দূরদেশ-একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা by আলী রিয়াজ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরিচালিত গণহত্যার ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টির একটা প্রচেষ্টা দেশের বাইরে সম্প্রতি বেশ জোরদার হয়েছে বলে মনে হয়। এই অনুমানের পেছনে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এর কোনো ভূমিকা নেই।


কিছুদিন যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত একাডেমিক সম্মেলনে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের প্রশ্ন থেকে আমার এই ধারণা। গত মাসে ওয়াশিংটনে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের উদ্যোগে আয়োজিত পাকিস্তানবিষয়ক একটি সম্মেলনে একাধিক বাংলাভাষী শ্রোতার কাছ থেকে প্রায় একই ধরনের প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাকে।
পাকিস্তানবিষয়ক এই সম্মেলনের আয়োজক আয়শা সিদ্দিকা। তাঁর অনুরোধেই পাকিস্তানের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে হাজির হই। আমার মূল বক্তব্য ছিল যে পাকিস্তানের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলামে এমনভাবে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, অমুসলিম ও ভারতকে তুলে ধরা হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা একধরনের আক্রমণাত্মক মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে গত তিন দশকের সমাজবিজ্ঞান বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে আমি দেখানোর চেষ্টা করি যে পাকিস্তানি শিক্ষার্থীদের উগ্র মনোভাবাপন্ন হওয়ার কারণ খুঁজতে অন্যত্র তাকানোর দরকার হয় না। এসব উদাহরণের একটি ছিল ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাবলি। পাকিস্তানি সুশীল সমাজ গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও স্কুল পাঠ্যপুস্তকে ১৯৭১ সালকে ‘হিন্দু ভারতের ষড়যন্ত্র’ বলেই দেখানো হয়। আমার প্যানেলের অন্য বক্তারা ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেন। এদের একজন হ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মমতাজ আহমেদ আমার বিশ্লেষণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। পাকিস্তানি শিক্ষাব্যবস্থার গোটাটাই ব্যর্থ, এটা বলতে তিনি নারাজ, তবে তিনি ১৯৭১-এর প্রশ্নে আমার বক্তব্যেই সায় দিলেন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে ১৯৭১ সালের প্রসঙ্গ নিয়ে যে শ্রোতা আমার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করলেন, তিনি ভূমিকায়ই বললেন যে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তানি’, ১৯৭১ সালে তিনি সেখানে ছিলেন, ওই গৃহযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে—এটা অতিরঞ্জিত দাবি এবং পাকিস্তানি বাহিনী অভিযান পরিচালনা করেছে, কেননা তার আগেই ‘বিহারি’দের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছিল। যেহেতু এটা আমার প্রবন্ধের মূল বিষয় নয়, সংক্ষেপে তার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কিছুক্ষণ পর উপস্থিত আরেকজন শ্রোতা নিজেকে ‘বাংলাভাষী’ বলে দাবি করে একই বক্তব্য পেশ করলেন। প্যানেলের অন্য বক্তারা—আরিফ জামাল, মমতাজ আহমেদ, নওশীন আলী; উপস্থিত পাকিস্তানবিষয়ক গবেষক ফারজানা শেখ কমবেশি সবাই এই নিয়ে মন্তব্য করলেন যে গণহত্যার ঘটনাকে অস্বীকার করা বাতুলতা মাত্র।
এ ঘটনাটির দুটো দিক খুব লক্ষণীয়। প্রথমত, দুজনের বক্তব্যে (এবং অনুষ্ঠানের শেষে অন্য আরও কয়েকজনের প্রবাসী পাকিস্তানি অবাঙালি শ্রোতার) ব্যবহূত তথ্য ও যুক্তি একই রকম। দ্বিতীয়ত, এই বক্তব্যগুলো বলার জন্য বাংলাভাষীরাই সবচেয়ে সরব। এই অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়। এ বছরই ফিলাডেলফিয়ায় এশিয়ান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইসলামবিষয়ক প্রবন্ধ পড়ার পর অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তার সময়ও আমাকে একজন এ ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন।
