ভিন্নমত-বাজেট ২০১৩-১৪ এবং শেয়ারবাজার by আবু আহমেদ

২০১৩-১৪ আর্থিক সালের বাজেট বা অর্থ বিলে শেয়ারবাজারের জন্য যেসব প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে তা প্রান্তিক বলেই মনে হয়। যেমন পাঁচ হাজার টাকার পরিবর্তে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিভিডেন্ড (Dividend) আয়কে করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
এতে যে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী উপকৃত হবে তা নয়, এতে আরো সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীকে যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আকর্ষণ করা যাবে তাও নয়। বিনিয়োগকারীরা আশা করেছিল করমুক্ত ডিভিডেন্ড আয় আরো অনেক বেশি হবে, কমপক্ষে তা ২৫ হাজার টাকা হবেই। কারণ পুরনো বিনিয়োগকারীরা দেখেছে, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীকে আকর্ষণ করা এবং ধরে রাখার জন্য এই করমুক্ত আয় অতীতে অনেক বেশি ছিল। এই করমুক্ত আয় ছিল অনেক বছর পর্যন্ত ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে। এমনকি প্রয়াত কিবরিয়া সাহেব অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ডিভিডেন্ড আয় এক লাখ টাকা পর্যন্ত আয়করমুক্ত ছিল। এটা মিথ্যা কি না সেটা যাচাই করার জন্য রাজস্ব বোর্ড তাদের ১৯৯৭-৯৮, ১৯৯৯-২০০০ সনের নথিপত্র এবং অর্ডারগুলো ঘেঁটে দেখতে পারে। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে মহাধসের পর কিবরিয়া সাহেব অনেকটা অনুতপ্ত হয়েছিলেন। উনি বাজারের ওপর আস্থা ফেরাতে এবং বাজারকে পুনরুদ্ধার করার জন্য সে সময়ে শেয়ারবাজারের পক্ষে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার মধ্যে ডিভিডেন্ড আয়কে এক লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত ঘোষণা করা ছিল অন্যতম। ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত এই আয় করমুক্ত ছিল, ব্যাপারটা এর আগে থেকেই চলে আসছিল। বিনিয়োগকারীদের অন্য দাবি ছিল করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স কমানো। এই দাবির পক্ষে দুটি যুক্তি ছিল- এক. এই কর কমালে কম্পানিগুলোর ডিভিডেন্ড বা মুনাফা বণ্টনের ক্ষমতা বাড়ে। ফলে ছোট-বড় সব শেয়ারহোল্ডার উপকৃত হতো। অন্য যুক্তি হলো করপোরেট ট্যাক্স বেশি থাকলে কম্পানিগুলো বেশি ট্যাক্স দেওয়া থেকে দূরে থাকার জন্য তাদের প্রকৃত আয়কে লুকায়। এ লক্ষ্যে তারা বেশি খরচ দেখানোর আশ্রয় নেয় এবং তাদের নিয়োগকৃত অডিটে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবে সহযোগিতা করে। ফলে রাজস্ব বোর্ডও কম ট্যাক্স পায় এবং সাধারণ বা মাইনরিটি শেয়ারহোল্ডাররা কম ডিভিডেন্ড পায়। আর কম্পানি গ্লোবাল বা মাল্টিন্যাশনালগুলো তো বিভিন্ন বেচাকেনার মাধ্যমে তারা ওই সব দেশে আয়কে স্থানান্তর করে, যেসব দেশে করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স তুলনামূলক কম। এর ফলে এ দেশের রাজস্ব বোর্ডই শুধু কম ট্যাক্স পায় না, এ দেশের শেয়ার বিনিয়োগকারীরাও কম ডিভিডেন্ড বা মুনাফা পায়। আর্থিক বিজ্ঞানে কম ট্যাক্সের দেশে বা টেরিটরিতে (Teritory) আয় স্থানান্তরের নাম হলো ট্রান্সফার প্রাইসিং (Transfer Pricing)। বাংলাদেশের মতো দেশে বহুজাতিক কম্পানিগুলোর এই যে আইনি পদ্ধতিতে আয় সরানোর বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইন তেমন নেই, তেমনি তাদের লেনদেনকে পরীক্ষা করে এই চুরি ধরার জন্য দক্ষ জনবলও নেই। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বাংলাদেশের মতো দুর্বল দেশগুলোয় করপোরেট ট্যাক্সকে কম্পিটিটিভ বা প্রতিযোগিতামূলক রাখা বা গ্লোবাল প্রেক্ষাপটে কম রাখা, যাতে এসব কম্পানি এ দেশেই তাদের আয় রাখে এবং বেশি করে মুনাফা ঘোষণা করে। বাংলাদেশ প্রচণ্ডভাবে এ ক্ষেত্রে অমনোযোগী। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মাথায় শুধু এ যুক্তিই কাজ করছে যে, যত বেশি করপোরেট ট্যাক্স, তত বেশি রাজস্ব আয়। এটা একটা ডাহা ভুল চিন্তা। কম করপোরেট ট্যাক্সের পক্ষে আমাদের অন্য যুক্তি হলো- ওই ট্যাক্স শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে যদি কম হয়, তাহলে আরো বেশি বেশি কম্পানি জনগণের কাছে তাদের শেয়ার বেচে এই বাজারে আসতে উৎসাহ পাবে। সে জন্য অনেক যুক্তি ও তদবিরের পরে আজকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কম করপোরেট ট্যাক্স দেওয়ার নিয়ম করা হয়েছে; যদিও ব্যাংকিং কম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। কিন্তু আর্থিক বিল ২০১৩-১৪তে একটা প্রস্তাব আমাদের এই ক্ষেত্রে হতাশ করেছে, সেটা হলো একটা গ্লোবাল মোবাইল টেলিফোন কম্পানির ক্ষেত্রে এই ট্যাক্সকে ৩৫ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এতে স্থানীয় হাজার হাজার শেয়ারহোল্ডার কম ডিভিডেন্ড পাবে। অন্যদিকে যেসব মোবাইল ফোন কম্পানি ট্যাক্স কনসেশনের জন্য শেয়ারবাজারে আসার প্রস্তুত নিচ্ছিল তারাও পিছিয়ে যাবে। কোনো কোনো গ্লোবাল মোবাইল ফোন কম্পানি বাংলাদেশিদের কাছে তাদের ইক্যুইটি (Equity) বা মানসম্মান বেচে শেয়ারবাজারে আসবে? আলোচ্য মোবাইল ফোন কম্পানিটিও প্রথমে আমাদের শেয়ারবাজারে আসতে চায়নি। অনেক বোঝানোর পর জনস্বার্থে এবং কম ট্যাক্স দেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করার জন্য শেষ পর্যন্ত তারা ১০ শতাংশ শেয়ার অফ-লোড (Off-Load) করে শেয়ারবাজারে আসে। আজকে যদি তাদের ট্যাক্স বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সরকার শুধু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নিল না- গ্লোবাল কম্পানিগুলোকেও একটা ভুল সংকেত পাঠাল। আশা করি বাজেট বিলে প্রস্তাবিত বর্ধিত ৫ শতাংশ ট্যাক্সের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে।
শেয়ারবাজার বিধ্বস্ত ও আস্থাহীনতায় ভুগছে। এই বাজারকে চলনসই একটা আস্থায় আনতে গেলে সরকারকে কিছু প্রণোদনা তো অবশ্যই দিতে হবে। যেসব প্রণোদনার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো শেয়ারবাজারকে কতটুকু সাহায্য করে এ নিয়ে সন্দেহ আছে। অন্য বিষয়টি হলো- আমাদের রাজনৈতিক সংঘাত পুরো অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারকে আঘাত হেনে চলেছে। ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে যেসব কারণে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হয়নি এবং শেয়ারবাজার মন্দা থেকে মন্দার স্তরে প্রবেশ করেছে, সেসব কারণ ২০১৩-১৪তেও উপস্থিত থাকলে বাজেটে বর্ধিত টার্গেটগুলো অর্জন করা যাবে না, অন্যদিকে শেয়ারবাজারও ঘুরে দাঁড়াবে না। আজকে আমাদের অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের জন্য মূল সমস্যা হলো সংঘাতের রাজনীতি। এ সমস্যাকে সমাধান করার জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। অর্থবহ সংলাপ ছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘাত নিরসন হবে, এটা কোনো লোকই ভাবে না। সুতরাং অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারকে আস্থায় আনতে হলে এই ফ্রন্টে সরকারকে কাজ করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.