হেফাজতে নমনীয় সরকার by তোফাজ্জল হোসেন রুবেল

হেফাজতে ইসলামের ব্যাপারে কৌশলগত নমনীয় অবস্থান নিয়েছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সম্প্রতি সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
ওই বৈঠকেই মাদ্রাসা বা মসজিদে কর্মরত ব্যক্তিদের নামে নতুন করে মামলা করা বা তাদের হয়রানি করার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা যেন হেফাজতের কোনো কর্মীকে হয়রানি না করে, এ বিষয়েও নজর রাখতে বলা হয়েছে। গত কয়েক দিনে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নমনীয়তা অবলম্বনের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। ঢাকাসহ কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপাররা এ কথা নিশ্চিত করেছেন। তবে নমনীয়তার কৌশল অবলম্বন করা হলেও পল্টনের তাণ্ডবের হোতাদের খুঁজে বের করে আইনের মুখোমুখি করা হবে বলে তাঁরা জানান।
এ ব্যাপারে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হেফাজতের সঙ্গে আপস হয়েছে, এ কথা ঠিক নয়। আইন তার নিজের গতিতেই চলছে। যারা ফৌজদারি অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথানিয়মে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'
প্রসঙ্গত, গত ৫ মে পল্টনে তাণ্ডবের পর হোতাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার কথা বলেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। কিন্তু ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর ব্যাপারে খোঁজ-খবর করছে না পুলিশ। আসামিদের বেশির ভাগ ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভিডিও ফুটেজ দেখে বেশ কয়েজনকে শনাক্ত করলেও তাদের আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। পুলিশ ও র‌্যাব দাবি করেছে, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের কয়েকজন উপকমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, হেফাজতের ব্যাপারে নমনীয় থাকতে উচ্চ পর্যায় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের। কোনো মসজিদ-মাদ্রাসায় কর্মরতদের নামে নতুন করে মামলা বা তাদের হয়রানি করা যাবে না। আর সরকারদলীয় লোকজনও যেন হেফাজতের সঙ্গে সংঘর্ষে না জড়ায় সে খেয়াল রাখতে হবে। তবে ফৌজদারি অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত নিয়মেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশের চোখে পলাতক যারা : পুলিশ সূত্র জানায়, রাজধানীতে তাণ্ডবের পর দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের অধিকাংশ পলাতক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হেফাজতের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার আমির মাওলানা মাইনুদ্দীন রুহী, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফরিদউল্লাহ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম, নায়েবে আমির মহিবুল্লাহ বাবু, তাজুল ইসলাম, আবদুল মালেক হালিম, আজিজুল হক ইসলামাবাদী, ফজলুল হক জিহাদী, নেজামে ইসলামের সাহিত্য সম্পাদক মুফতি হারুন ইজাহার, হেফাজতে ইসলামের অর্থ সম্পাদক মাওলানা ইলিয়াছ ওসমানী, নূর হোসেন কাসেমী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মাহফুজুল হক, আবদুল কুদ্দুস, নুরুল ইসলাম, আবুল হাসনাত আমিনী, মোস্তফা আজাদ, মুফতি নুরুল আমিন, শাখাওয়াত হোসেন, জুনায়েদ আল-হাসিব, আতাউল্লাহ আমিম, গোলাম মহিউদ্দিন একরাম, শেখ লোকমান হোসেন, মুফতি শায়দুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম মাদানী, শামসুল হক, মনির হোসেন মুন্সী ও আবদুল কাদের। ওই সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত-শিবির ও বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকেও আসামি করা হয়েছে। তাঁরা হলেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক সরাফত আলী সপু, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও শিবিরের সেক্রেটারি আবদুল জব্বার।
এক লাখ আসামি, গ্রেপ্তার মাত্র এক শ : রাজধানীর ছয় থানায় ৪৩টি মামলায় লক্ষাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হলেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে মাত্র এক শ জনকে। কিন্তু নজিরবিহীন ওই তাণ্ডবে অর্থ ও উস্কানিদাতাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। পল্টনসহ বেশ কিছু স্থানে তাদের তাণ্ডবের চিহ্ন এখনো মুছে যায়নি, তবে পুলিশ আসামিদের কথা ভুলে যাচ্ছে। মতিঝিল, পল্টন ও মিরপুরে দায়ের হওয়া মামলার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা কৌশলে জানালেন তাদের অনীহার কথা।
