জন্মশতবার্ষিকী-গান্ধী পরিবার ও ডা. জোহরা বেগম কাজী by জাফরুল্লাহ চৌধুরী

আহমেদাবাদ, ১৯৯২ সাল :অযোধ্যার কথিত রামমন্দিরকে মোগল যুগে বাবরি মসজিদে পরিণতকরণের বিরুদ্ধে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের প্রায় সব প্রদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঝড় বয়ে যায়।


অহিংসবাদের জনক মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর তীর্থভূমি গুজরাটও সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের মহড়া থেকে রক্ষা পায়নি। ক্ষণিকের জন্য হলেও আহমেদাবাদের সবরমতি নদী পারের গান্ধী আশ্রমের হৃৎপিণ্ড যেন হঠাৎ থমকে গিয়েছিল। লজ্জায় যেন গান্ধীর প্রিয় বাবলা গাছ নুইয়ে পড়েছিল। এই বাবলা গাছের তলায় বসে ভারতবাসীর প্রিয় মানুষটি বহুবার সত্যাগ্রহ করেছেন, অনশন করেছেন। ভয় কাটছিল না। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গান্ধী আশ্রমের জীবনযাত্রা। আশ্রমবাসীরা হঠাৎ দেখতে পেলেন ভস্ম থেকে গান্ধীর উত্থান। আকস্মিকতা কাটার পর আশ্রমের কর্মকর্তারা শুরু করলেন শহরে যোগাযোগ। ঘুমিয়েপড়া কিছু বিবেক জাগল। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সব ধর্মের প্রতি পারস্পরিক মমত্ববোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে এক নাগরিক সভার। মূল বক্তা মহাত্মা গান্ধীর পৌত্র দিলি্লর জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজমোহন গান্ধী। উদ্যোক্তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন ঢাকা থেকে আহমেদাবাদ গিয়ে ওই সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য।
আহমেদাবাদের সবচেয়ে বড় টাউন হলে উপস্থিত হয়ে দেখলাম লোকে লোকারণ্য। হল ভরে সামনের উদ্যান ও রাস্তা পর্যন্ত লোকের সমাগম। তবুও খুশির পরিবর্তে যেন মনে হলো, উদ্যোক্তারা উদ্বিগ্ন, খুবই চিন্তিত। আমি মাত্র সভাপতির আসন গ্রহণ করেছি। উদ্যোক্তাদের একজন এসে আমার কানে কানে বললেন, একজন মুসলমানকে সভাপতি নির্বাচিত করায় তারা ক্ষিপ্ত, তাও আবার ভারতীয় নয়, বাংলাদেশি এবং মুসলমান।
আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমি তো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিতে গিয়েছিলাম। সেদিন কেউ আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়নি। বুদ্ধি ও সাহসই ছিল আমার অস্ত্র।
সবাইকে শান্ত হয়ে বসতে অনুরোধ করলাম এবং মূল প্রবন্ধ পাঠের জন্য পাশে উপবিষ্ট অধ্যাপক রাজমোহন গান্ধীকে অনুরোধ করলাম।
অধ্যাপক গান্ধী উঠে দাঁড়িয়ে সবেমাত্র প্রবন্ধ পাঠ শুরু করেছেন। কয়েকজন শ্রোতা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং একযোগে বলে উঠল, প্রফেসর রাজমোহন, তুমি প্রবন্ধে সুন্দর সুন্দর কীর্তন গাইবার পূর্বে আমাদেরকে আওয়াজ করে জানাও, তোমার কাকা ভালো মানুষ রামদাস যে মুসলমান মেয়েকে ভালোবাসতেন, তাকে বিয়ে করেননি কেন? জবাব দাও, মোহনদাস গান্ধীর তৃতীয় ছেলে রামদাস কার জন্য পরবর্তীকালে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকতেন? তোমার বড় কাকা হরিলাল মুসলমান হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়ে গিয়েছিলেন কেন? পরে কি হরিলাল আবার হিন্দু ধর্মে ফেরত এসেছিলেন? শোরগোল বাড়ছেই। অধ্যাপক গান্ধী হতভম্ব্ব হয়ে বসে পড়ার উদ্যোগ নিতেই, মুহূর্তের দ্বিধা ও জড়তা কাটিয়ে আমি সবাইকে হতচকিত করে দাঁড়িয়ে পড়ে মাইক হাতে নিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর এবং উচ্চস্বরে ঘোষণা দিলাম, অনুগ্রহ করে সবাই বসুন এবং শান্ত হোন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই পাবেন। আপনারা যখন চাইছেন রাজমোহন গান্ধী অবশ্যই বিষয়টি আলাপ করবেন। তবে পারিবারিক আলাপ তো জনসভায় হতে পারে না। প্রেম-ভালোবাসার আলাপ হবে নিভৃতে, একান্তে আলাদা ঘরে, যাদের বিষয়টিতে আগ্রহ বেশি তারা থাকবেন।
