চারুশিল্প: প্রদর্শনী- মাটি ও মানুষের কাছে ফেরা by জাফরিন গুলশান

বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে চলছে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ‘মাটি ও মানুষ’ (অব ম্যান অ্যান্ড আর্থ) শিরোনামে একক চিত্রকলা প্রদর্শনী। সৈয়দ জাহাঙ্গীর ঢাকা চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ, ঢাবি) থেকে ১৯৫৫ সালে বিএফএ শেষ করেন। জন্ম ১৯৩৫ সালে, সাতক্ষীরায়।


চারুকলায় পড়ার সময় শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ বিখ্যাত আভা গ্রার্ড শিল্পীদের। সতীর্থ বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী প্রমুখ প্রতিভাবানের সাহচর্য। জীবনের বিবিধ পটপরিবর্তনের অভিজ্ঞতায়, পথপরিক্রমা শেষে এখন ৮০ বছরে পদার্পণ করেছেন তিনি। তাই এই একক প্রদর্শনীটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
৮০ বছরে পা রাখার কথা মাথায় রেখেই কিনা প্রদর্শনীতে ৮০টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। ছবিগুলো তাঁর ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত সময়ে আঁকা। ফলে দর্শকেরা প্রদর্শনী দেখতে এসে সহযাত্রী হন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের পঞ্চাশের দশকে শুরু করা শিল্পযাত্রার সামগ্রিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে। ছাত্রজীবনের জলরং, তেলরং ড্রয়িংগুলোতে তাই একাডেমিক প্রভাব প্রবল। কারণ, তাঁর শিক্ষকের অধিকাংশই তখন কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে ব্রিটিশ ব্যাকরণে ছবি আঁকার নানাবিধ কলাকৌশল রপ্ত করে, অনেকটা বাস্তবানুগ ফর্মে ছবি আঁকছেন ও সেসব কৌশল ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রদের শেখাচ্ছেন। ক্লাসের স্টিল লাইফ কিংবা বন্ধুর প্রতিকৃতি আঁকার প্রচেষ্টা অথবা আউটডোরে জলরঙে প্রাকৃতিক দৃশ্য অঙ্কনের চিত্রকর্মশালাগুলো, পঞ্চাশের দশকে একজন ছাত্রের শিল্পী হয়ে ওঠার ইতিহাসই যেন ঘোষণা করে। এসব ছবিতে অল্প বয়সী একজন শিল্পীর নানা কৌশল আয়ত্তের চেষ্টা, অনুশীলনের একাগ্রতা, কিছুটা আনাড়িপনা, সরলতা—এসব বিষয়ই যেন মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে ফুটে উঠেছে।
এর পরের চিত্রকর্মগুলো আধাবিমূর্ত আধাবাস্তবানুগ রীতিতে আঁকা। বিশেষত, অ্যাক্রেলিক রং ব্যবহারে করা চিত্রকর্মগুলো এবং সাদা কাগজে কালো কালি ও স্প্যাচুলা দিয়ে দ্রুতগতিতে আঁকা বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের জীবনের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির কথা এখানে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
সৈয়দ জাহাঙ্গীরের কথা হলো: তিনি ১৯৭৩ সাল থেকে বিমূর্তধারায় একনাগাড়ে সিরিজ পেইন্টিং করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, একপর্যায়ে শিল্পী আবিষ্কার করলেন, এ ধারার ছবি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দর্শকের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছে না। ফলে তিনি আবারও মাটি ও মানুষের কাছে ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করলেন। আর তার ফল বাস্তবানুগ ধারার ছবি। তবে শিল্পী স্বীকার করলেন কাজের সময় অবচেতনভাবে কিছু বিমূর্ত অনুষঙ্গ ঢুকেই পড়ে।
তাঁর মতে, ‘এ সময়ের তরুণেরা আমাদের সূচনাপর্বের চেয়ে ভালো ছবি আঁকছে। আর যাঁরা মৌলিক, শেষ পর্যন্ত তাঁরাই টিকে যাবে।’
সৈয়দ জাহাঙ্গীর দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর চারুকলা বিভাগকে সুংগঠিত করার পেছনে। তাঁর মতে, ‘শিল্পকলা একাডেমী হবে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির সুইসবোর্ডের মতো। এর ওপর ভর করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাবেন শিল্পীরা এবং এ ধরনের চিন্তা থেকেই ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো “এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল” চালু করার উদ্যোগ নিই। খুলনা সরকারি আর্ট কলেজ স্থাপনের পেছনেও আমার ভূমিকা আছে। ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে ভ্রাম্যমাণ চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিয়েছিলাম, যাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে চিত্রকর্ম দেখার সুরুচি তৈরি হয়। এই সময়টায় ছবি আঁকতে পারিনি। ১৯৯৩ সাল থেকে আবারও ছবি আঁকছি। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা গ্রামে, তাই আমি আমার অতীত, পারিপার্শ্ব—এসব অভিজ্ঞতার আলোকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসি।’
সৈয়দ জাহাঙ্গীরের চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য হলো: ডিটেইলিং বা পুঙ্খানুপুঙ্খতার পরিবর্তে ছবির ফর্মগুলোতে স্ট্রোক ব্যবহার করে, স্কাল্পচারের মডেলিংয়ের মতো একধরনের কৌশলের প্রয়োগ। হ্যাপি ড্রিম-১৯৫৬, কার্পেন্টার-১৯৫৬, হারভেস্ট-২০০৬, প্ল্যানেট মুভিং-২০০৪, থ্রাস্টি-২০০৯, ফিশারম্যান-২০১০, ইন্টিমেসি-২০১১, অন দ্য মুভ-২০১২ ইত্যাদি পেইন্টিং ছাড়াও ছাপচিত্র করা বেশ কিছু এচিং ও উডকাট রয়েছে প্রদর্শনীতে। অন্যদিকে, শিল্পীর মতে, তাঁর প্রায় সব চিত্রকর্মেই চাঁদ অথবা সূর্য থাকে এবং এটি তাঁর কাজের একটি সাধারণ কর্ম নির্দেশ করে, যা একই সঙ্গে চিত্রকর্মের বৈশিষ্ট্যও।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর রং ব্যবহার করেন মূলত নীল, হলুদ, লাল বা সবুজ এবং এগুলো উপমহাদেশের বহুযুগের লোকশিল্পে ব্যবহূত রঙের স্মারক বহন করে। স্থান বিভাজন, কর্ম বা আঙ্গিককে কখনো বার্ডস আই ভিউ থেকে দেখা এবং বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের কম্পোজিশন লক্ষণীয়। প্রদর্শনী দেখতে দেখতে একজন দর্শক অনুভব করেন, তিনি যেন বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতের দিকে দৃকপাত করছেন, যেমনটা ঘটেছে শিল্পীর নিজের ক্ষেত্রেও। পুরো প্রদর্শনীটি যেন তাঁর দীর্ঘ পথপরিক্রমার সচিত্র উপস্থাপনা। তিনি দর্শককে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন তাঁর এই শিল্পযাত্রায়, নান্দনিক অভিজ্ঞতায় সঙ্গী হওয়ার। উল্লেখ্য, পঞ্চাশের দশকে বিশ্ব শিল্প আন্দোলনের সমান্তরালে আমাদের দেশেও তৎকালীন নবীন শিল্পীদের মধ্যে পরিবর্তনের দিকে যাত্রার সূচনা ঘটেছিল।
শিল্পীর ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষেই এ প্রদর্শনীর আয়োজন। ২ নভেম্বর শুরু হয়ে চলে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.