স্মরণ- তারেকের ছবি, মিশুকের মুখ by মাহ্ফুজা শীলু

আজ বেশ কিছুদিন মঞ্জুলী ঢাকায়। এই এতক্ষণ ওর সঙ্গে কথা হলো। আগেও অনেকক্ষণ টরন্টো-ঢাকা কথা হতো। তবে এমন দীর্ঘ বোধহয় নয়। সে প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের ওপরে। বিষয়: আমাদের ছাত্রজীবন, বন্ধুতা, আমাদের আলো লাগা, ভালো লাগা দিনের বহু স্মৃতি, বহু আনন্দ। শেষে এসে মিশুক। সবটাই মিশুক।


‘মিশুকের মুখ’ নামে একটি লেখা প্রায়ই আমি মনে মনে তৈরি করি। শেষ পর্যন্ত আর হয় না। একা ভাবনায় কথাগুলো যত মন দিয়ে মনে মনে লিখে ফেলি, লিখতে বসে সেটা হবে না বুঝতে পেরে আর লিখতেই বসি না।
মিশুকের মতো এত বুদ্ধিদীপ্ত, সুন্দর মুখ সচরাচর চোখে পড়ে না। ওর সৌন্দর্য ছিল ওর সহজ ব্যবহারে। যত বয়স বেড়েছে, ওর সৌন্দর্য তত বেড়েছে। সঙ্গে মজাদার কথার দুষ্টুমি। সেটাও শুধুই আনন্দিত করে। কখনো কোনো বেদনার জন্ম দেয় না। মিশুকের কথা বলতে গিয়ে আমি কিছুতেই অতীতকাল ব্যবহার করতে পারছি না।
মিশুক প্রতিদিন নিজেকে তৈরি করেছে। তার সাহচর্যে এসে অনেক মানুষ নিজেকেও তৈরি করেছে। মিশুকের মুখ নিয়ে লিখব স্থির করেছি ঠিকই, হঠাৎ মঞ্জুলীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বদলে গেল সিদ্ধান্ত। এই শিরোনামে সবটা মিশুক নিয়েই না-হয় লিখি। মঞ্জুলীকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি কে, কখন কীভাবে প্রথম ওরা পরস্পরকে ভালো লাগার কথা জানিয়েছিল। বহু বছর পর তা-ই করি। মিশুক প্রথাগতভাবে বলেনি, আমার তোকে ভালো লাগে বা তোকে আমি বিয়ে করতে চাই। যখন বন্ধুতা অনেকটা গড়িয়েছিল, মিশুক ভেবেছিল সারা জীবনের জন্য এই মেয়েটিকে চাই—ভেতরে ভেতরে মেয়েটিও তা-ই। তখন একদিন বলেছিল, ‘চল্ আমরা একসঙ্গে বুড়া হই।’ এই রকম অদ্ভুত বিয়ের প্রস্তাব মঞ্জুলী ছাড়া এই ভূভারতে আর কে পেয়েছে?
একদিনের কথা বলি, কদিন রাত-দিন আড্ডা মেরে ফিরছি টরন্টো থেকে নিউইয়র্ক। ভোরে রওনা দেব। গোছগাছ সেরে, মঞ্জুলীর গলা জড়িয়ে বিদায় নেওয়ার সময় দেখি মিশুক নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ও রান্নাঘরে কিছু একটা করছে। একটু পরে আমাকে পরম বিস্মিত করে হাতে কিছু স্যান্ডউইচ ধরিয়ে দিয়ে বলছে, নে, এগুলো বসুধার জন্য। সঙ্গে রাখ। কখন রেস্ট এরিয়া পাবি জানিস না তো। মেয়েটার ক্ষিদে পেলে তখন কী করবি?
এই হলো মিশুক। আমাদের মিশুক। সেদিন ঢাকা আর্ট সেন্টারে ওর ওপরে কিছু ভিডিও ক্লিপিংস দেখতে দেখতে হঠাৎ আবিষ্কার করি, আমাদের নিউইয়র্কের বাসার মেঝেতে মিশুকদের দল বেঁধে শুয়ে থাকার দৃশ্য দেখে আমি আর বসুধা হাত ধরাধরি করে কাঁদতে শুরু করেছি কখন নিজেরাই জানি না। এত জীবন্ত, এত আনন্দময় স্মৃতি। মিশুকহীন এখন সব শূন্য।
দীর্ঘদিনের প্রবাস জীবন ছিল আমারও। নিউইয়র্ক থেকে টরন্টো গেছি যতবার ওদের বাসায়, ততবার আনন্দময় ভ্রমণ। মিশুক সারা দিন অফিস সেরে এসে হাসিমুখে ঘরে ঢুকে সোজা কিচেনে। হাত ধুয়ে, গামছা কাঁধে ঝুলিয়ে বলছে, ‘আব্দুল হাজির’। (এ রকম নাটকের ঢঙে ও প্রায়ই কথা বলত। তবে তাতে নাটুকেপনা থাকত না একবিন্দু।) কার কী চাই বলো।
