হে উৎসব- কল্পনায় বিশ্ব by আশীষ-উর-রহমান

শহরটির নামই হয়ে গেছে ‘বইয়ের শহর’। হবে না-ই বা কেন। এক হাজার ৫০০ লোকের ওই শহরে হেন কোনো সড়ক নেই, যেখানে একাধিক বইয়ের দোকান নেই। ৪০টি বইয়ের দোকান আছে যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের ছোট্ট ওই শহরে। সে কারণেই হে শহরটিকে যুক্তরাজ্যের লোকে বলেন বইয়ের শহর।


গ্রন্থানুরাগী এই শহরের মানুষ ২৫ বছর আগে নিজেরাই এক সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করেছিলেন শহরের নাম দিয়ে। সময়ের পরিক্রমায় সেই উৎসব আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। এখন হে উৎসব হচ্ছে পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের ১৬টি শহরে। গত বছর ঢাকায় প্রথমবার এক দিনের হে সাহিত্য উৎসব হয়েছিল ব্রিটিশ কাউন্সিলে। সেটি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। সেই প্রেরণাতেই তিন দিনের উৎসব হচ্ছে এবার।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমীতে ‘কল্পনায় বিশ্ব’ মূল ভাবনা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো হে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব। দ্বিভাষিক এই উৎসবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৩০ জন এবং বাংলাদেশের শতাধিক সাহিত্যিক অংশ নিচ্ছেন বলে আয়োজকেরা জানিয়েছেন।
উদ্বোধনী উৎসব হলো একাডেমীর নতুন ভবন মিলনায়তনে। আজ শুক্রবার ও কাল শনিবার চলবে দুই দিনের অধিবেশন। উৎসব উপলক্ষে একাডেমীর প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে ছোট ছোট স্টল দিয়ে। প্রথমা, দ্য ডেইলি স্টারসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থারও স্টল রয়েছে এখানে। এ ছাড়া আছে হালকা খাবারের স্টল। সব মিলিয়ে উৎসবের উপযোগী সাজসজ্জা একাডেমীজুড়ে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, লালন সাঁই, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের সংগীত ও কাব্যের ওপর ভিত্তি করে নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। সাধনার শিল্পীরা ‘অরূপ থেকে রূপ’ নামের এই নৃত্য পরিবেশন করেন।
এরপর আলোচনা পর্ব। বাংলা একাডেমীর সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আলোচনার সূচনা করে বলেন, এ ধরনের উৎসবের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। নতুন সাহিত্য সৃষ্টিতে এই মতবিনিময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলা একাডেমী শুধু দেশের মধ্যেই নয়, সারা বিশ্বে বাংলা সাহিত্যের প্রচার, প্রসার ও বিকাশে কাজ করছে। সেদিক থেকে একাডেমীতে এই উৎসব আয়োজন তাৎপর্যপূর্ণ। উৎসবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত লেখকেরা অংশ নিচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের ও চিন্তাভাবনার বিনিময়ের দুর্লভ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘প্রবল জাতীয়তা বোধ ও দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থার কারণে আমাদের দেশে ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা বেশি দূর এগোয়নি। এ ধরনের সাহিত্য উৎসবে অনুবাদের মধ্য দিয়ে আমাদের সাহিত্যের বিশ্ব অঙ্গনে পরিচিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সাহিত্যের একটি সেতুবন্ধ রচিত হতে পারে।’
এরপর ছিল সাহিত্যিকদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা। বই তাঁদের কেমন করে প্রভাবিত করেছে, সেই অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেছিলেন তাঁরা। এ পর্যায়ে যুক্তরাজ্যের ফিলিপ হেনসার আলোচনার শুরুতেই বাংলা ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে বাঙালির আত্মদান এবং সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত একুশে ফেব্রুয়ারি ইউনেসকোর ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভের বিষয়টি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। নিজের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ১৬ বছর বয়সে চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস তাঁকে দারুণ প্রভাবিত করেছিল।
পরে সেলিনা হোসেন, পাকিস্তানের সাহিত্যিক মোহাম্মদ হানিফ ও ভারতের হার্পার কলিন্স প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক বি কে কার্তিকা আলোচনা করেন।
এরপর ছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইংরেজি ভাষার প্রখ্যাত লেখক বিক্রম শেঠের আলোচনা। বিক্রম শেঠ স্মৃতিচারণা করে বলেন, সাধারণত তিনি সাহিত্য উৎসবে তেমন অংশ নেন না। তবে বাংলাদেশে এই উৎসবটিতে আগ্রহের সঙ্গেই তিনি অংশ নিয়েছেন। কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে পারিবারিক একটি ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে। তাঁর নানি অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের তিনি দার্জিলিংয়ের একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। সেই স্কুলে পড়তে গিয়ে তাঁর মা খ্রিষ্টধর্মের নানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন এবং নান হতে আগ্রহী হন। এরপর তাঁর নানি ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিছুদিনের জন্য খুলনায় চলে আসেন। এবার বাংলাদেশে এসে তিনি খুলনায় গিয়েছিলেন। একটি মজার ঘটনা বলে তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। তিনি যখন মায়ের গর্ভে, তখন তাঁর মায়ের এক বান্ধবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা উপন্যাসটি পড়ে শোনান। উপন্যাসটি তাঁর মায়ের এত ভালো লেগেছিল যে তিনি ঠিক করেছিলেন, ছেলে হলে নাম রাখবেন অমিত এবং মেয়ে হলে অমিতা। কিন্তু তিনি জন্মগ্রহণ করার পর তাঁর বাবা তাঁদের পরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে তাঁর নাম রাখেন বিক্রম। তিনি বলেন, ‘কলকাতায় গেলে সবাই বলে “আমাদের বিক্রম”। এখন ঢাকায় আপনারা আমাকে বলতে পারেন “আমাদের অমিত”।’
হে উৎসবের পরিচালক পিটার ফ্লোরেন্স উৎসবের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, বাংলা একাডেমীতে একুশের যে বইমেলা হয়, তা তাঁকে অভিভূত করেছে। সেই প্রাঙ্গণে হে উৎসহ হচ্ছে, এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালক রোজ মেরি আমন্ত্রিত অতিথিদের ধন্যবাদ জানান।
দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, বাংলা সাহিত্যের যে উন্মেষ, তা বিশ্ব অঙ্গনে পৌঁছে দেওয়া এই উৎসবের একটি প্রধান লক্ষ্য। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশের ইংরেজি ভাষার লেখক তাহমিমা আনাম। ব্রিটিশ কাউন্সিল, বাংলা একাডেমী, দ্য ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, যাত্রীক ও জেমকন গ্রুপের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই উৎসব। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল ময়মনসিংহের ইসলাম উদ্দিন পালাকার ও তাঁর দলের সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল পালার অংশবিশেষ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে।
উৎসবের প্রতিবাদ: এদিকে গতকাল ‘বাংলাদেশের সচেতন কবি, লেখক ও সংস্কৃতি কর্মীবৃন্দ’-এর ব্যানারে কিছু প্রকাশক ও লেখক বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে এই উৎসব আয়োজনের বিরোধিতা করে একাডেমীর সামনে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, বাংলাদেশে হে উৎসব একটি বাণিজ্যিক বা ‘করপোরেট’ উদ্যোগে পরিণত হয়েছে এবং বাংলা একাডেমীর আদর্শের সঙ্গে তা সংগতিহীন।

No comments

Powered by Blogger.