জানা গেছে, শুধু পল্টন মডেল থানায় ৩০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৩০০ জনকে নাম উল্লেখ করে এবং প্রায় ৩০ হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে মাত্র ১৬ জনকে। মিরপুর মডেল থানার দুটি মামলায় ২০ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার পরই সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও অন্যদের আর ধরা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে মিরপুর থানার ওসি সালাউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখনই অন্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে গ্রেপ্তার করা হবে।'
ঘটনার পর পল্টন থানায় ৩০টি, মতিঝিল থানায় ছয়টি, রমনা থানায় তিনটি, মিরপুর মডেল থানায় দুটি, শাহবাগ ও শ্যামপুর থানায় একটি করে মোট ৪৩টি মামলা করা হয়েছে। এসবের মধ্যে কয়েকটি হত্যা মামলাও রয়েছে।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁরা ভিডিও ফুটেজ দেখার সময় পাচ্ছেন না। তদন্ত ও আসামি ধরার ব্যাপারে কোনো চাপ নেই বলেও জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আসামিদের ব্যাপারে নমনীয় হওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে মাদ্রাসায় যেসব শিশু ও সাধারণ লোকজন রয়েছে তাদের হয়রানি করা হবে না। মামলার তদন্ত চলছে যথারীতি।' আসামি না ধরার ব্যাপারে তিনি বলেন, 'তারা পালিয়ে থাকার কারণে ধরা সম্ভব হচ্ছে না।'
বাবুনগরীর জবানবন্দিতে উল্লিখিতরাও ধরাছোঁয়ার বাইরে
সূত্র জানায়, গত ২১ মে হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করে তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়। মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট হারুন অর রশিদ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তাঁর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। বাবুনগরী আদালতকে জানান, ৫ মে সকাল থেকেই বায়তুল মোকাররম, পুরানা পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ শুরু করে জামায়াত-শিবির, ছাত্রদল এবং যুবদলের নেতা-কর্মীরা। তাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে হেফাজতের কর্মীরাও। আবার সরকার পতনের জন্য হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা টাকা দিয়েছেন। প্রয়োজনে আরো অর্থ তিনি দেবেন। তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতার নাম বলেছেন বাবুনগরী। কিন্তু তাঁর জবানবন্দির পর দোষীদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পুলিশ সূত্র বলছে, বাবুনগরীর জবানবন্দি ছাড়া তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ এখনো সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি। তাই তাদের গ্রেপ্তারও করা হয়নি।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, সব মামলার তদন্ত এগিয়ে চলেছে। বেশ কিছু দিন হরতাল ও নাশকতা ঠেকাতে বেশি ব্যস্ত থাকায় তদন্তে কিছুটা সময় লাগছে।
উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া অস্ত্র
গত ৬ মে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে হেফাজতকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকটি অস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে বিজিবির একটি এসএমজি ও রাইফেল রয়েছে। পুলিশের দুটি পিস্তল ও একটি শটগানও লুট হয়েছে। পরে পুলিশের শটগানটি পাওয়া গেলেও অন্য অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি। ঘটনার পরই আইনশৃঙ্খলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। সংঘর্ষ চলাকালে হেফাজতকর্মী বা জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররাই অস্ত্র লুট করেছে বলে তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়েছিলেন পুলিশের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'লুট হওয়া অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আসামিরা এলাকায় না থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করাও যাচ্ছে না।'

No comments

Powered by Blogger.