পুকুর ভরাট করে স্থাপনা গড়বেন এমপি আসলাম-প্রস্তাব পূর্ত মন্ত্রণালয়ে by তোফাজ্জল হোসেন রুবেল

প্রায় অর্ধশত বছরের পুরনো একটি পুকুর ভরাট করে কনভেনশন সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন ঢাকা-১৪ আসনের স্থানীয় সংসদ সদস্য আসলামুল হক। পুকুরটির আয়তন দুই একরের চেয়ে বেশি। জমিটি বরাদ্দ পেতে গত বছরের ২৪ মে তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেন।


মন্ত্রণালয় এখন বরাদ্দ দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। ইতিমধ্যে জায়গার জরিপও হয়ে গেছে। এ বিষয়ে মিরপুর গণপূর্ত উপবিভাগ ২-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী বলেছেন, এমপি আসলামের আবেদনে পুকুরের কথা খুব সম্ভবত উল্লেখ করা হয়নি।
মিরপুরে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের এ জলাশয়টি আনসার ক্যাম্প তালতলা পুকুর নামে পরিচিত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর গণপূর্ত উপবিভাগ ২-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হেদায়েত উল্লাহ মজুমদার বলেন, 'স্থানীয় সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে পুকুরের জায়গাটি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এখানে শেখ রাসেল কনভেনশন সেন্টার গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে এ জায়গাটির একটি ডিজিটাল জরিপ করার জন্য চিঠি পাঠায়। জরিপের কাজ সম্পন্ন করে এর সব বিষয় তুলে ধরে নকশা প্রণয়নের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। এখন এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।' তিনি আরো বলেন, 'পুকুর ভরাট করে কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কোনো সুযোগ নেই। প্রস্তাবে পুকুরের কথাটি খুব সম্ভব উল্লেখ করা হয়নি।'
এ জায়গাটি বরাদ্দ পাওয়ার যুক্তি তুলে ধরে সংসদ সদস্য তাঁর লিখিত পত্রে বলেছেন, এ পুকুর ভরাট করে শেখ রাসেল কনভেনশন অথবা কমপ্লেক্স নির্মাণ করা এলাকার বাসিন্দাদের দাবি। আর এ জন্যই খুব দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
তবে এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দারা পাইকপাড়ায় একমাত্র প্রাচীন বড় পুকুরটিকে টিকিয়ে রাখতে চান। পাইকপাড়া স্টাফ কোয়ার্টারের বাসিন্দা রোমান আহম্মেদ বলেন, 'আমরা সকাল-বিকেল এ পুকুরের চারপাশ দিয়ে হাঁটতে পারি। এখানে কোনো বহুতল ভবন হলে এ সুযোগটি আর থাকবে না। এ ছাড়া আমাদের জানা মতে, পুকুরের জায়গাটি স্টাফ কোয়ার্টারের অন্তর্ভুক্ত। ফলে পুকুরটি বাইরের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ পেতে পারে না।' টোলারবাগের বাসিন্দা মোখলেছুর রহমান বলেন, 'এলাকাবাসী পুকুর ভরাট করে কনভেনশন সেন্টার বা কমপ্লেক্স করতে বলেনি। আমাদের ধারণা, জায়গাটি দখল করে বহুতল ভবন বানিয়ে বিক্রি করতে কোনো একটি চক্র জনগণের নাম ব্যবহার করেছে।'
স্থানীয় সংসদ সদস্য বরাদ্দ চাওয়ার পর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে মিরপুর গণপূর্ত উপবিভাগ-২-কে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। মিরপুর ডিভিশনের প্রতিবেদনে (স্বারক নম্বর-৯০৬ তাং ১৪/০৬/২০১১) উপসহকারী প্রকোশলী ইমরান হোসেন বলেন, 'বরাদ্দ চাওয়া জায়গাটি (পুকুর) পাইকপাড়াস্থ সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের তালতলা আবাসিক এলাকার অন্তর্গত। জমির অবস্থা, পুকুর বিদ্যমান আছে ও পুকুর পাড়ে অবৈধ স্থাপনা আছে। জমির পরিমাণ, ৯৯১৫৩ দশমিক ২৫ বর্গফুট, অর্থাৎ ২ দশমিক ২৭৬ একর প্রায়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন এ স্থানটির একটি মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে।'
পুকুর ভরাট করে স্থাপনা তৈরির উদ্যোগের কথা স্বীকার করে আসলামুল হক এমপি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার এলাকায় একটি কনভেনশন সেন্টার বানাতে চাই। এ জন্য আমি পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি। তারা যেখানে ভালো মনে করবেন সেখানেই জায়গা দেবেন। আমার জানা মতে, ইতিমধ্যেই এ জায়গাটির ওপর (পুকুরের) একটি ডিজাইন করা হয়েছে। খুব শিগগিরই এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে বলে আমি আশাবাদী।'
গত মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পুকুরটি ইতিমধ্যেই অবৈধ দখলের কবলে পড়েছে। দক্ষিণ পাড়ের বেশ কিছু অংশ ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে একটি বস্তি। বস্তির বাসিন্দারা বেশির ভাগই পিডাবি্লউডির নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী। কয়েকজন বাসিন্দা কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা পিডাবি্লউডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়েই এখানে বসবাস করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, পিডাবি্লউডির উচ্চ পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে তাঁদের এখানে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু নেতাও নিয়মিত তাঁদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন। বস্তি ছাড়াও উত্তর পাশের কিছু অংশ ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি দোকান। পুকুরটির পশ্চিম পাড় বর্তমানে পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দা আকবর হোসেন চৌধুরী জানান, কিছুদিন আগেও দোকানগুলোর বেশির ভাগ অংশ ছিল পানির মধ্যে। অথচ ময়লা ফেলতে ফেলতে পুকুরটি এতটাই ভরাট হয়ে গেছে যে দোকানগুলোর পুরোটাই এখন মাটিতে।
দেখা যায়, আশপাশের সব কলোনির বর্জ্য এখন ফেলা হয় পুকুরে। ফলে একদিকে পুকুরের পানি দূষিত হচ্ছে অন্যদিকে পুকুরটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আবার স্থানীয়রা পুকুর পাড়ের খালি জায়গায় বিভিন্ন জিনিসপত্র রেখে একটা অংশ দখলে রেখেছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলেও ব্যাপারটি নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। পুকুরটি অস্তিত্ব সংকটে পড়ার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষের অবহেলাকেই অনেকটা দায়ী করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
মিরপুর গণপূর্ত উপবিভাগ ২-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হেদায়েত উল্লাহ মজুমদার অবৈধ দখলদারদের ব্যাপারে বলেন, কর্মচারীরাই অবৈধভাবে বসবাস করছেন। তাঁদের বেশ কয়েকবার নোটিশও দেওয়া হয়েছে। অবৈধ এ বস্তিটি উচ্ছেদের ব্যাপারে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে, যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন। পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তিনি বলেন, 'আমাদের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জনবল সংকটের জন্য নিয়মিত পুকুরটি পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না।'

No comments

Powered by Blogger.