চারদিক-রসাল ফলের হাট by মুজিবুর রহমান

মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে শ্রীমঙ্গল থেকে ২১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে কুলাউড়া থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণে ও ভারতের উত্তর ত্রিপুরার জেলা কৈলাসহর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার পশ্চিমে শমশেরনগর বাজার। ব্রিটিশ শাসনামলে এটি ছিল, এশিয়ার বৃহত্তর গ্রাম্য বাজার।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশরা কলকাতা দমদম বিমানবন্দরের সঙ্গে শমশেরনগরে একটি বিমানবন্দর স্থাপন করেছিল। দমদমের সঙ্গে মিল রেখে তার নাম রেখেছিল দিলজান্দ বিমানবন্দর। তা ছাড়া ডানকান ব্রাদার্সের প্রধান চা-বাগান শমশেরনগরসহ আরও দুটি চা-বাগান চাতলাপুর ও আলীনগর পাশাপাশি অবস্থানে। ফলে ব্রিটিশরা সে সময় শমশেরনগরে ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের (আইটিএ) সদর দপ্তর স্থাপন করেছিল। পাকিস্তান আমলে নাম পরিবর্তন করে হয়েছিল পিটিএ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর পিটিএ চা বোর্ডে রূপান্তরিত হয়ে তার সদর দপ্তর করা হয় চট্টগ্রামে। আজও আইটিএ বা পিটিএ ভবন লংলা হাউস শমশেরনগরে সেদিনের সাক্ষ্য বহন করছে।
এ ছাড়াও ১৯৫২ সালে ইরানের শাহেনশাহ রেজা পাহলবি ঢাকা থেকে রেলভ্রমণের মাধ্যমে শমশেরনগর স্টেশনে অবতরণ করে কুলাউড়া উপজেলার নওয়াব বাড়ি বর্তমান মহাজোট সরকারের সাংসদ অ্যাডভোকেট নওয়াব আলী আব্বাছ খানের বাড়ি গিয়েছিলেন। তাঁর সম্মানে শমশেরনগর ফ্ল্যাটফরমসংলগ্ন রেলগেটে বড় দুটি পাকা তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল। আজও সে তোরণগুলো নীরব সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। পাকিস্তান আমলে শমশেরনগর বিমানবন্দরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনসের (পিআইএ) অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট সার্ভিস চালু ছিল। ১৯৭০ সালে সিলেট বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর পিআইয়ের একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের ইঞ্জিনে আগুন ধরে গেলে শমশেরনগর বিমানবন্দরের রানওয়েতে জরুরি অবতরণকালে বিমানটি দুর্ঘটনায় কবলিত হয়ে অধিকাংশ যাত্রী মারা যান। সেই থেকে শমশেরনগর বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেলে বিমানবন্দরটি অচল হয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী (বিএএফ) শমশেরনগর বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রথমে বিশাল এলাকার পতিত ভূমিকে কৃষি অন্তর্ভুক্ত মিষ্টিবরই, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, পেয়ারা, ধান ও লেবুর চাষাবাদ শুরু করে পর্যায়ক্রমে এখানে বড় একটি কৃষিখামার গড়ে তোলে। পাশাপাশি বিএএফ এমটি ইউনিট ও সার্ভইভ্যাল স্কুল স্থাপন করে বিমানসেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে বিএএফ রিক্রুটস অ্যান্ড ট্রেনিং স্কুল (আরটিএস) ও বিএএফ শাহীন কলেজ স্থাপন করা হয় শমশেরনগরে।
