শ্বেতভল্লুক আর বরফের ভাস্কর্য by লুৎফর রহমান রিটন

গল্প শুরুর আগে: কানাডার মিউজিয়াম অব সিভিলাইজেশনে গিয়ে মজার একটা অভিজ্ঞতা হলো। মাইনাস ৫০-৬০ তাপমাত্রার ভয়ংকর শীতে প্রবল তুষারপাতের সঙ্গে লড়াই করে কীভাবে কানাডায় বসতি গড়েছে মানুষ, তার ধারাবাহিক একটা দৃশ্যমান ইতিহাস ওখানে প্রত্যক্ষ করা যায়।


কিছুদিন আগে ওখানেই দেখা হলো একটা বরফের স্কাল্পচারের সঙ্গে। বরফের ভাস্কর্যটার আদল আমার আদলের সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যায় বলে অটোয়ায় আমার বাড়িতে বেড়াতে আসা অতিথিদের আমি চমকে দেওয়ার জন্য ভুলিয়েভালিয়ে ওখানে নিয়ে যাই। ওই মিউজিয়ামে গিয়ে ঘটনা চাক্ষুষ করে আবেদ খান, গোলাম সারওয়ার, মুনতাসীর মামুন, মমতাজ উদ্দীন আহমদসহ বাংলাদেশের বেশ কজন বিখ্যাত মানুষ অতিসম্প্রতি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এই কাহিনির কোনো চরিত্রই কাল্পনিক নয়।]

