতুন সংযোগ চলছে: সরকার গত ৭ মে নতুন গ্যাস-সংযোগ উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর অবৈধ হিসেবে আবেদনকারী ছাড়া অন্য গ্রাহকদের সংযোগ দেওয়া শুরু হয়েছে। এই গ্রাহকদের মধ্যে আছেন সংযোগ বন্ধের আগেই চাহিদাপত্র ইস্যু করা নতুন গ্রাহক, যাঁরা চুলার সংখ্যা বাড়াতে চান, এমন গ্রাহক এবং বিভিন্ন আবাসিক কোম্পানির ভবনগুলো।
এর মধ্যে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রক্রিয়াগত বিলম্বের কারণে আবাসিক কোম্পানিগুলো নিজেদের উদ্যোগে ঠিকাদার নিয়োগ করে লাইন টানছে। অন্যগুলো বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় দেওয়া হচ্ছে। তিতাস সূত্র জানায়, তারা এখন পর্যন্ত একেবারে নতুন সংযোগ দিয়েছে প্রায় তিন হাজার। চুলার সংখ্যা বাড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার। অবৈধ গ্রাহকদের আবেদনগুলো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে, যাতে নতুন কোনো গ্রাহক এই শ্রেণীতে আবেদন করতে না পারেন। তালিকাভুক্তির কাজ শেষ হলেই এই শ্রেণীর গ্রাহকের সংযোগ বৈধ করার কাজ শুরু হবে।
তিতাস সূত্র জানায়, নির্ধারিত সময়ের (গত ২০ জুন) মধ্যে তারা ৫৮ হাজার ৭৭৭ গ্রাহকের কাছ থেকে এক লাখ ৬৪ হাজার ৮০৩টি চুলার সংযোগ বৈধ করার আবেদন পেয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, অন্য তিনটি বিতরণ কোম্পানির এলাকায় অবৈধ সংযোগ বৈধ করার আহ্বানে একেবারে সাড়া মেলেনি। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক কর্ণফুলী বিতরণ কোম্পানিতে ৫৭টি ও কুমিল্লাকেন্দ্রিক বাখরাবাদে ১২০টি আবেদন জমা পড়েছে। পশ্চিমাঞ্চল বিতরণ কোম্পানির এলাকায় কোনো আবেদন জমা পড়েনি।

No comments

Powered by Blogger.