রানির বেশে তিনি কে?

চেনা-জানা রাজকাহিনীতে হঠাৎ ছন্দপতন! আর এর জেরেই প্রশ্নের মুখে ব্রিটেনের প্রাচীন রাজইতিহাস। টিউডর বংশের রানি প্রথম এলিজাবেথ যাঁকে এত দিন মহান সম্রাজ্ঞী হিসেবে মেনে এসেছেন ব্রিটেনবাসী, তিনি নাকি আদতে পুরুষ।
নিজেদের গাফিলতি ঢাকতে এক গ্রাম্য বালককে প্রথম এলিজাবেথ সাজিয়ে রাজা অষ্টম হেনরির সামনে হাজির করেছিলেন তাঁর দুই সভাসদ। সেই বালককেই এত দিন ধরে প্রথম এলিজাবেথ হিসেবে জেনে এসেছে ব্রিটেন। মার্কিন লেখক স্টিভ বেরি তাঁর নতুন উপন্যাস 'দ্য কিংস ডিসেপশন'-এ এমন দাবি করেছেন। এ দাবির পক্ষে তাঁর যুক্তি- পুরুষ হওয়ার কারণেই কখনো বিয়ে করেননি 'প্রথম এলিজাবেথ'।
ইতিহাস বলছে, ১৫৫৮ সালে সিংহাসনে বসার পর প্রথম এলিজাবেথ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বিয়ে করবেন না। শেষ পর্যন্ত কথা রেখেছেন। স্পেনের তৎকালীন শাসক তাঁর বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রানি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর স্পেনের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। স্টিভের প্রশ্ন, বিবাহ সম্পর্ক তৈরি করে যে যুদ্ধ অনায়াসেই এড়াতেন পারতেন, সেই যুদ্ধে কেন জড়িয়ে পড়লেন রানি? কারণ, তিনি নিজের পরিচয় ঢাকতে চেয়েছিলেন। যে পরিচয় লুকিয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিম ব্রিটেনের গ্লস্টারশায়ার কাউন্টির ছোট্ট গ্রাম কটসওল্ডে।
স্টিভ লিখেছেন- সালটা ১৫৪৩। বছর দশেকের ছোট্ট এলিজাবেথ তখন কটসওল্ডে। লন্ডনে প্লেগ ছড়িয়েছে। তাই মেয়েকে বাঁচাতে কটসওল্ডে পাঠিয়ে দিয়েছেন রাজা অষ্টম হেনরি। বেশ কিছু দিন পরে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তিনি। কিন্তু রাজা কটসওল্ডে পৌঁছার আগের রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এলিজাবেথ। প্রথমে জ্বর, এরপর বমি, ধনুষ্টঙ্কার। ক্রমেই অবস্থার অবনতি হলো। পরের দিন সকালেই মারা যান এলিজাবেথ। রাজার কটসওল্ড পৌঁছাতে তখনও কয়েক ঘণ্টা বাকি ছিল।
এলিজাবেথের মৃত্যুতে প্রমাদ শুনলেন তাঁর দেখভালের দায়িত্বে থাকা লেডি ক্যাট অ্যাশলে এবং টমাস প্যারি। রাজদণ্ড থেকে নিজেদের বাঁচাতে ফন্দি আঁটলেন তাঁরা। রাজার সঙ্গে যে তাঁর মেয়ের দেখা-সাক্ষাৎ বিশেষ হতো না, সে খবর জানা ছিল তাঁদের। এলিজাবেথ ছিলেন অত্যন্ত লাজুক। তাঁর মায়ের গর্দান নিয়েছিলেন যে বাবা, তাঁর সঙ্গে কথা বলতেও ভয়ে কাঁপতেন তিনি। তাই রাজার চোখে ধুলো দেওয়া যাবে মনে করে প্রথমে এলিজাবেথের মতো দেখতে একটি মেয়ে জোগাড় করার চেষ্টা চালালেন ক্যাট ও টমাস। কিন্তু তেমন কোনো মেয়ে পাওয়া গেল না। অগত্যা নেভিল নামে একটি গ্রামের সাদামাটা এক বালককে এলিজাবেথ সাজিয়ে হাজির করলেন রাজার সামনে। রাজাও বিষয়টি ধরতে পারলেন না।
রাজবাড়ির কারও সঙ্গেই এলিজাবেথ বিশেষ কথার্বাতা বলতেন না। তাই আসল-নকল ফারাকটাও কেউ ধরতে পারেনি। ক্যাট-টমাসও নেভিলকে রাজকীয় আদবকায়দা শিখিয়েছিলেন। স্টিভের দাবি, কৌশলটা কাজে লেগে গিয়েছিল। শেষ দিন পর্যন্ত বিশেষ কেউ জানতে পারেনি সত্যিটা।
তবে এলিজাবেথের চিফ মিনিস্টার উইলিয়াম সেসিল বিষয়টা জানতেন। যদিও সেই রহস্য কখনো ফাঁস করেননি তিনি। স্টিভের মতে, সত্যি ফাঁস হয়ে গেলে ব্রিটেনে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ত। কারণ, টিউডর বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে তখন সে অর্থে সিংহাসনের আর কেউ দাবিদার ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই মুখ বন্ধ রেখেছিলেন সেসিল।
সেই সত্য আরো গুটিকয়েক মানুষ জানতেন। তাঁরাও কখনো মুখ খোলেননি। খালি কটসওল্ডে গুজব আকারে কাহিনীটি ঘোরাফেরা করে। সেই গুজবের সূত্র ধরেই উপন্যাস লিখেছেন স্টিভ। তাঁর দাবি, এটা রাজ ইতিহাসের প্রাচীনতম চক্রান্ত। দেড় বছর নানা তথ্য ঘেঁটে যে চক্রান্তের রোমহর্ষক বিবরণ লিখেছেন তিনি।
এলিজাবেথ যে আদতে পুরুষ ছিলেন তা বোঝাতে বেশ কিছু পরোক্ষ প্রমাণ তুলে ধরেছেন স্টিভ। বলেছেন, কটসওল্ড থেকে লন্ডনে ফেরার পর যখন ফের লেখাপড়া শুরু করে কিশোরী এলিজাবেথ, তখন তার স্বভাব, আচরণের পরিবর্তন দেখে প্রচণ্ড বিস্মিত হন তার গৃহশিক্ষক। এমনকি এ সময় এলিজাবেথের শারীরিক গড়ন পুরুষালি হতে থাকে। এলিজাবেথের আগের ও পরের ছবির মধ্যে সেই ফারাক স্পষ্ট। প্রমাণ জোগাড় করতে তাই স্টিভের দাবি, অবিলম্বে খোঁড়া হোক প্রথম এলিজাবেথের কবর। ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা হোক, তিনি ছেলে না মেয়ের।
স্টিভের উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে নিউ ইয়র্কের ব্যালান্টাইন বুকস। সূত্র : আনন্দবাজার।

No comments

Powered by Blogger.