চরাচর-বিলুপ্তির পথে শকুন by আজিজুর রহমান

দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে শকুন নামের বাংলাদেশের অতি পরিচিত বিশালাকার পাখিটি। বৈদিক মতে, শকুন হচ্ছে শুভফলসূচক পক্ষী। প্রচলিত ভাষায় এদের ঝাড়ুদার বা স্ক্যাভেঞ্জার (ঝপধাবহমবৎ) অর্থাৎ ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারক পাখি বলা হয়। বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহ শকুনরা দলবেঁধে মুহূর্তেই খেয়ে সাবাড় করে ফেলে।


ফলে পচন ধরা গলিত মৃতদেহ থেকে সংক্রামক রোগ-ব্যাধি ছড়াতে পারে না। এ কারণে লোকালয় আবর্জনা, দুর্গন্ধ ও দূষণমুক্ত থাকে। নিঃসন্দেহে এরা মানবসমাজের অত্যন্ত উপকারী। কিন্তু এখন আর আগের মতো শকুন দেখা যায় না। গত চার দশকে পাখিটি ক্রমশ কমতে কমতে বিরল প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা পৃথিবী থেকে শকুন বিলুপ্ত হতে চলেছে। গত তিন দশকে উপমহাদেশের ৭৫ শতাংশ শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আশির দশকে সার্কভুক্ত দেশে প্রায় চার কোটি শকুনের অস্তিত্ব ছিল। এই সংখ্যা কমে এখন ৪০ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। কলকাতার ময়দান এলাকায় যেখানে ১৯৯২-৯৩ সালেও প্রায় ৩০০টির মতো শকুন ছিল, এখন সেখানে মাত্র ৮-১০টি শকুনের দেখা মেলে। পাকিস্তানের ধোলেওয়ালা বনাঞ্চলে ২০০২ সালেও ২৪০টি শকুন ছিল, সেখানে আজ একটি শকুনেরও দেখা পাওয়া যায় না। শকুনের এই অবলুপ্তি পরিবেশের ওপর ভীষণ বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বলে পরিবেশবাদীরা জানান। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শকুনের এই বেদনাদায়ক বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে, গবাদিপশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেন নামের ওষুধ ব্যবহার। ভারতে প্রতিবছর ৩০ শতাংশ শকুন মারা যাওয়ার কারণও এই ডাইক্লোফেনই। বাংলাদেশেও গবাদিপশু চিকিৎসায় নির্বিচারে ডাইক্লোফেন ব্যবহার হচ্ছে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের গবেষক ড. লিন্ডসে এক গবেষণায় প্রমাণ করেন, পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনের ব্যবহারই শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। ব্যথানাশক ওষুধটি ব্যবহারের ফলে গত তিন দশকে অবাধে শকুন মারা যাচ্ছে। মৃত পশুর মাংস শকুনের কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু ডাইক্লোফেন দেওয়া হয়েছে এমন মৃত পশুর মাংস খেলে কিডনি নষ্ট হয়ে দু-তিন দিনের মধ্যেই শকুনের মৃত্যু ঘটে। অতি বিপন্ন এই পাখিটি রক্ষায় চার বছর আগে ভারত ও পাকিস্তান তাদের নিজ নিজ দেশে গবাদিপশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। গত বছর নেপাল সরকারও এ ওষুধটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর বদলে চিকিৎসকদের মেলোঙ্কি্যাম নামের ওষুধ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশে এখনো ডাইক্লোফেনের যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে। এ ছাড়া বনাঞ্চল ধ্বংস, খাদ্যের অভাব এবং ক্রমশ বেড়ে চলা পরিবেশদূষণের কারণেও অন্যান্য পাখির মতো শকুনের এই করুণ পরিণতি।
আজিজুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.