গাজীপুর সিটি নির্বাচন-ভোটের লড়াই হোক শঙ্কামুক্ত

আয়তনে দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন আজ। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
তবে আশঙ্কা কাটছে না ভোটারদের মন থেকে। বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনা ও হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হওয়া আশঙ্কার কথা শেষ মুহূর্তে আরো জোরালোভাবে শোনা যাচ্ছে গাজীপুরবাসীর মুখে। তবে নানা শঙ্কার খৰ মাথায় নিয়েই সব নাটকের অবসান ঘটাবেন আজ ভোটাররাই।
'আঙ্গোর এইহানতে তো শুরু থেইকা কম নাটক দ্যাখলাম না! জাহাঙ্গীর নাটক, এরশাদ নাটকের পর আইজকা যে আবার ক্যারা কোন ফাইনাল নাটক দেহায় হেই ডরেই তো বাঁচতাম না! চাইরদিকে হুনতাছি আইজকা অনেকগুলা কেন্দ্রে নাকি গণ্ডগোল অইতে পারে।' গাজীপুর নগরীর ভুরুলিয়া ব্যাপটিস্ট মিশনের সামনে দাঁড়িয়ে অটোরিকশাচালক মোমেনুল এভাবেই জানান তাঁর শঙ্কার কথা।
বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানার পাশে চতর বাজারের আব্দুল বারিক সংবাদকর্মী পরিচয় জেনে চেহারায় উৎকণ্ঠার ছাপ ফেলে নিচু স্বরে প্রশ্ন করেন 'আসলেই কি শান্তিপূর্ণভাবে সব কিছু শেষ অইব?' একটু থেমে নিজ থেকেই বলেন, 'বাতাস দেইখ্যা মনে অয় ভোটের কালে কোনো গ্যাঞ্জাম না অইলোও ফলাফল ঘোষণা লইয়া গ্যাঞ্জাম কিছু একটা অইতোই।'
গত জানুয়ারিতে গাজীপুরের দুটি পৌরসভা ও ছয়টি ইউনিয়ন পরিষদের ৩২৯ দশমিক ৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত হয় দেশের ১১তম এই সিটি করপোরেশন। গত ২২ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি। ১৮ জুলাই প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেন রিটার্নিং অফিসার। আজকের নির্বাচনে মেয়র পদে ছয়জন, ৫৭টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ৪৫৬ জন ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ১২৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। গতকাল শুক্রবার নগর ভবন, রিটার্নিং অফিসার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিতরণকেন্দ্র থেকে ৩৯২টি ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপার, সিলমোহর ও ভোটার তালিকা পাঠানো হয়েছে।
রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় সূত্র জানায়, সর্বশেষ হালনাগাদ ভোটার তালিকা অনুযায়ী গাজীপুর সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ১০ লাখ ২৬ হাজার ৯৩৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৭৭৭ ও নারী ভোটার চার লাখ ৯৯ হাজার ১৬১ জন। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৩৯২টি ও ভোটকক্ষের সংখ্যা ২২ হাজার ৮৯টি। তবে নির্বাচনের এসব সামগ্রী নেওয়ার সময় ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন প্রিসাইডিং অফিসার নির্বাচন কমিশনের অনেক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করেছেন। আর ভোটারদের মুখে শোনা গেছে নানা ধরনের আশঙ্কার কথা।
উত্তর ছায়াবীথির শ্মশানঘাট রোডের একজন চাল ব্যবসায়ী বলেন, 'কাইলকা থেইকা কানাঘুষা অইতাছে টেলিভিশন মার্কার লোকজন নাকি ১০০ টার মতো কেন্দ্র টার্গেট কইরা লইছে, যেই কেন্দ্রগুলাতে তারার প্রার্থী হারলেই সব কিছু ভুণ্ডুল কইর‌্যা দিব।'
অন্যদিকে টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নানের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাসান উদ্দিন সরকার গতকাল রিটার্নিং অফিসারের কাছে করা এক অভিযোগে তাঁর নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছেন।
আবেদনে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, 'স্বার্থান্বেষী মহল আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে। তারা ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স জোর করে অন্যত্র নিয়ে কারচুপির প্রস্তুতি নিয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রের ভেতর আমাদের এজেন্টকে জিম্মি করে প্রতিপক্ষ ব্যাপক জাল ভোট দেবে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। এসব প্রতিরোধে আমি যাতে কোনো ভূমিকা না রাখতে পারি সে জন্য আমাকে কেন্দ্রে প্রবেশে বাধাসহ হামলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে আমি এবং আমার এজেন্টরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।'
আর মহাজোট সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খানের নির্বাচন পরিচালনা সমন্বয়কারী আওয়ামী লীগ নেতা আমানত হোসেন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিএনপি প্রার্থীর লোকজন শুরু থেকেই নানা মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে, প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। কিন্তু কাউলতিয়া ছাড়া অন্য কোনো এলাকায় তারা কিছু করার কোনো সুযোগ পাবে বলে মনে হয় না। এর পরও তারা যদি পরিবেশ খারাপ করার কোনো চেষ্টা করে তবে আমরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে তা প্রতিরোধ করতে প্রশাসনকে সহায়তা করব। এ জন্য আমরা আমাদের সব নেতা-কর্মীকে বলে দিয়েছি, ফলাফল না নিয়ে কেউ মাঠ ছেড়ে যাবে না।'
এদিকে গতকাল সকালে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে কেন্দ্রের ভোটের সরঞ্জামাদি নিতে আসা একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার নিজের শঙ্কার কথা তুলে ধরে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভাই, আপনারা একটু খোঁজখবর রাইখেন। বলা তো যায় না কখন কী হয়ে যায়। আমার কেন্দ্রটি খুব বাজে জায়গায়। দোয়া কইরেন যেন জানটা নিয়া ফিরতে পারি।'
কেন এত ভয় পাচ্ছেন- জানতে চাইলে ওই প্রিসাইডিং অফিসার বলেন, 'আমার কেন্দ্রটিতে একদিকে বিদ্যুৎ নেই, কেন্দ্রে যাওয়া-আসার সড়কের অবস্থাও বেহাল। এলাকায় প্রধান দুই দলের সন্ত্রাসীদের এক ধরনের আখড়া আছে। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে বলে মনে হয় না। এ ছাড়া একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থীও খুব ভয়ানক।'