সভাপতির এ জাতীয় বক্তব্য প্রত্যাশিত ছিল না। হৈচৈকারীরা ঠিক যেভাবে শুরু করেছিল, ঠিক সেভাবে হতচকিত হয়ে থমকে গেল এবং বসে পড়ল। অধ্যাপক রাজমোহন গান্ধীকে প্রবন্ধ পাঠ পুনরায় শুরু করার অনুরোধ করলাম।
হঠাৎ আমি হারিয়ে গেলাম অতীতে_ চোখে ভেসে উঠতে থাকল ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতা। হঠাৎ দেখলাম ভারতের মধ্যপ্রদেশের ছোট শহর ওয়ার্দা। এখানে তো বহুবার কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়েছে। গান্ধী এসেছেন, জওয়াহেরলাল নেহরু, বাল গঙ্গাধর তিলক, ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ, আবদুল গাফফার খান, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মতিলাল নেহরু, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, ডা. আনসারী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী এবং আরও অনেকে এসেছেন। ওয়ার্দায় ত্রিশের দশকের শিক্ষাবিদ ড. জাকির হোসেন তৈরি করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর জন্য ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের শিক্ষানীতি, যা ওয়ার্দা এডুকেশন পলিসি নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। ড. জাকির হোসেন পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তার ছোট ভাই ড. মাহমুদ হোসেন ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ড. জাকির হোসেনের মতো ড. মাহমুদ হোসেনের শিক্ষায় অনুরাগ এবং শিক্ষা বিস্তারে তার প্রাণবন্ত প্রচেষ্টার কথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পুরনো ছাত্র-শিক্ষক অনেকের মনে থাকার কথা।
সেবাগ্রাম হলো গান্ধী পরিবারের দ্বিতীয় বাসস্থান_ ড. জাকির হোসেনের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি মহাত্মা গান্ধীর এত পছন্দ হলো যে, ওয়ার্দার কাছে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য মনস্থির করলেন এবং সেবাগ্রামে তার দ্বিতীয় বাসস্থান বানালেন। গান্ধীর উন্মুক্ত বাড়িতে খেলতে আসতেন গান্ধীর সন্তানদের সঙ্গে বিশেষ করে রামদাসের বন্ধু কাজী আশরাফ এবং তার ছোট বোনেরা। কাজী আশরাফের পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তারের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনিতে। পিতার কর্মস্থল মধ্যপ্রদেশের করদ রাজ্য রাজনানগায়ে ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর শ'ওয়ালেস কটন মিলের ছোট হাসপাতালে জোহরা কাজীর জন্ম। জন্মকালে ধাত্রী ছিলেন পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তার। জোহরার জন্মের তিন বছর পর জানুয়ারি ১৯১৫ সালে ব্যারিস্টার মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান থেকে জাহাজে চড়ে ভারতের বোম্বাইতে নামেন। দুই বছর পর হঠাৎ একদিন গান্ধী ক্যানভাস ব্যাগ, লোটা, কম্বল নিয়ে ধুতি পরে গায়ে গামছা জড়িয়ে ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় চড়ে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরলেন, উপলব্ধি করলেন ভারতবাসী এবং তাদের অন্তর্মুখী জীবন ও দারিদ্র্য। খুঁজে বের করলেন তার নতুন আস্তানা আহমেদাবাদ; যেখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান জোরাস্টিয়ানরা বসবাস করে।