আমি আর মঞ্জুলী কাজ ফাঁকি দেওয়ায় ওস্তাদ। বসে আড্ডা দিচ্ছি, দিচ্ছি দিচ্ছি। রাতের খাবারের কোনো প্রস্তুতি নেই। রাত বাড়ছে। মিশুক এর মধ্যেই তৈরি করে ফেলেছে মজাদার বিরিয়ানি। সবাই অবাক। মাংস কী করে এত তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হলো! ও একগাল হেসে বলছে, ‘তোরা যখন আজকে সকালে ঘুমাচ্ছিলি, তখনই অফিসে যাওয়ার আগে আমি মাংস মেরিনেট করে রেখেছিলাম। এখন ওভেনে দিলাম, ব্যস।’ রান্না করছে, টেবিল গোছাচ্ছে, মুখে কোনো বিরক্তি নেই। একটু পর পর আমাদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিচ্ছে, হাতে গ্লাস। এক সিপ দিচ্ছে। সব যেন খুব সহজ ওর কাছে। সব আনন্দের।
অল্প বয়সে খুব একটা মনে ধারণা জন্মেছিল, রবীন্দ্রনাথের গান যারা শোনে না বা তিরিশের কবিদের পড়ে না, তারা আমাদের জন্য নয়। অথচ মিশুকের সঙ্গে আমার কখনো কবিতা বা রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কথা হয়নি। আনুশেহ্র গান শুনিয়েছিল প্রথম মিশুক। সুলতান নিয়ে কাজ করেছে—বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় লোকসংগীত ওর মজ্জায়। তাতে বন্ধু হতে একটুও অসুবিধে হয়নি।
‘শুধু তাই পবিত্র, যা একান্ত ব্যক্তিগত’—বুদ্ধদেব বসুর এই কথাটি মনে রেখে সেসব একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতির পবিত্রতা রক্ষার্থে আমাদের চারজনের (মঞ্জুলী-মিশুক-শীলু-শাহীন) যৌথ আনন্দের অনেক কিছুর বর্ণনাই আর দেওয়া গেল না।
এতকাল শুধু জেনেছি, ‘ভালোবাসা মরে যেতে পারে, বেদনা কখনো মরে না।’ আমার কেবলি কথাটি অন্য রকম করে বলতে ইচ্ছে করছে, মানুষ মরে যেতে পারে, ভালোবাসা কখনো মরে না।
আমাদের বয়স বেড়েছে আরও এক বছর। মিশুক আছে সেখানেই। সেই একই রকম উজ্জ্বল। ওর কেশরাজির মতো উজ্জ্বল, ওর হাসির মতো উজ্জ্বল, ওর স্বভাবের মতো উজ্জ্বল। যারা ওকে পেয়েছে, দেখেছে, ছুঁয়েছে; ওরা জেনেছে, মিশুকের ‘ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না।’ কেননা, ও অন্য রকম ভালোবাসার এক হিরের গয়না গায়ে নিয়ে জন্মেছিল।
আজ তারেক মাসুদেরও চলে যাওয়ার দিন। মিশুককে যত দিন জানি তারেককেও তত দিন। আরেকটু বাড়তি জেনেছিলাম নিউইয়র্কে, মুক্তির গান তৈরির দিনগুলোতে। এই তো বছর পাঁচেক আগে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম নিউইয়র্ক থেকে এখন প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাগজের জন্য। সেই বিনয়ী হাসি। সেই ভালো মানুষের মুখ। যে দুটি মুখের দিকে বাংলাদেশের তরুণসমাজ বিস্ময়ে-শ্রদ্ধায় তাকিয়ে থাকত। আজ প্রণতচিত্তে তারেক মাসুদকেও স্মরণ করছি। যে আমাদের নবধারার চলচ্চিত্রে বসন্ত দিনের ডাক দিয়েছিল।
মাহ্ফুজা শীলু

No comments

Powered by Blogger.