শ্রদ্ধাঞ্জলি- মুক্তির জন্য যুদ্ধ by মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)

লেখার শিরোনামটি ধার করেছি কর্নেল শাফায়াত জামিলের কাছ থেকে, তাঁর অনুমতি ছাড়া। তিনি যে জগতে আছেন, সেখানে কোনো যোগাযোগের সুযোগ নেই। এটি তাঁর প্রথম বইয়ের নাম। শাফায়াত জামিল সেনাবাহিনীতে কমিশন পান ১৯ এপ্রিল ১৯৬০ চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এই ছোট্ট লেখাটি মুক্তিযোদ্ধা মেজর শাফায়াত জামিলকে নিয়ে। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানিরা গণহত্যা শুরু করে। তাদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল সেই সব স্থান, যেখান থেকে প্রতিরোধ আসতে পারে। পাঁচটি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন, ইপিআর, পুলিশ (রাজারবাগ ও জেলা পুলিশ লাইন) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসমূহ। কৌশলের অংশ হিসেবে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য অজুহাতে প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি উপ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে ২৩ মার্চ কথিত নকশাল অনুপ্রবেশ প্রতিহত করতে শমশেরনগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার আগে ১ মার্চ দুটি কোম্পানি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই দুটি কোম্পানি ছিল মেজর শাফায়াত জামিল ও মেজর সাদেক নওয়াজের (অবাঙালি) অধীনে। ২৫ মার্চ অধিনায়ক লে. কর্নেল মালিক গিজার হায়াত খান (অবাঙালি) ব্যাটালিয়নের বাকি সৈন্যসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছান। ২৬ মার্চ মেজর শাফায়াত শমশেরনগরে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ওয়্যারলেসে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিদ্রোহ করার নির্দেশ পেয়ে যান। ২৭ মার্চ তাঁবুতে স্থাপিত অফিস এলাকায় সব সতর্কতা অবলম্বন করে মেজর শাফায়াত জামিল বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন। এর কিছুক্ষণ আগে কোম্পানীগঞ্জ পাবলিক কল অফিস থেকে এক অজ্ঞাত দেশপ্রেমিক তাঁকে টেলিফোনে জানান, পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই ১২টি আর্মির ট্রাক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে যাচ্ছে। মেজর শাফায়াত জামিল, লে. কবীর ও লে. হারুন ছিলেন সশস্ত্র। মেজর শাফায়াত জামিল অধিনায়ক লে. কর্নেল মালিক খিজার হায়াত খানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ইউ হ্যাভ ডিক্লেয়ার্ড ওয়ার অ্যাগেইনস্ট দি আনআর্মড পিপল অব আওয়ার কান্ট্রি। পার্পেট্রেইটেড জেনোসাইড অন আওয়ার পিপল। আন্ডার দ্য সারকামস্ট্যান্সেস, উই ওউ আওয়ার এলেইজিয়ান্স টু দ্য পিপল অব বাংলাদেশ অ্যান্ড ইলেক্টেড রিপ্রেজেন্টেটিভস। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। ইওর পার্সোন্যাল সেফটি ইজ মাই রেসপন্সিবিলিটি। প্লিজ, ডু নট ট্রাই টু ইনফ্লুয়েন্স আদারস।’
(কর্নেল শাফায়াত জামিল, মুক্তির জন্য যুদ্ধ, কলম্বিয়া প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ: ২১)
টেবিল উল্টে গেল, বিদ্রোহ সম্পন্ন হয়ে গেল। ২২, ২৩ ও ২৪ এপ্রিল আখাউড়া, গঙ্গাসাগর, সিংগারবিল এলাকায় তুমুল যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন তিনি। অতঃপর ২৮ এপ্রিল মেজর খালেদের নির্দেশে ব্যাটালিয়নসহ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা জেলার সোনামুড়া, মধুকুমার সীমান্তবর্তী স্থান মতিনগরে অবস্থান নেন। এখানেই ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার ছেলে যুদ্ধে যোগ দিতে উপস্থিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ শুরু হয় এখানে। অথচ কিছুই ছিল না মতিনগরে। আহার, বাসস্থান, পানীয়—কিছুই না। এত অভাবেও প্রশিক্ষণার্থী মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো রা ছিল না।
১৫ মে তিনি আগরতলা ত্যাগ করেন কলকাতার উদ্দেশে। সেখান থেকে হিলি সীমান্তের ভারতীয় এলাকা কালুরঘাটে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মেঘালয়ে তেলচালায় জড়ো হয়। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল পৌঁছায় ১৭ জুন। প্রশিক্ষণ শেষ হয় ২৮ জুলাই। প্রথম ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় যথাক্রমে ৩১ জুলাই কামালপুরে এবং ৩ আগস্ট নকশী বিওপি দখল করার। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ৩১ জুলাই বাহাদুরাবাদ ঘাট ধ্বংস এবং ঘাটটি অচল করে দেওয়ার। ৩১ জুলাই থেকে তিন দিনের এই অভিযানে মেজর শাফায়াত ৪০০ সৈন্য নিয়ে বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট ও দেওয়ানগঞ্জ শত্রু অবস্থান আক্রমণ করেন। ৫ আগস্ট থেকে ১০ অক্টোবর তিনি রৌমারী থানা ও দেওয়ানগঞ্জের কিছু অংশ মুক্ত করেন। রৌমারীতে শেদালকাটিয়া যুদ্ধসহ কয়েকটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এলাকাটি মুক্তাঞ্চল হিসেবে রাখতে সক্ষম হন মেজর শাফায়ত জামিল। ২ থেকে ৫ অক্টোবর প্রায় ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বকশীগঞ্জে অবস্থিত পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। ৮ অক্টোবর ২০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বিলমারী ঘাট রেইড করেন। ১৩ অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর গোটা তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে তিনি ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও দোয়ারাবাজার দখল করেন। এই অপারেশনে ৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী ও তাঁর যোদ্ধারা সহায়তা করেন। ২২ অক্টোবর থেকে ২৭ নভেম্বর মেজর শাফায়াত জামিল সিলেটের আলুটিকা বিমানবন্দর ও গোয়াইনঘাট এলাকায় যুদ্ধ করেন। ২৮ নভেম্বর গোয়াইনঘাটের উত্তরে ছোটখেল দখল করেন এক রক্তক্ষীয় যুদ্ধে। এই যুদ্ধে তিনি আহত হয়ে শিলং মিলিটারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১৫ ডিসেম্বর সিলেটের লামাবাজী ফেরিঘাটের কাছে পুনরায় তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন তিনি।
মেজর শাফায়াত জামিল ছিলেন প্রচারবিমুখ, নিরহংকার ঋজু এক সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস তাঁর পরিধান ছিল লুঙ্গি আর হাফ শার্ট। স্বদেশপ্রেমে ঋদ্ধ কর্মঠ এই যোদ্ধা ছিলেন বিরামহীন। শেষতক বিরাম এল ১১ আগস্ট ২০১২।
হে যোদ্ধা, তোমাকে সালাম, প্রাণভরা দোয়া।
মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)
মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও লেখক। চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক, সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়্যার স্টাডিজ। cblws@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.