এসব কারণ ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ত্রিপুরা পাহাড়বেষ্টিত, টিলা-মাটির কারণে শমশেরনগর ও আশপাশের এলাকায় প্রচুর মৌসুমি ফল আম, কাঁঠাল, জাম, আনারস, লেবু, পেয়ারার বাম্পার ফলন হয়। ফলে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে শমশেরনগরে বসে বিশাল আম-কাঁঠালির হাট। শমশেরনগর স্টেশন সড়ক ও রেলওয়ে স্টেশনের পতিত জমিতে বসে আম-কাঁঠালির বড় হাট। রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ ও তুলনামূলক কম দামে পাইকারি বিক্রয় হয় বলে শমশেরনগরে মৌসুমি ফলের হাট জমজমাট থাকে। তবে মধুফলের মৌসুম বৃহত্তর সিলেট বিভাগের ক্ষেত্রে একটু আলাদা ভাবনা নিয়ে আসে। সিলেট বিভাগের একটি পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে। মেয়ে বিবাহ দেওয়ার পর প্রতিবছর মধুফলের মৌসুমে মেয়ের বাড়িতে জ্যৈষ্ঠ মাসের আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, জামসহ নানা জাতের ফল দিতে হয়। আঞ্চলিকভাবে এর নাম হলো জৈঠারী। যুগ যুগ ধরে সিলেট অঞ্চলে একটি পারিবারিক ঐতিহ্য লালন করা হচ্ছে। বিবাহের পরও বাবার বাড়ির নানা জাতের ফল-ফলাদিতে মেয়ের অধিকার থাকে। আর জৈঠারী (জ্যৈষ্ঠ মাসের ফল) দিয়ে সে অধিকার পূরণ করা হয়। এ নিয়ম ও দৃশ্য সিলেট বিভাগের সর্বত্র লক্ষ করা গেলেও দেশের অন্য স্থানে আছে কি না, তা জানা নেই।
মৌলভীবাজার জেলার বড় একটি অংশ উঁচু-নিচু টিলা, চা-বাগান আর পাহাড়বেষ্টিত বলে এসব ফল সহজে চাষাবাদ হয় এ জেলায়। এর মধ্যে গ্রীষ্মকালীন নানা জাতের ফল চাষাবাদ, উৎপাদন বাজারজাত ও বিক্রয়ের অন্যতম একটি স্থান হলো কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর। আগে নিজেদের চাহিদা পূরণ করে আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিতরণের জন্য শমশেরনগর ও এর আশপাশের এলাকায় আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, জাম্বুরাসহ নানা জাতের মৌমুমি ফল উৎপাদন করা হতো। এখন এসব এলাকার সর্বত্রই আর্থিক আয়ের কথা ভেবেই বাসাবাড়ির আঙিনা, খোলা পতিত জমি এমনকি বন্দোবস্ত নিয়ে খাসজমিতে গ্রীষ্মকালীন ফল চাষাবাদ করা হচ্ছে। এভাবে শমশেরনগর এলাকায় বেশ কয়েকটি ব্যক্তিমালিকানাধীন ফলের খামার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর শমশেরনগর ইউনিটে রয়েছে বিশাল একটি কৃষি খামার। যেখানে প্রচুর পরিমাণে আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, পেয়ারা, পেঁপে, বরই ইত্যাদি চাষাবাদ করে বছরে প্রচুর পরিমাণে আয় করা হয়। শমশেরনগর ইউনিয়নসংলগ্ন হাজীপুর, আলীনগর, পতনউষার, আদমপুর ইউনিয়নে রয়েছে অনেক কাঁঠাল, লিচু, আনারস, পেয়ারা, আমসহ বিভিন্ন জাতের ফলের খামার। আর এসবের অন্যতম বাজার হচ্ছে শমশেরনগর।
মধুফলের মৌসুমে (মে-জুন) শমশেরনগর বাজারের চেহারাই বদলে যায়। স্থানীয় চৌমুহনা থেকে স্টেশন রোডের দুই পাশে আধা কিলোমিটার এলাকায় বসে আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, জামরুল ও লিচুর খুচরা-পাইকারি বিক্রেতাদের দোকান। কয়েকটি আড়ত ছাড়াও শতাধিক হাতা গাড়িতে (ঠেলাগাড়ি) সাজিয়ে রাখা হয় বড় বড় কাঁঠাল। পুরো এলাকাটি তখন একটি মিষ্টিমধুর গন্ধে ভরে যায়। মৌলভীবাজার জেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা শমশেরনগর এসে পছন্দমতো নানা জাতের ফল কিনে নিয়ে যান। তাঁরা কিনে নেন নিজেদের জন্য আর মেয়ের বাড়িতে জৈঠারী পাঠানোর জন্য। এ ছাড়াও এ সময় ভাটি অঞ্চলে যায় শমশেরনগরের কাঁঠাল। সেখানকার পাইকার এসে ট্রাকে ভরে শমশেরনগরের কাঁঠাল নিয়ে যান। কমলগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন শুধু মৌসুমি ফল ক্রয়-বিক্রয়ের জন্যই উপজেলার সবচেয়ে বেশি মূল্যে শমশেরনগর বাজার বার্ষিক ইজারা দিয়ে থাকে।
মুজিবুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.