জেল-জরিমানা : বৃহস্পতিবার রাতে টঙ্গী এলাকায় কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল মোমেনের পক্ষে ভোটারদের মাঝে টাকা বিতরণকালে তোফায়েল আহম্মেদ নামে একজনকে স্থানীয় লোকজন হাতেনাতে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে হস্তান্তর করে। পরে ওই আদালত তোফায়েলকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
অন্যদিকে টঙ্গীর সন্ত্রাসপ্রবণ এরশাদনগর এলাকায় অভি নামের এক যুবক নির্বাচনসংক্রান্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে অসদাচরণ করায় আদালত তাকে সাত দিনের কারাদণ্ড দিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র : রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় সূত্র জানায়, মোট ৩৯৪টির মধ্যে ২৩৫টি কেন্দ্রকে প্রচলিত ভাষায় ঝুঁকিপূর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন। বাকি ১৫৯টি কেন্দ্র হচ্ছে সাধারণ। এর ভেতরে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে আলাদা করে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৬২টি কেন্দ্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ২২ সন্ত্রাসীর একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। এর আগে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরেকটি তালিকা করা হয়েছে সন্ত্রাসীদের। তবে এসব তালিকা হলেও গতকাল পর্যন্ত তাদের কাউকেই গ্রেপ্তার না করায় কিংবা কোনো অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় মানুষের মধ্যে সংশয় রয়েই গেছে। এমনকি অন্যান্য সিটি করপোরেশনে ভোটগ্রহণের আগে এলাকার বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও গাজীপুরে সেটাও করা হয়নি।
জেলা পুলিশের একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের বলা হয়েছে পরিবেশ শান্ত রাখার স্বার্থে আপাতত অনেক কিছু ওভারলুক করতে। আমরা তো উপরের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করতে পারছি না। দেখেও না দেখার ভান করে চলতে হচ্ছে।'
তবে জেলা পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ইতিমধ্যে তালিকাভুক্ত ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছি।' অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
জেলা প্রশাসক মো. নুরুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া আছে।
নির্বাচনকে ঘিরে গাজীপুরের সার্বিক পরিবেশ সম্পর্কে জেলা প্রশাসক কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনের সময় বা ভোটের দিনকে ঘিরে সাধারণভাবেই নানা আশঙ্কা-উদ্বেগ থাকে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিতদের পর্যাপ্ত ভূমিকা থাকলে কোনো সমস্যা হয় না। এখানেও আশা করি সব শঙ্কা দূর হয়ে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হবে।
রিটার্নিং অফিসার মতিয়ার রহমান বলেন, 'আমি কোনো শঙ্কা দেখিও না, শুনিও না। কোথাও কোনো কিছু হবে না। এখন পর্যন্ত কোথাও সামান্য একটু অপ্রীতিকর ঘটনাও হয়নি। আমি নিশ্চিত, একেবারে শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট হবে। এ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।'
নিরাপত্তার চাদর : নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, আজকের ভোটকে সামনে রেখে পুরো সিটি করপোরেশন এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। নির্বাচনে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাঁচ হাজার পুলিশ সদস্য, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ১২ প্লাটুন সদস্য, ৮৪৭ জন র‌্যাব ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১১ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড ও হেলিকপ্টার টহল ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে নগরজুড়ে টহল দিচ্ছে বিজিবি ও র‌্যাব। গতকাল থেকে ৫০ জন নির্বাহী ও ১০ জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচনের পরও দুই দিন দায়িত্ব পালন করবেন ম্যাজিস্ট্রেটরা।
র‌্যাব ১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিসমত হায়াৎ নির্বাচনে নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে জানান, র‌্যাব ১-এর পক্ষ থেকে নিরাপত্তার দায়িত্বে পোশাকধারী ও গোয়েন্দা মিলিয়ে ৮৪৭ জন র‌্যাব সদস্য সার্বক্ষণিকভাবে নির্বাচনে সব অপতৎপরতা রোধে মাঠে রয়েছেন। তিনি আরো বলেন, আজ নির্বাচন চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক রাখতে সমগ্র নিবাচনী এলাকা দুটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। একটি গাজীপুর ও আরেকটি টঙ্গী। এ ছাড়া প্রতিটি সেক্টরকে তিনটি করে সাবসেক্টরে ও প্রত্যেকটি সাবসেক্টরকে পাঁচটি 'ডিটাচমেন্টে' ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেক ডিটাচমেন্টে একজন করে অফিসারের নেতৃত্বে দুটি টহল দল সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রত্যেকটি সাবসেক্টরে দুটি টহলে ১৬ জন স্ট্রাইকিং রিজার্ভ হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তথ্য সংগ্রহে র‌্যাবের একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা দল আরো দুই দিন আগে থেকে কাজ করছে।
তবে জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ডা. মাজহারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রশাসন যা-ই বলুক না কেন, ভোট কারসাজির জন্য প্রশাসনকে পুরোপুরি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের একটি দাবিও পূরণ করেনি নির্বাচন কমিশন। তাই আমাদের আশঙ্কা, পুলিশ, দলীয় প্রিসাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে ফলাফল আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে নেওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে সরকার।'

No comments

Powered by Blogger.