আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁর গাড়িচালককে গুলি করে হত্যা-শ্যামপুর এলাকায় দোকানপাট বন্ধ করে প্রতিবাদ

রাজধানীর জুরাইন এলাকায় গতকাল বুধবার সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ উল্লাহ (৬০) ও তাঁর গাড়িচালক হারুনুর রশিদ (৪৫)। মোহাম্মদ উল্লাহ একজন মুক্তিযোদ্ধাও। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে তাঁর প্রাইভেট কার থামিয়ে খুন করে পালিয়ে গেছে।


মোহাম্মদ উল্লাহ শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। পূর্বশত্রুতা কিংবা স্থানীয় বিরোধের জের ধরে ভাড়াটিয়া খুনি দিয়ে কেউ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা।
স্থানীয় লোকজন দোকানপাট বন্ধ করে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানায়।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি নেতা সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিনকে পরোক্ষভাবে দায়ী করা হচ্ছে।
পুলিশের ওয়ারী জোনের ডিসি গাজী মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে জানান, হত্যাকাণ্ডের পেছনে চারটি সম্ভাব্য কারণ ধরে নিয়ে তাঁরা তদন্ত শুরু করছেন।
মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিতে গতকাল দপুরে প্রাইভেট কারে করে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ। প্রত্যক্ষদর্শী হোটেল কর্মচারী মহিউদ্দিন জানান, ঘটনার সময় মোহাম্মদ উল্লাহ চালকের পাশের সিটে বসা ছিলেন। অচেনা ছয় যুবক তাঁর গাড়ির সামনে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে চালক গাড়িটি থামান। তাদের মধ্যে তিনজন ছিল মুখোশ পরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সন্ত্রাসীরা অস্ত্র বের করে গাড়ির তিনদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে যায়। পরে দুপাশের জানালা ছাড়াও সামনের দিক থেকে সন্ত্রাসীরা গাড়ির ভেতরে গুলি করতে থাকে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মোহাম্মদ উল্লাহ ও চালক দুজনেই গাড়ির সিটের ওপর হেলে পড়েন। পরে পাশের একটি গলি দিয়ে চলে যায় সন্ত্রাসীরা। স্থানীয় লোকজন রক্তাক্ত অবস্থায় দুজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক দুজনকেই মৃত ঘোষণা করেন।
মোহাম্মদ উল্লাহর শরীরে সাত-আটটি এবং হারুনের শরীরে তিনটি গুলি বিদ্ধ হয়েছে বলে পুলিশ জানায়।
মোহাম্মদ উল্লাহর বড় মেয়ে আমেনা হীরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, শ্যামপুরের জুরাইন এলাকায় তাঁদের বাসা। আগামী ৫ মার্চ তাঁর ছোট বোন জান্নাতুল ফেরদৌস মুনি্নর বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। গতকাল দপুর আড়াইটায় বিয়ের দাওয়াত কার্ড নিয়ে তাঁর বাবা গাড়ির চালকসহ বাসা থেকে বের হন। বাসার অদূরেই ঘটনাটি ঘটেছে।
স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে আমেনা হীরা জানান, কয়েক যুবক পায়ে হেঁটে এসে তাঁর বাবার গাড়ির গতিরোধ করেছিল। সন্ত্রাসীরা তাঁর বাবাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করে বীরদর্পে পাশের গলি দিয়ে পালিয়ে যায়। আমেনা আরো জানান, দুদিন আগে কে বা কারা তাঁর বাবাকে টেলিফোনে হুমকি দিয়েছিল। এ বিষয়ে শ্যামপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়।
স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, মোহাম্মদ উল্লাহ শ্যামপুরের সালাউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। স্কুলের নাম পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে একটি মহলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলছিল। এ ছাড়া আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৮৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ। এসব কারণে প্রতিপক্ষ গ্রুপ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে তাঁর ধারণা।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সবার ধারণা, হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে স্থানীয় ও চেনাজানা কেউ থাকতে পারে। এ কারণেই ঘটনার পর প্রত্যক্ষদর্শী কেউ মুখ খুলতে রাজি হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, স্থানীয় এক ব্যক্তি গেট ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ অভিযোগে কয়েক দিন আগে পাওনাদাররা ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক ও তাঁর ছেলেকে আটক করে। পরে মোহাম্মদ উল্লাহ ঘটনাস্থলে গিয়ে পাওনা টাকা তুলে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তাঁদের দুজনকে ছাড়িয়ে আনেন। এ নিয়েও এ হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে। এ ছাড়া মেয়ের বিয়ে নিয়েও একটু ঝামেলা ছিল।
আরেকটি সূত্র জানায়, জুরাইন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ইমু নামের একজন একটি বাড়ি দখল করে আছেন। মোহাম্মদ উল্লাহ বাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য ইমুকে চাপ দিচ্ছিলেন। ঘটনার সময় ইমু ও রাজীবকে অনেকেই সেখানে দেখেছে বলে দাবি করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
পুলিশের ডিসি গাজী মোজাম্মেল হক গতকাল রাতে জানান, এসব কারণসহ নানা দিক মাথায় রেখে তদন্ত চলছে।
তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ। একমাত্র ছেলে কামরুজ্জামান শাকিল লন্ডনে বিবিএর ছাত্র বলে পারিবারিক সূত্রে জানা যায়।
এদিকে ঘটনার পরপরই ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজ, সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামসহ বিপুলসংখ্যক দলীয় নেতা-কর্মী মোহাম্মদ উল্লাহর মৃতদেহ দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান। তাঁরা মোহাম্মদ উল্লাহর খুনিদের খুঁজে বের করে শাস্তির দাবি জানান। সেই সঙ্গে অভিযোগ করেন, একটি মহল পরিকল্পিতভাবে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার চেষ্টা করছে।

No comments

Powered by Blogger.