দুষ্টু-চঞ্চল জোহরার জীবন : জোহরা কাজী রায়পুর বার্জিস মেমোরিয়াল মিশনারি স্কুলে পড়তেন। মিশনারি স্কুলে পড়া এবং ব্রিটিশ সাহেবদের ছেলেমেয়ের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপের কারণে জোহরা হলেন সাহসী ও সাবলীল এবং ইংরেজি হলো প্রথম ভাষা। রায়পুর স্কুল শেষ করে জোহরা ভর্তি হলেন আলিগড় দারুল উলুম অ্যাংলো মোহামেডান কলেজে। উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে কলেজের পর্দার আড়ালে থেকে পড়াশোনা ও মৌখিক পরীক্ষা দিতে দিতে উন্মুক্ত বিহঙ্গনা খাঁচায় বন্দি হয়ে হাঁফিয়ে উঠতে থাকলেন। ছুটি পেলেই ছুট রায়পুর পিতার কর্মস্থলে। অব্যাহত থাকে ছুটির দিনে ভাই আশরাফের সঙ্গে সেবাগ্রামে বেড়াতে আসা। টানা টানা দুষ্টু দৃষ্টি, তন্বী উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গিনী জোহরার পাশে পাশে ঘুরঘুর করেন যুবক রামদাস। আশরাফ, মণিলাল, রামদাস, দেবদাস, জোহরা, ছোট বোন শিরীন কাজী ও আরও অনেককে একত্রে বসিয়ে খাওয়াতেন গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরীবাঈ। এদের একসঙ্গে খাওয়ানো দেখে আনন্দ পেতেন মহাত্মা গান্ধী। কয়েকদিন না গেলে গান্ধী জোহরার জন্য ডা. কাজী আবদুস সাত্তারের বাড়িতে খাবার পাঠিয়ে দিতেন। ১৯৩৫ সালে দিলি্লর লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়ে জোহরা পেলেন ভাইসরয় পুরস্কার। পাস করে মেডেল দেখাতে ছুটে গেলেন সেবাগ্রামে। গান্ধীর পদধূলি নেওয়ার সময় গান্ধীজি বললেন 'জোহরা, কখনও ভয় পাবে না। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না। মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচবে। জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো আদর্শ।'
গান্ধীজির প্রভাবে পিতা কাজী ডা. আবদুস সাত্তার কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ডাক্তারির ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিভিন্ন স্থানে গিয়ে কংগ্রেস অনুষ্ঠানে যোগ দেন, আর্থিক সাহায্য করেন। কন্যা জোহরা সব সময় মন্দিরের জন্য ফুল সংগ্রহ করে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে আসতেন পিতার বন্ধুর মন্দিরে। বাড়িতে উল্লাস_ মেয়ে ডাক্তার হয়েছে। প্রথম বাঙালি মুসলমান এমবিবিএস ডাক্তার। সবার মুখে আনন্দ; কিন্তু বাবার চোখে পানি কেন? মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাবা বলে চললেন, 'তোর কি মনে আছে জোহরা? আমাদের পাশের বাড়ির মহিলা সন্তান প্রসবের সময় মারা গিয়েছিলেন? আমি বড় ডাক্তার, ভালো ডাক্তার, সার্জন কিন্তু ধাত্রীবিদ্যায় বকলম, তদুপরি পুরুষ বলে অন্তঃপুরে ডাক্তারের প্রবেশ নিষেধ। আমাদের নার্স ও গ্রামের ধাইয়ের সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। আমি নীরব দর্শক হিসেবে চেয়ে চেয়ে দেখলাম। আমি আর প্রসূতির মৃত্যু দেখতে চাই না। জোহরা, তুই ধাত্রীবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হলে আমার ব্যর্থতার গ্গ্নানি ঘুচবে, ব্যথা কমবে, ঘুচবে বেদনা।'
জোহরার পিতা কাজী আবদুস সাত্তারের মাদারীপুরের কালকিনি থানার গোপালপুরে পৈতৃক বাসস্থান। জমিদারতুল্য বৈভব পিতা জমির উদ্দিনের। সাত্তারকে সমগ্র ভারতের সর্বোচ্চ মাদ্রাসা শিক্ষার পাদপীঠ দেওবন্দে পাঠালেন। কিন্তু বিদ্রোহ করে পালিয়ে বিত্তবান পিতা জমির উদ্দিনের অমতে ঢাকা ফিরে সদরঘাটে অবস্থিত পগোজ স্কুলে ভর্তি হলেন আবদুস সাত্তার। তিনি পরবর্তী সময়ে ১৮৯৫ সালে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল থেকে এলএমএফ (লাইসেনসিয়েট ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি) পাস করেন। আরও পরে কলকাতার কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস থেকে পাস করে 'সার্জনস অব ইন্ডিয়া' (এমবিবিএস সমতুল্য) সনদপ্রাপ্ত হন। ১৯১৭ সালে প্লেগ রোগে বোম্বাই, পুনা ও আহমেদাবাদের সব কলকারখানার শ্রমিক ডজনে ডজনে মারা যাচ্ছিল। তিনি প্রতিদিন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কারখানার ম্যানেজার ও সুপারভাইজারকে নিয়ে সকাল ও বিকেলে কলকারখানা ফিটকিরি ও কার্বোলিক এসিড দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কারের ব্যবস্থা নিতেন। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ায় সাদাসিধে মা আঞ্জুমান আরার অবদানও কম নয়। মেয়েদের শিক্ষায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য তিনি নিজে রায়পুর থেকে বিএ পাস করেন। তিনি রায়পুর পৌরসভার কমিশনারও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমবিবিএস পাসের কিছুদিনের মধ্যে বৃত্তি নিয়ে ডা. জোহরা বেগম কাজী লন্ডন চলে গেলেন। লন্ডনের রয়েল কলেজ অব গাইনোকোলজিস্ট থেকে ডিআরসিওজি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসে গাইনিকোলজিস্ট ডা. জোহরা কাজী আগের মতোই ছুটে যান গান্ধীজির পদধূলির জন্য। সেখানেও হঠাৎ রামদাসের উপস্থিতি ও পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
ইতিমধ্যে তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সুশীলা নায়ার কস্তুরীবাঈ ন্যাশনাল মেমোরিয়াল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন ডা. জোহরাকে সঙ্গে নিয়ে। সুশীলা হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং জোহরা অবৈতনিক সেক্রেটারি। সুশীলা নায়ার লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিকেল কলেজে জোহরার সতীর্থ ছিলেন এবং এমবিবিএস ফাইনাল পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। প্রথম হয়েছিলেন জোহরা বেগম কাজী। সুশীলা সবসময় গান্ধী পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বাপুজির চিকিৎসক হিসেবে। ডা. সুশীলা নায়ার নেহরু মন্ত্রিসভার প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।
ডা. সুশীলা নায়ারের সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে দিলি্লতে এবং সেবাগ্রামে। সেবাগ্রামের কস্তুরীবাঈ মেমোরিয়াল হাসপাতাল বর্তমানে মেডিকেল কলেজে উন্নীত হয়েছে। সেখানে মেডিকেল শিক্ষা ও গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে মূল বক্তার ভাষণ দিতে আমি একাধিকবার সেবাগ্রাম গিয়েছি। সভায় সভাপতিত্ব করেছেন ডা. সুশীলা নায়ার। প্রতিবার দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডা. সুশীলা নায়ার প্রথমে এক নিঃশ্বাসে জিজ্ঞাসা করেন, 'আমার বন্ধু কেমন আছে? সে কি জানে আমার সাথে তোমার দেখা হবে? আগের মতো মেয়েদের স্বাস্থ্য উন্নয়নে জোহরা পাগলের মতো কাজ করে?'
স্বরাজ ও ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের দাবিতে সারা ভারতে চলছে আন্দোলন, চলছে সত্যাগ্রহ। ১৩ এপ্রিল ১৯১৯। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে হঠাৎ নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ডায়াসের হুকুমে ২৫ জন সৈনিক ১০ মিনিটে ১৬০০ রাউন্ড গুলি ছুড়ে ৩৭০ জন নিরীহ জনতাকে হত্যা করে এবং ১১৩৭ জনকে গুরুতর আহত করে। সারা পৃথিবী ধিক্কার দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজকীয় পদবি ছুড়ে ফেলে দিলেন।
গান্ধী শুরু করলেন সত্যাগ্রহ। ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করো, লবণ তৈরি করো। মহাত্মা গান্ধী ও কস্তুরীবাঈ_ সবাই সুতা কাটছেন, নিবেদিতা চরকা সাজাচ্ছেন। আরও অনেককে দেখছি ঠিকমতো চিনতে পারছি না। গান্ধী দীর্ঘ সময়ের জন্য জেলে। পায়ের কাছে বসে কস্তুরীবাঈকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন জোহরা, ঠিক নিজের মেয়ের মতো।
শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। বঙ্গ-বিহারে দুর্ভিক্ষ। অগণিত জনতার মৃত্যু, সর্বত্র হাহাকার। কলকাতায় গৃহবন্দি সুভাষ বসু। কাজী আশরাফের দল কমিউনিস্ট পার্টি নিঃশর্তে ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। মহাত্মা গান্ধী দ্বিধাগ্রস্ত। রামদাসকে নিয়ে পিতা চিন্তিত। প্রিয় পুত্র রামদাসকে নিয়ে অনেক গুঞ্জন, মুখরোচক কাহিনী পল্লবিত হয়ে শাখা-প্রশাখা ছড়াচ্ছে। জেল থেকে বেরিয়ে মহাত্মা এসব কী শুনছেন?
