দৃশ্যের অন্তরালে by লুৎফুন নাহার

নারীর বিশ্বজনীন যে প্রান্তিক অবস্থান, তার মধ্যে আরেক প্রান্তিকতার নারী কিশোরী এবং নারী যৌনকর্মী। পৃথিবীতে যত পেশা স্বীকৃত কিংবা অস্বীকৃতভাবে চলে এসেছে যুগের পর যুগ ধরে, যৌন পেশা তার একটি। পৃথিবীর অন্যতম আদি পেশা যৌন পেশা এক শ্রেণীর মানুষকে দাঁড় করিয়েছে যৌনকর্মীরূপে।


যুগ যুগ ধরে নারী যৌনকর্মী এবং তার বিরুদ্ধে চলমান শোষণ ও বৈষম্য যেন বেড়ে উঠেছে নিরবচ্ছিন্ন পরিপূরক হিসেবে। আর এ ইতিহাসের সঙ্গে যোগ হয়েছে নারীকে উপাদেয় ভোগ্যপণ্যরূপে প্রতীয়মান করার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি।
পথ, প্রাচীরঘেরা ঘর, হোটেল কিংবা যৌনপল্লী_ স্থান বিশেষে যৌনকর্মীদের বিরুদ্ধে এ শোষণের চিত্র প্রায় একই রকম। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত বহুমাত্রিক শোষণের হাতিয়ারের সঙ্গে যোগ হয়েছে সদ্য যৌন পেশায় প্রবেশকারী অল্প বয়সী কিশোরীকে 'স্টেরয়েড ড্রাগ' প্রয়োগের মাধ্যমে রাতারাতি তাকে প্রাপ্তবয়স্ক করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা। কিশোরী মেয়েটিকে স্টেরয়েড ড্রাগ সেবনে বাধ্য করা, আর না খেতে চাইলে তাকে শিকার হতে হয় অসহ্য শারীরিক নিপীড়নের, কখনও কখনও ঘরের দরজা বন্ধ করে উচ্চস্বরে ক্যাসেট প্লেয়ার চালু করেও তাকে প্রহার করা হয়।
যে স্টেরয়েড ড্রাগ নিয়ে এত কথা, যাওয়া যাক সে প্রসঙ্গে। চিকিৎসাশাস্ত্র মতে স্টেরয়েড ড্রাগ একটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, যা বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মাত্রা এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর নির্দিষ্ট মাত্রায় এটি প্রত্যাহারের প্রয়োজন হয়। ওষুধ বিশেষজ্ঞদের মতে, উপযুক্ত কারণ ছাড়া এর যথেচ্ছ ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার শুধু নীরব ঘাতকই নয়, ঘটাতে পারে মৃত্যুও।
স্টেরয়েডের শারীরবৃত্তীয় সূত্র অনুযায়ী এটি শরীরে এমন নির্ভরশীলতা তৈরি করে, ফলে দীর্ঘমেয়াদে সেবনকারী একে রাতারাতি পরিত্যাগ করতে পারে না। যদি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কেউ এটি পরিত্যাগ করে তাহলে মাথা ধরা, ক্ষুধামন্দা, রক্তচাপ কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন রকম প্রত্যাহারজনিত উপসর্গ দেখা দেয়, যার অভিজ্ঞতা তাকে আবার পুরনো অভ্যাসে অর্থাৎ স্টেরয়েড ড্রাগ সেবনে বাধ্য করে। অথচ সে জানে না এর পেছনে কী কারণ বিদ্যমান। স্টেরয়েড ড্রাগ না ছাড়তে পারার পেছনে এটিও একটি কারণ। এই বিষয়টিতে বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার।
২০০৫-০৬ সালে দৌলতদিয়া ও মাদারীপুর যৌনপল্লীতে সম্পন্ন একটি গবেষণায় দেখা যায়, ১৫-৩৫ বছর বয়সী যৌনকর্মীদের মধ্যে এটির ব্যবহার সবচেয়ে প্রকট। যৌনপল্লীর ৯০% মেয়েই বিভিন্ন স্টেরয়েড ড্রাগ সেবন করে। যেখানে নূ্যনতম ১ সপ্তাহ ব্যবহারে এটি প্রকট নির্ভরশীলতা তৈরি করে, সেখানে গবেষণার অভিজ্ঞতায় দেখা যায় বছরের পর বছর, গড়ে ৫-১০ বছর ধরে যৌনকর্মীরা এটি ব্যবহার/সেবন করে আসছে। ফলে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সৃষ্টি হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ শর্করা, ত্বকের বিভিন্ন সংক্রমণ, মাত্রাতিরিক্ত চর্বি, কিডনি, হরমোন তৈরির প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়া, যা শেষ পর্যন্ত সার্বিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর বিশাল প্রভাব ফেলে।
যৌনপল্লীতে কম বয়সী মেয়েদের আগমন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, স্টেরয়েডের ব্যবহার বিষয়ে অজ্ঞতা, মাঝ বয়সের যৌনকর্মীর রুগ্ণ স্বাস্থ্য, স্টেরয়েড ড্রাগকে ঘিরে হাতুড়ে ডাক্তারদের ব্যবসা, 'ভালো স্বাস্থ্য' বিষয়ে যৌনকর্মী ও খদ্দেরের সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি স্টেরয়েড ড্রাগ বিক্রিতে ওষুধ প্রশাসনের উদাসীনতাই যুগ যুগ জিইয়ে রেখেছে এর ব্যবহার।
 

No comments

Powered by Blogger.