ওয়াশিংটনের অভিজ্ঞতার সপ্তাহ দুয়েক আগে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে খানিকটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেখানে স্নাতক পর্যায়ে পড়ছে এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীর মধ্যে বাংলাদেশের একজনকে পাওয়া গেলে, যে সম্প্রতি দেশ থেকে পড়তে এসেছে, অন্যজন জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক, পিতামাতা অনেক আগেই এ দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
দ্বিতীয় শিক্ষার্থীটি দুদিনের সম্মেলনের বিরতিতে এসে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইছিল। তার গভীর উৎসাহ বাংলাদেশ নিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস নিয়ে পড়ালেখা শুরু করেছে, কিন্তু তারও প্রশ্ন, বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় যে গণহত্যা হয়েছে, তা নিয়ে বিস্তারিত পাওয়া যায় না কেন? প্রশ্ন করার সময় খানিকটা কুণ্ঠা নিয়েই বলল—হত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী ঘটনা কি বাড়িয়ে বলা হয়েছে? এই প্রশ্ন কেন—আমি জানতে চাইলাম। উত্তরে বলল, এমন কথা সে শুনেছে।
এ ধরনের বক্তব্য যে একেবারে নতুন, তা নয়। বছর পাঁচেক আগে শর্মিলা বোস প্রশ্ন তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত ধর্ষণের সংখ্যা নিয়ে। তিনি দাবি করেন, সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত। (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শর্মিলা বোসের বইটি মাস খানেকের মধ্যেই প্রকাশিত হবে।) পরবর্তী বছরগুলোয় এ ধরনের প্রশ্ন ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত। কিন্তু দুই বছর ধরে একই ধরনের প্রশ্ন প্রায় একই ভাষায় উত্থাপনের চেষ্টা হচ্ছে বলেই আমার ধারণা। আর সেই প্রচেষ্টা চলছে শিক্ষাঙ্গনে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানে, নীতিনির্ধারকদের অঙ্গনে। পাশাপাশি এটাও লক্ষণীয় যে, গত এক দশকে বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন উৎসাহ তৈরি হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে এ ধরনের প্রশ্ন তোলার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উৎসাহের কারণ একাধিক। নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা বাংলাদেশ নিয়ে জানতে চাইছেন, সমাজবিজ্ঞান গবেষণায় বাংলাদেশি অথবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা বেশি করে যুক্ত হচ্ছেন, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন (সাফল্য ও ব্যর্থতা) নিয়ে আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ে সংগঠিত গবেষণার উদ্যোগ খুবই সীমিত। নিউজার্সিতে অরক্ষিত কিন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ নেই।
বাংলাদেশে ও যুক্তরাষ্ট্রে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবারই এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার সময় এসেছে। ব্যক্তিগত ও ছোট আকারে যেসব উদ্যোগ রয়েছে, সেগুলোকে সংগঠিত করা খুবই জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের কিছু কিছু উদ্যোগ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার, বিশেষত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয় সম্মিলিতিভাবে কিছু প্রয়াস নিতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, সরকারের চেষ্টা নিয়ে অনেক সময়ই সংশয় থাকে; অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো খুব সাময়িক বিবেচনাপ্রসূত হয়। সে কারণেই দরকার যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যেমন আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজকে যুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে এই প্রচেষ্টায় অগ্রণী ভূমিকা দেওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজকে কেন্দ্র করে এই উদ্যোগ নেওয়া। এককভাবে কারও পক্ষেই এত বড় কাজে হাত দেওয়া সম্ভব নয়, তবে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হলে সাফল্য অর্জন করা খুব কঠিন কাজ নয়।
ইলিনয়, জুন ২০১০
আলী রিয়াজ: অধ্যাপক, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।

No comments

Powered by Blogger.