গান্ধীজি ও ডা. জোহরা বেগম কাজী :একি! খালি গায়ে খালি পায়ে করজোড়ে মহাত্মা গান্ধী দাঁড়িয়ে কেন? সামনে কে? ছবি পরিষ্কার হলো। সামনে ক্ষীণকায় উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গিনী, তীক্ষষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত অকুতোভয় ডা. জোহরা কাজী। 'বাপুজি, আপনি এ কী করছেন?' 'জোহরা, তুমি আমাকে ভিক্ষা দাও। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও রামদাসকে। আমি কারও কাছে কখনও দয়া ভিক্ষা করিনি। আজ তোমার কাছে দয়া চাচ্ছি। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না জোহরা, তুমি আমাকে ভিক্ষা দাও। রামদাস তোমাকে বিয়ে করলে ভারতে আগুন জ্বলবে। আমার মুখ থাকবে না। মা জোহরা, তুমি আমাকে ভিক্ষা দাও।' পাশে কাঁদছেন কস্তুরীবাঈ।
জোহরার চোখের আলো আরও দীপ্ত হলো। তিনি কী দেখছেন, এ কী শুনছেন! ধীরে ধীরে তার ঠোঁট নড়ছে কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না। মনে পড়ছে এমবিবিএস পাস করে পদধূলি নেওয়ার সময় বাপুজি তাকে বলেছিলেন, 'জোহরা কখনও ভয় পাবে না। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না। শত্রুরা তোমার কী করবে? বড়জোর জীবনটা নেবে। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হলো আদর্শ।' বাপুজি ও কস্তুরীবাঈয়ের পদধূলি নিয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন জোহরা। আরও কয়েক বছর তার কেটে গেল নীরবে-নিভৃতে মধ্যপ্রদেশের সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে নিরন্ন দরিদ্র মহিলাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সাধনায়। প্রসূতিসেবায় অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটালেন জোহরা।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে বাসস্থান থেকে দিলি্লর কনট প্যালেসের অদূরে বিড়লা ভবনের মন্দিরে যাওয়ার পথে মহারাষ্ট্রের ৩৬ বছর বয়স্ক কট্টর হিন্দু নাথুরাম বিনায়েক গডসে সরাসরি তিনবার বুকে গুলি করল হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টির প্রয়াসের মহানায়ক মহাত্মা গান্ধীকে। গান্ধী ক্লিষ্টস্বরে আওয়াজ করলেন_ আই, রাম। ধরাধরি করে সঙ্গীরা তাকে নিয়ে গেলেন বিড়লা মন্দিরে। নাথুরাম গডসের গুলিতে নিহত হলেন ধর্মের নামে অবিবেচক অনুশাসনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, অহিংসবাদী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। পিতার পূর্ব নির্দেশ ও ইচ্ছার কারণে রামদাস শবদেহে অগি্নসংযোগ করলেন। পাশে ছিলেন দেবদাস।
খবর শুনে জীবনে প্রথম কাঁদলেন জোহরা। কান্না কি গান্ধীর প্রয়াণে, না অতীতে গান্ধীর নিজের আদর্শের পদস্খলনের জন্য? গান্ধীজি কি ভয় পেয়েছিলেন? সামাজিক অনুশাসনের ভয়? না, যা প্রচার করতেন তা বিশ্বাস করতেন না? ধর্মের জিঞ্জির বড় কঠিন। দেখছি একই বছরের শেষে মা আঞ্জুমান আরা, বড়ভাই কাজী আশরাফ, ডা. শিরিন কাজী ও পরিবারের অন্যদের নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন ডা. জোহরা বেগম কাজী ঢাকার পথে। আচমকা প্রচণ্ড আওয়াজে আমার স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে গেল। তাকিয়ে দেখি সবাই দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে। অধ্যাপক রাজমোহন গান্ধী মাথা সামান্য নত করে অভিনন্দন গ্রহণ করছেন। চোখে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতার আভাস।
ঢাকায় ফিরে আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজীর সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে সভার পুরো ঘটনা এবং হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে আমার স্বপ্ন দেখার কথা বললাম। তিনি হাসলেন, কোনো উত্তর দিলেন না। তাকিয়ে দেখি হঠাৎ তার চোখে জল। চোখের পানি কার জন্য? রামদাসের জন্য? না বাপুজির হঠাৎ আদর্শচ্যুতির ব্যথায় কিংবা নিজের ত্যাগের মহিমার আনন্দে?
বিচিত্র এই পৃথিবী! অধ্যাপক, আপনার শিক্ষায় আমি সাহসী। আপনার জন্মশতবর্ষে আপনার অগণিত ছাত্র-ছাত্রীর অন্যতম সাহসী ছাত্রের বিনীত শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী : নির্বাহী পরিচালক
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

No comments

Powered by Blogger.