রাজনীতি- সময়মতো ভুল স্বীকার করা মঙ্গল by আবদুল মান্নান

দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে ভুল করা অস্বাভাবিক নয়, তবে যাঁরা এসব ভুল করেন, সময়মতো তাঁরা সেই ভুল স্বীকার করেন না। এই না করার কারণে তাঁরা দেশের, দলের ও নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের মারাত্মক ক্ষতি করে বসেন। আর যখন ভুল হয় তখন সময়মতো তা স্বীকার করে নিয়ে নিজেকে কদাচিৎ তাঁরা সংশোধন করতে আগ্রহী হন।


কারণ, তাঁরা তখন ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন থাকেন। অনেক সময় এই না পারার অন্যতম কারণ, যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তাঁরা কিছু মোসাহেব ও স্তাবক দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন। ‘রাজা (শাসক) কখনো ভুল করতে পারেন না’— তাঁরা এই মন্ত্রে বিশ্বাস করেন।
সম্প্রতি খালেদা জিয়া তাঁর দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় স্বীকার করেছেন, ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টা করা ছিল তাঁর একটা ভুল সিদ্ধান্ত। এই ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই এক-এগারো অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং তাঁর নিজের আর দলের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। শুধু এই একটি বিষয় নয়, আরও অনেক ভুল তিনি তাঁর শাসনামলে করেছেন, যা হয়তো তিনি স্বীকার করার প্রয়োজন মনে করেননি। সবচেয়ে বড় ভুল ছিল সম্ভবত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সব ধরনের পরামর্শ চোখ বন্ধ করে শোনা। আমার মনে হয়েছে, ব্যারিস্টার মওদুদ একজন ভালো মানের গবেষক হতে পারতেন এবং তিনি তাঁর সেই যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বমানের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিবিজ্ঞান বিষয়ের একজন ভালো অধ্যাপকও হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে রাজনীতিতে এসে অনেক খারাপ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।
ফিরে আসি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রসঙ্গে। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জনপ্রিয় শিক্ষক, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে হয়ে গেলেন বাংলাদেশের রাজনীতির বড় মাপের খলনায়ক। তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি সেই আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। মনে হয়েছে সাদামাটা নির্মোহ ব্যক্তি। রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্ষদে শিক্ষকদের সমর্থনে নির্বাচিত হয়েছেন একাধিকবার। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে তিনি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হলে তিনি একজন উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা খুবই ভালো ছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়া বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে তিনি ড. ইয়াজউদ্দিনকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন। খালেদা জিয়ার এই গুণটির প্রশংসা করতে হয়। তিনি তাঁর দল বা মতাদর্শকে যাঁরাই বাইরে থেকে সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন।
অন্যদের ক্ষেত্রে এ মন্তব্য খুব জোরালোভাবে বলা যাবে না। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলেও তিনি ড. ইয়াজউদ্দিনকে তাঁর মেয়াদ পূরণ করতে দিয়েছেন। তিনি এ ধরনের পদে যাঁরাই অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাঁদের সবাইকে নিজ নিজ মেয়াদ পূরণ করতে দিয়েছেন। এটি শেখ হাসিনার প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত ছিল। তবে খালেদা জিয়া দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বঙ্গভবন থেকে অত্যন্ত অসম্মানভাবে বিতাড়ন করে ড. ইয়াজউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দিলে তাঁর একটি চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে। অনেকে বলে থাকেন, আসলে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি করতে চেয়েছিলেন ড. এমাজউদ্দীন আহমদকে এবং তদনুযায়ী তাঁকে খবর দিতে বলেছিলেন। কিন্তু যিনি এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তিনি ভুলে হোক আর ইচ্ছাকৃত হোক, খবরটা নিয়ে গিয়েছিলেন ড. ইয়াজউদ্দিনের কাছে। ঘটনা যা-ই হোক, ড. ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি হয়েও নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে চিন্তা করতে পারেননি। তিনি একজন দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ। তবে তাঁর সহকর্মীরা বলে থাকেন, তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি কারও ক্ষতি হোক তেমন কাজ করতেন না। তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল কিন্তু শত্রু ছিল না। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি একজন সম্পূর্ণ নতুন ব্যক্তি। রাষ্ট্রপতির পদটা ছিল তাঁর জন্য খুব বেশি বেমানান এবং অত্যন্ত ভারী, যার ওজনে তিনি ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি সব সময় মনে করতেন, তাঁর ওই পদটি তিনি খালেদা জিয়ার করুণায় পেয়েছেন এবং তাঁর কাজই হচ্ছে তাঁকে সন্তুষ্ট রাখা। তাঁর এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে খালেদা জিয়া তাঁকে প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। এটি ছিল তাঁর (ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ) দুর্বল ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ।
খালেদা জিয়া প্রথম বড় ভুলটি করেছিলেন তাঁর আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদের পরামর্শে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বৃদ্ধি করে, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, তাঁদের পছন্দমতো একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। এই একটি অপরিণামদর্শী পদক্ষেপই বহু সংকটের জন্ম দিয়েছে। সময়মতো পরিস্থিতি অনুধাবন করে তিনি যদি প্রয়োজনীয় বাস্তবমুখী ব্যবস্থা নিতে সচেষ্ট হতেন, তাহলে তিনি ২০০৭ সালের নির্বাচনে (যে নির্বাচনটি হয়নি) ক্ষমতায় আসতে না পারলেও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানটা ধরে রাখতে পারতেন।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে অনেক নেতাই সময়মতো বাস্তব অবস্থা বুঝতে পারেন না, আর যখন বোঝেন তখন সময় শেষ এবং অনুতপ্ত হওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। ড. ইয়াজউদ্দিন যদি দেশের ওই সংকটকালে একটু মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতেন এবং নিজের সাংবিধানিক দায়িত্বটুকু সুচারুভাবে পালন করতে সচেষ্ট হতেন, তাঁকে ইতিহাসের কাছে খলনায়ক হতে হতো না। খালেদা জিয়া বিগত শাসনকালে শুধু যে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারেননি, তা-ই নয়, তিনি আরও অনেক অমার্জনীয় ভুল করেছেন। তিনি দেশকে জঙ্গিবাদীদের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা জুগিয়েছেন, নিজের সন্তান তারেক রহমানকে অনেকটা বিকল্প প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে হাওয়া ভবন থেকে দেশ শাসনের সুযোগ করে দিয়েছেন, নিজের ভাইকে সামরিক প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করতে দিয়েছেন, দলীয় ক্যাডারদের হাতে দেশের আইনশৃঙ্খলা ইজারা দিয়েছেন এবং দেশের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতিকে একটি ‘শিল্পে’ পরিণত করেছেন। সময়মতো তিনি এসব ভুল স্বীকার করে নিলে তাঁর ও জাতির জন্য অনেক মঙ্গল হতো।
