সৌদিতেও দৌরাত্ম্য দেশি দালালের by ওমর ফারুক ও হায়দার আলী

দেশে অতীতে যাঁরা পাসপোর্ট করেছেন তাঁদের বেশির ভাগেরই দালালের খপ্পরে পড়ার কমবেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু সে তো দেশের চিত্র। এবার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সুদূর সৌদি আরবেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের পড়তে হচ্ছে দালালের খপ্পরে।
সেখানে বিভিন্ন শহরে বসানো পাসপোর্ট প্রদানের বুথকে কেন্দ্র করে রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে দালালচক্র। আগামী ৩ জুলাইয়ের মধ্যে দেশটিতে বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়ার সুযোগ নিতে ওই সব বুথের সামনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাংলাদেশিদের লম্বা লাইন পড়ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে সবার ভাগ্যে পাসপোর্ট মিলছে না। তবে দালালের সহায়তা নিলে সহজেই মিলছে পাসপোর্ট। সে জন্য একেকজনের কাছ থেকে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঘুষ আদায়ের জন্য সৃষ্টি করা হচ্ছে কৃত্রিম সংকট। পাসপোর্ট না পেয়ে কিংবা না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে অনেকে ভবিষ্যতে গ্রেপ্তার এড়াতে দেশে ফেরার জন্য 'আউটপাস' নিয়ে রাখছেন। এসব অভিযোগের বিষয়টি দেশে ও সৌদিতে থাকা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানতে পেরেছেন বলে একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সৌদিতে থাকা অবৈধ প্রবাসী কর্মীদের যাঁরা বৈধ হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা যেন কোনোভাবেই হয়রানির শিকার, প্রতারণার শিকার না হন সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। আমাদের গাফিলতির কারণে যেন কেউ পাসপোর্ট পাওয়া থেকে বঞ্চিত না হন সে জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।' তিনি আরো বলেন, 'এই সব শ্রমিকের রেমিট্যান্সের ওপর দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে। তাঁরা যাতে প্রতারণার শিকার না হন সে বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করব।'
যেভাবে ঘুষ আদায় করা হচ্ছে : সৌদি আরব থেকে একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন প্রতিটি বুথের সামনে হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি পাসপোর্টের জন্য ভিড় করছেন। কিন্তু অনেকেই না পেয়ে শরণাপন্ন হচ্ছেন দালালচক্রের। অভিযোগ উঠেছে, সৌদিতে ওই সব দালালচক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রিয়াদে দায়িত্বে থাকা একজন কাউন্সিলর। তাঁর নির্দেশে পাসপোর্ট না দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। ফলে আতঙ্কিত প্রবাসীরা দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য ঘুষ দিচ্ছেন।
টাঙ্গাইলের নাগরপুরের ইসমাইল হোসেনের ছেলে রবিউল ইসলাম ছয় বছর ধরে থাকেন সৌদি আরবের দাম্মামে। তিন বছর তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এরপর তিনি চলে যান অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানেও তিনি অবৈধভাবে তিন বছর কাজ করেন। সৌদি আরবে বৈধ হওয়ার সুযোগ দেওয়ার পর তিনি ১৫ দিন ধরে পাসপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত তিনি পাসপোর্ট পাননি। টেলিফোনে তিনি কালের কণ্ঠের কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, 'যারা দালালচক্রকে টাকা দিচ্ছে তারা পাসপোর্ট পাচ্ছে।' তিনি বলেন, 'আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট পাচ্ছি না। আর অনেকে টাকা দিয়ে সহজেই পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছে।' একই ধরনের কথা বলেন কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার মজিবুর রহমানের ছেলে মো. শহিদুর রহমান। তিনি বলেন, 'আমি তিন দিন ধরে লাইনে দাঁড়িয়েছি। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে চেষ্টা চালাচ্ছি পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য। যদি না পাই, তাহলে দেশে ফিরে আসতে হবে। হেল্পডেস্ক খুব ধীরগতিতে কাজ করছে।'
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গত শনিবার বিকেলে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. শহিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখানে স্বচ্ছতার সঙ্গে পাসপোর্ট প্রদানে আমাদের প্রত্যেক কর্মীই কাজ করছেন। হাজার হাজার শ্রমিক পাসপোর্ট নিতে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, কেউ কেউ হয়তো অভিযোগ করতে পারেন, আর কিছু না কিছু অভিযোগ থাকতেই পারে, সেটা আমরা অস্বীকার করব না। তবে চেষ্টা করছি প্রবাসী কর্মীদের হয়রানি যতটা কমানো যায়। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ এলে আমরা সিরিয়াসলি দেখব।' তিনি বলেন, 'দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ এমন সুযোগ পেয়েছে, সৌদিতে অবৈধ বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছেন, যেন আমাদের গাফিলতির কারণে কেউ যেন বৈধ হওয়া থেকে বঞ্চিত না হন।'
রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, 'প্রতিদিন রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আমাদের কর্মকর্তা, স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মীরা। হেল্পডেস্কের পাসপোর্ট দেওয়ার সময় শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়ায়। ওই সময় বাংলাদেশের সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোকজন চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেই বিষয়ে নজরদারি করতে বিভিন্ন টিম কাজ করছে। আমরা চাচ্ছি প্রত্যেক বাংলাদেশি কর্মী যেন পাসপোর্ট পেয়ে বৈধ হতে পারেন। বাংলাদেশ থেকে পর্যাপ্ত লোকবল এসেছে আমাদের সহযোগিতা করতে। সৌদির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হেল্পডেস্ক বসিয়ে পাসপোর্ট সরবরাহের কাজ করে যাচ্ছি।'
সবাইকে পাসপোর্ট দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে : সৌদিতে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি কাজ করেন। রাষ্ট্রদূতের হিসাবে এর মধ্যে সৌদি সরকারের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিতে অবৈধ হিসেবে বসবাসকারী প্রায় চার লাখ বাংলাদেশির নতুন পাসপোর্ট করার প্রয়োজন হচ্ছে। তবে আরো কয়েকটি সূত্রের হিসাব মতে এ সংখ্যা পাঁচ লাখের কম নয়। এ ছাড়া ৩ জুলাইয়ের মধ্যে আরো অনেক বাংলাদেশির পাসপোর্ট হালনাগাদ এবং দেশে ফিরতে ইচ্ছুকদের 'আউট পাসপোর্ট' ইস্যু করতে হচ্ছে বাংলাদেশ দূতাবাসকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা গত ১৫ মে থেকে পাসপোর্ট দেওয়া শুরু করেন। বিপুলসংখ্যক লোকের পাসপোর্টের চাহিদা সামাল দিতে এ মাসের শুরুর দিকে দেশ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অফিসের ৫৪ জন কর্মকর্তা সৌদি আরবে গিয়ে যোগ দিয়েছেন পাসপোর্ট দেওয়ার কাজে। রিয়াদ, জেদ্দা, দাম্মাম, মদিনা, মক্কা, তাবুকসহ বিভিন্ন শহরে বসানো হয়েছে অর্ধশতাধিক বুথ। এসব বুথ থেকে বর্তমানে প্রতিদিন সাত হাজারের মতো পাসপোর্ট দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত এক লাখ ৬৩ হাজার লোককে পাসপোর্ট দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে জানা গেছে। বৈধতা পাওয়ার শেষ সুযোগ ৩ জুলাই পর্যন্ত আগামী ২৪ দিনে প্রতিদিন সাত হাজার করে পাসপোর্ট দেওয়া হলে এক লাখ ৬৮ হাজার লোককে পাসপোর্ট দেওয়া সম্ভব হবে। এতে পাসপোর্ট পাওয়া লোকের সংখ্যা দাঁড়াবে তিন লাখ ৩০ হাজারের মতো। বাকি এক থেকে দেড় লাখকে পাসপোর্ট দেওয়া অসম্ভব হবে বলে মনে করেন বুথে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা।
বুথে দায়িত্ব পালন করছেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে ফোনে বলেন, 'ঢাকা থেকে গত জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত ৫৪ জনের প্রতিনিধিদল সৌদি আরবের রিয়াদে পৌঁছায়। সেখান থেকে প্রতিনিধিদলের সদস্যদের ভাগ করে রিয়াদ, জেদ্দা, দাম্মামে দায়িত্ব পালনের জন্য পাঠানো হয়েছে। এসব স্থানে বুথে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁরা দেখেছেন লেজেগোবরে অবস্থা। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রচণ্ড গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বুথের সামনে। কিন্তু ঘুষ আদায়ের জন্য পাসপোর্ট দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে।'
আতঙ্কিতরা নিচ্ছেন আউটপাস : সূত্র জানায়, যাঁরা সৌদি আরবে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বৈধ হতে পারবেন না তাঁদের মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে এবং দুই বছর জেল খাটতে হবে। ৩ জুলাই যতই এগিয়ে আসছে সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। অনেকেই বৈধ হতে পারবেন না- এ আশঙ্কায় গ্রেপ্তার এড়াতে দেশে ফেরার জন্য আগেভাগেই আউটপাস সংগ্রহ করছেন। রাষ্ট্রদূত মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, 'এ পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার কর্মী দূতাবাস থেকে আউটপাস নিয়েছেন।'
জানা গেছে, যাঁরা আউটপাস নিয়েছেন তাঁদের কেউ এখন পর্যন্ত দেশে ফেরেননি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ বিভাগের পুলিশ সুপার নাফিউল ইসলাম গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পাসপোর্ট না পেয়ে আউটপাস নিয়ে দেশে ফিরেছেন এমন কাউকে আমরা এখনো পাইনি। সৌদি আরব থেকে প্রতি মাসে স্বাভাবিকভাবে যে লোকজন আসে, তা-ই আসছে।' 1

No comments

Powered by Blogger.