বাংলাদেশে আষাঢ় মাসে বৃষ্টি পড়ে ঝমঝমিয়ে। এক নারী শিল্পী রেডিওতে গেয়েছিলেন, আষাঢ় মাইসা বিষ্টি রে/ ঝমঝমাইয়া পড়ে রে/ বন্ধু আমার রইল বৈদেশ গিয়া/ রইল বৈদেশ গিয়া...।
কানাডার আষাঢ় মাস হচ্ছে ডিসেম্বর। কানাডায় আষাঢ় মাসে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ে না। পড়ে বরফ। পেঁজা তুলার মতো বরফ। ফুলের পাপড়ির মতো বরফ। থকথকে কাদার মতো বরফ। শুকনো বালুর মতো ঝরঝরে বরফ। ইটের টুকরোর মতো খটখটে বরফ। স্বচ্ছ কাচের মতো চকচকে বরফ। এবং লন্ড্রিধোয়া নীল দেওয়া ঝকঝকে বরফ। কানাডায় আষাঢ় মাস মানেই বরফে ভাসার মাস। এ রকম এক বরফস্নাত আষাঢ়ে, আমি তখন সদ্য এসেছি কানাডায়, ঘটনাটা ঘটেছিল। নতুন এসেছি বলেই আমি তখনো জানি না যে এ রকম বরফের প্লাবনের সময় স্নোবুট অর্থাৎ বরফপাদুকা পরতে হয়। আমি বাংলাদেশ থেকে কিনে আনা আমার প্রিয় একজোড়া জুতার এস্তেমাল করেছিলাম। ভুল সময়ে ভুল ওয়াজের খেসারত যে দিতে হয়, সেটা চাল্লু হুজুরেরা জানে। সাদাদের দেশে আমাকে কাল্লু বলা যায়, কিন্তু চাল্লু একেবারেই না।
কাল সারা রাত বরফ পড়েছে। সকালে অটোয়া শহরটিকে মনে হলো ধবধবে সাদা কাফনে মোড়ানো একটি শহর। যে শহরটি খাটিয়ায় উঠে পড়ার জন্য গোসল করে আতর মেখে তৈরি হয়ে আছে। ১৩ তলা অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে যা দেখা গেল তা রীতিমতো ভয়াবহ। কানাডায় আমার প্রথম সকালটি যে এ রকম হবে, সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। কোনো জ্যোতিষীও আমাকে বলেনি এ রকমের কোনো আশঙ্কার কথা। জানালায় চোখ রেখে যত দূর দেখা যায়, তত দূরই ফকফকা, সাদা। আগের দিন দুপুরে দেখা সবুজ মাঠটা এখন একেবারেই সাদা। পাতাহীন ন্যাড়া গাছগুলোর ডালপালা সব সাদা। ছোট ছোট বিল্ডিংগুলোর ছাদ সাদা। পার্কিং লটে পার্ক করা সব কটা গাড়িও সাদা। সাদা ছাড়া অন্য কোনো রঙের গাড়ি একটাও নেই। যত দূর চোখ যায়, শুধু সাদা আর সাদা। কানাডা যে একটা বর্ণহীন দেশ তা তো জানা ছিল না!
আমাকে যেতে হবে ইমিগ্রেশন অফিসে। আজই। বরফের অজুহাতে এই দেশে কোনো কাজ আটকে থাকে না। সুতরাং নো হাঙ্কিপাঙ্কি। যেতে হবে মানে যেতেই হবে।
১৩ তলা থেকে নিচে নেমেই হতবাক আমি। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। বিশাল সবুজ মাঠটা পার হয়ে আমাকে পৌঁছুতে হবে বাসস্টপেজে। কিন্তু সবুজ মাঠ কই? সাদা বরফের সমুদ্র হয়ে আছে মাঠটা। থইথই বরফের ওপর সাবধানে পা ফেলে ফেলে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। মাঠের বাঁ দিকে লোক চলাচলের জন্য সরু লম্বা সাইড ওয়াক। সাইড ওয়াকের সীমানাপ্রাচীর হিসেবে সারি সারি গাছ। এখন গাছগুলোয় পাতা নেই। কেবলই ডালপালা। ন্যাড়া মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর ডালপালা বরফে মোড়ানো। এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে উদয় হলো একটা সাদা ভালুক! ভয়ে আমার তো হার্টফেল হওয়ার জোগাড়! আমার সামনে প্রায় ছুঁয়ে দেওয়া দূরত্বে সাদা ভালুকটা। হীরক রাজার দেশের বাঘের সামনে গুপীর মতোই অবস্থা আমার। একেবারে নট নড়ন-চড়ন অবস্থা যাকে বলে। নড়লেই যদি মারে থাবা! বাবা রে বাবা! দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। মনে হয় অনন্তকাল ধরে আমি দাঁড়িয়ে আছি এখানে, এই সাদা ভালুকটার সামনে। আমি আমার বুকের ঢিপঢিপ শব্দটা শুনতে পাচ্ছি। মনে হয় শ্বেতভল্লুকও শুনতে পাচ্ছে। সহসা আমাকে বিস্ময়ের অকূল সাগরে নিক্ষেপ করে কথা বলে উঠল ভালুকটা। কানাডার ভালুক, তাই ইংরেজিতেই বলল,
