জিরো ওয়ান সেভেন... by রাজীব হাসান

আমাদের হাতিশালে হাতি আর ঘোড়াশালে ঘোড়া কোনো কালেই ছিল না। তবে হাতি-ঘোড়া না হোক, রাজা-উজির আমরা মেরেছি বিস্তর। রোজ সন্ধ্যায় শহরের কোলাহল কমে এলে কোলাহল বাড়ত টাউন হলের। কর্মক্লান্ত মানুষ হতো ঘরমুখী, আর ঘরছাড়া আমরা হতাম টাউন হলমুখী। পুরো শহর যখন ঘুমোনোর প্রাথমিক আয়োজনে ব্যস্ত, তক্ষুনি যেন জেগে উঠত টাউন হল।


সন্ধ্যার আবছায়াকে আরও রহস্যময় করে তুলত সোডিয়াম বাতি। চাঁদ উঠত যেদিন, আক্ষরিক অর্থেই টাউন হলের মাঠটাকে মনে হতো চাঁদের হাট। গণগ্রন্থাগারের সিঁড়ির মুখে জুবায়ের ভাইদের গিটারের টুংটাং, হেঁড়ে গলায় গান; গোলচত্বরের রেলিংয়ের ওপর সারি হয়ে বসে থাকা মানুষ; বকুলতলার নিচে শান্ত ভাইদের মতো একটু বুদ্ধিজীবী গোছের আড্ডা; শহীদ মিনারের ওপর ভাবুক শ্রেণীর ধোঁয়াটে কথোপকথন।
আর আমরা? সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ হয়ে রুস্তম ভাইয়ের সাইকেল গ্যারেজটার সামনে। টাউন হলের সিংহদ্বারের পাশে, ঢুকতেই হাতের ডানে। মাঝবয়সী সেগুনগাছটার তলায়। আড্ডার কেন্দ্রে রুজু ভাই, অনর্গল বক্তা। বিরতিহীনভাবে কথা বলে যাওয়ায় অলিখিত বিশ্ব রেকর্ডধারী। একটু দূর থেকে তাকালে কখনো কখনো রুজু ভাইকে মনে হতো সক্রেটিস, আর তাঁকে বিন্দু হিসেবে ধরে নিয়ে চারপাশে বৃত্ত পূরণ করা মাঝারি ভিড়টাকে মনে হতো অ্যারিস্টটল আর তাঁর সতীর্থরা।
এথেন্সের রাস্তায় অনায়াসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দার্শনিক সংলাপ চালিয়ে যেতেন সক্রেটিস তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে। সংলাপ হতে হলে দুই পক্ষেই কিছু বলতে হয়। টাউন হলের সক্রেটিস রুজু ভাই আমাদের সুযোগ দিতেন সামান্যই। কিংবা বলা ভালো, মন্ত্রমুগ্ধ এই আমরা কেবল শুনেই যেতাম। আমরা সবাই আসলে ছিলাম ঢাকের বায়া, অবশ্যই ইতিবাচক অর্থে।
এক সন্ধ্যায় লেটলতিফ, এই আমার টাউন হলে পৌঁছাতে দেরি হয়েছিল কিংবা, সত্যি কথাটাই এই বেলা বলে নেওয়া ভালো, শহরের তিন প্রান্তে তিনটা টিউশনি করতাম, প্রায় কিলোমিটার দশেক দূরত্বের একমাত্র বাহন ছিল আমার পা-জোড়া। না, কোনো অভিযোগ করছি না। প্রিয় শহরের অলিগলি ঘুরতে একটু ক্লান্তিও ছুঁত না। সেদিন টিউশনির কারণেই টাউন হলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল আমার।