অনেকে প্রশ্ন করবেন, বর্তমান সরকার কি ভুল করছে না? অবশ্যই করছে। এই সরকারের অনেক বড় অর্জন আছে, তবে ভুলও কম নয়। শুধু যাঁরা একেবারেই দলকানা, তাঁরা এসব ভুল সময়মতো দেখতে ব্যর্থ হন, দেশ ও দলের ক্ষতি করেন আর যখন তা উপলব্ধি করেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সময়ও শেষ হয়ে গেছে। তখন শুধু আফসোস করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। তবে সেই ভুলের খেসারত যত-না দিতে হয় দলের নেতা-নেত্রীদের, তার চেয়ে বেশি দিতে হয় সাধারণ কর্মী আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের। এ মুহূর্তে কেউ যদি প্রশ্ন করে এই সরকারের বড় ভুলের কথা বলতে, আমার উত্তর হবে, যেভাবে গ্রামীণ ব্যাংক আর ড. ইউনূসকে নিয়ে টানাহেঁচড়া হচ্ছে, তা কখনো প্রত্যাশিত নয়। আমি নিজে গ্রামীণ ব্যাংক কার্যক্রমের তেমন সমর্থক নই। তাতে কিছু আসে-যায় না। ঠিক হোক আর বেঠিক হোক, গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণব্যবস্থা আর ড. ইউনূসকে আন্তর্জাতিক মহল স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তিনি ও গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের জন্য নোবেল পুরস্কার বয়ে এনেছেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গিয়ে ড. ইউনূসকে পুষ্পস্তবক দিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে এসেছিল। ড. ইউনূসের রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে কিন্তু সাধারণ মানুষ মনে করে, গ্রামীণ ব্যাংক বা ড. ইউনূস সম্পর্কে সরকার যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে বা নেওয়ার কথা বলছে, তাতে তাদের ভাষায় মানির অপমান হচ্ছে এবং সরকার বেহুদা নিজের শক্তির অপচয় করছে। এটি কাঙ্ক্ষিত নয়। আমার এই কথায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী বেজায় নাখোশ হবেন কিন্তু পথে-ঘাটে, তার জেলা চট্টগ্রামে যেসব কথা হয়, সেসব তো সরকারের উঁচু পর্যায়ে পৌঁছায় না। কাউকে না কাউকে বলতেই হবে। এ রকম অনেক ভুল তো সরকার বা সরকার-সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা হরহামেশা করছেন। এসব ভুল শুধরানোর সময় তো এখনই। আর এটিও ঠিক, ড. ইউনূস পুরো বিষয়টাকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত রি-অ্যাকশন প্রদর্শন করছেন।
শাস্ত্রে আছে, একজন ব্যক্তিকে যখন ঈশ্বর রাজ্য শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করেন, তখন তিনি সেই ব্যক্তির চিন্তা-চেতনার কিছু অংশ বিকল করে দেন, যাতে তিনি প্রয়োজনে কিছু ভালো মানুষের পরামর্শ নেন। এসব মানুষ বিজ্ঞ, সৎ, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী হওয়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। যে শাসক যত বেশি এ ধরনের পরামর্শদাতা নিজের সঙ্গে রাখতে পারেন, সেই শাসক তত বেশি সফল। এই উপমহাদেশে যত শাসক, সম্রাট বা রাজা-বাদশা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক সফল হিসেবে দুজনের নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। একজন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০-২৯৮) আর দ্বিতীয় জন মোগল সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫)। তাঁদের উভয়ের পরামর্শদাতাদের বলা হতো নবরত্ন অর্থাৎ প্রত্যেক পরামর্শকই একেকজন রত্ন ছিলেন। সুতরাং আধুনিক কালে যখন একজন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী তাঁর পারিষদদের ঠিকমতো বাছাই করতে পারেন, তখন প্রথমে তিনি নিজে উপকৃত হন এবং সার্বিকভাবে উপকৃত হয় দেশ ও জনগণ। ক্ষমতা হারিয়ে ভুল স্বীকার করার চেয়ে সময় থাকতে ভুলকে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অনেক বেশি মঙ্গল। কথাটি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা অতীতে ছিলেন, বর্তমানে আছেন বা ভবিষ্যতে আসবেন, তাঁদের সবার জন্য প্রযোজ্য।
শেষ করি দ্বাদশ শতকের বিখ্যাত মুসলমান দার্শনিক ইমাম গাজ্জালির গ্রন্থ নসিহাত-ই-মুলক (রাজ্য শাসকদের জন্য পরামর্শ) থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি লিখছেন: ‘তোমার (শাসক) পূর্বে যাহারা আসিয়াছিল তাহারা সকলে আমাদের মাঝ হইতে চলিয়া গিয়াছেন। যাহারা আসিবেন তাহারাও নির্ধারিত। তাহারা আসিবার পূর্বে তোমার শাসনকালে সাধারণ মানুষের কাছে এমন ধারণা সৃষ্টি করিবে যাহাতে তাহারা পরবর্তী কালে তোমার অনুপস্থিতি অনুভব করে।’
সকল পাঠককে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.