-আর ইউ স্কেয়ার্ড?
ভয়ে আতঙ্কে আমি ইংরেজি ভুলে গিয়ে বাংলাতেই জবাব দিলাম কাঁপতে কাঁপতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে, জি স্যার!
আমাকে আরও ভয় পাইয়ে দিয়ে শ্বেতভল্লুকটা এবার স্পষ্ট বাংলায় বলল, ভয় পাইও না।
-আপ্নে বাংলাও জানেন স্যার!!
-হ জানি। তুমি এই দ্যাশে নতুন আইছ, আইমিন নয়া ধোর?
-জি স্যার। আমি যে নয়া ধোর, সেইটা আপ্নে ক্যাম্নে জানলেন?
-তোর জুতা দেইখ্যা বুঝছি! নতুন ভোদাই ছাড়া আর কেউ এইরম বরফের ভিত্রে বাটা পইরা হাঁটা দিব না।
-আরে, আপ্নে তো দেখি গণক ঠাকুর! এইটা যে বাটার জুতা, সেইটা ক্যাম্নে বুঝলেন?
-আরে ব্যাটা, বাটা ছাড়া আর কুনু জুতার বরফে এমুন ফুইল্লা ঢোল হওনের ইতিহাস নাই। ইট্টু পরেই দেখবি তোর জুতার উপ্রের অংশটাই খালি আছে। নিচের সুখতলি সিলাই খুইল্লা বিচ্ছেদের অনলে পুড়তাছে। সুখতলি ছাড়া জুতা কুনুদিন দ্যাখছস?
-জি না, দেহি নাই স্যার।
-তয় দেখবি। কিছুক্ষণের মইধ্যেই দেখবি।
সাদা ভালুকটা ঠিকই বলেছে। আমার দুই পায়ের জুতার তলায় আমি ঠান্ডা অনুভব করছি অতিমাত্রায়। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, সুখতলিহীন জুতো পায়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি বরফপ্লাবিত মাঠের মাঝখানে। এইটা বুঝে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমার পায়ের তলার ঠান্ডার মাত্রা বেড়ে গেল কয়েক শ গুণ।
হঠাৎ আমার মনে পড়ল, শ্বেতভল্লুক থাকে নর্থ পোলে। কান্ট্রি ইন অরিজিন বরফের ফ্যাক্টরি আলাস্কায়। ভয় পেলে ভয় কাটাতে মানুষ প্রচুর কথা বলে। আমার মধ্যেও সেই প্রবণতা দেখা গেল। ভালুকের সঙ্গে কথা বলার কোনো বিষয় না পেয়ে আচমকা আমি প্রশ্ন করে বসলাম,
-আচ্ছা, আপ্নের তো আলাস্কায় থাকোনের কথা। আপ্নে এই লোকালয়ে ক্যান্?
স্মার্ট ভালুকটা জবাবে বলল,
-তোরও তো বাংলাদেশে থাকনের কথা। তুই এই শীতের দ্যাশে ক্যান্?
-আমি আইছি ঠ্যাকায় পইড়া। পলিটিক্যাল কারণে। এসাইলাম কেস। আর আপ্নে?
-আমিও ঠ্যাকায় পইড়া। ননপলিটিক্যাল কারণে। মার্ডার কেস। তোরা মানুষরা দিন দিন পেরেশানি আর দিগদারি যা শুরু করছস, আমগো লোকালয়ে আওন ছাড়া উপায় নাই।
-কন কী! কী করছি আমরা?
-গাছ কাইট্যা ফালাইছোস। তামাম দুনিয়া গরম হয়া পড়ছে। বেবাক বরফ গইল্লা পানি হইয়া যাইতাছে। বরফ না থাকলে আমরা থাকুম কই? লোকালয়ে আইছি অন প্রোটেস্ট একটা খুন করনের লাইগ্যা। মার্ডার করুম।
-কারে মার্ডার করবেন স্যার!
-মানুষ একটা হইলেই হইল। বেলেকেন্ডহোয়াইট সাদাকালা বুঝি না। পাইছি তোরে। খাইছি তোরে। বলতে বলতে শ্বেতভল্লুকটা তৃপ্তির একটা ঢেকুর তুলে আমার দিকে এগিয়ে এল। এক্ষুনি শ্বেতভল্লুক আমার ভবলীলা সাঙ্গ করবে। নিজের জন্য নিজেই গভীর শোক অনুভব করছি। অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর। আমার এখন পাথর-দশা।
দৌড়ে পালাতে গিয়ে দেখি ঠান্ডায় জমে গিয়ে বরফে আটকে গেছে আমার পা দুটি। কিছুতেই তোলা যাচ্ছে না। বরফ হয়ে গেছে আমার পায়ের পাতা। জমাট বরফ হয়ে গেছে গোড়ালি। সর্বনাশ! পায়ের নিচ থেকে বরফজমাট পরিস্থিতি ক্রমশ ওপরের দিকে বিস্তার লাভ করছে! দুই পায়ের মাসল, হাঁটুও জমাট বেঁধে গেল! দেখতে দেখতে আমি বরফের ভাস্কর্য হয়ে গেলাম...!

No comments

Powered by Blogger.