টাউন হলে ঢুকতেই দেখি, চেনা ভিড়টা যেন একটু অচেনা। সবার চোখমুখে ঝিকমিক করছে অপার কৌতূহল। যথারীতি আড্ডার কেন্দ্রে রুজু ভাই। তাঁর হাতে জোনাক পোকার মতো জ্বলছে কী এক অদ্ভুত যন্ত্র। হালকা সবুজাভ আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে সেই যন্ত্র থেকে। সেদিন আর সক্রেটিস নয়, রুজু ভাইকে মনে হচ্ছিল ভিনগ্রহের আগন্তুক; পৃথিবীবাসীর জন্য আশ্চর্য এক যন্ত্র নিয়ে এসেছেন যিনি।
ভিড়টার ফাঁক গলে ঢুকতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। অনলবর্ষী রুজু ভাই সেদিন আশ্চর্য মৌনব্রত নিয়েছেন। শুধু সেই যন্ত্রের বোতাম চাপছেন, আর কী আশ্চর্য জানেন, বোতাম চাপতেই সেই যন্ত্র থেকে হারমোনিয়ামের মতো শব্দ বেরোচ্ছে। সা রে গা মা ঠিক নয়, তাতে শব্দ হচ্ছে প্যাঁ পোঁ টুত টুত... আহা, তার পরও কী মোহনীয় সুরই না মনে হচ্ছিল!
উপস্থিত জনতার সবারই চোখ চকচক করছে। কেউ কিছু না বললেও বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না, রুজু ভাইয়ের আশ্চর্য সেই যন্ত্রটা একটু নিজ হাতে নিয়ে সবাই মানব জন্ম সার্থক করতে চায়। কিন্তু কেউ মুখ ফুটে বলার সাহসও পাচ্ছে না। এমনিতে দিলখোলা রুজু ভাই সেই যন্ত্রের ছোঁয়াতেই কিনা একটু রাশভারীও হয়ে গেছেন। রুজু ভাইকে মনে হচ্ছিল মোজেস, হাতে যাঁর অলৌকিক লাঠি।
আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে সেই যন্ত্র টিটিটিটি টিটিটিটি টা টো টো টো জাতীয় সুর তুলে বেজে উঠল। ভিড়টা একটু ভয় পেয়ে সরে গেল পেছনে। না জানি কী হয়! রুজু ভাই নিজেও একটু শিহরিত। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, সামনের দিকের অজস্র খুদে সুইচের মধ্যে সবুজ একটা বোতামমতো সুইচ চাপ দিয়েই যন্ত্রটা কানে ঠেকালেন রুজু ভাই। ‘জি, হ্যাঁ, বলছি। জি জি! হ্যাঁ, এই তো কিছুক্ষণ আগেই কিনলাম। জি, এটাই এখন আমার নম্বর। জি, ওকে! হ্যাঁ, টিঅ্যান্ডটিতে না পাইলে এইটাতে পাবেন। ওকে ওকে, আচ্ছা, হা হা হা! ঠিক আছে। রাখি তাহলে।’ টুত করে লাইনটা কেটে দিলেন রুজু ভাই।
ইচ্ছে হলো আনন্দে লাফিয়ে উঠি। ২০০০ সালের কোনো একদিন ঐতিহাসিক রংপুর টাউন হলে আমরা কজন নতুন এক ইতিহাসের সাক্ষী হলাম। রংপুর শহরে মোবাইল ফোন নামের আশ্চর্য এক যন্ত্রের তখন সদ্যই আগমন। আর সেই অলৌকিক যন্ত্র দিয়ে কথা বলে রুজু ভাই নিজেও হয়ে গেলেন ইতিহাসের অংশ। টেলিফোন যন্ত্র প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। মোবাইল ফোন প্রথম কে আবিষ্কার করেছেন, আমরা জানি না। তবে কেউ যদি প্রশ্ন করে, রংপুর থেকে প্রথম মোবাইলে ‘হ্যালো’ বলেছিল কে? আমরা সোল্লাসে চিৎকার করে বলব, ‘রুজু ভাই, রুজু ভাই!’

No comments

Powered by Blogger.