ইতিহাসের বৈধতা by শহিদুল ইসলাম

এক. পার্থে এসে ঢাকার মতোই জীবন যাপন করছি। কাজ একটাই_পড়া, সেই সঙ্গে কিছু লেখা। সপ্তাহের পাঁচ দিন মেয়ের বাসায় একা থাকি। কথা বলার মানুষ নেই। তাই সময় কাটানোর জন্য বইয়ের ওপর নির্ভরতা আরো বেড়েছে। মেয়ে এখানকার আদিবাসীদের ওপর গবেষণা করে। তাই তার বাড়িতে আদিবাসীদের ওপর প্রচুর বই ও জার্নাল।


আদিবাসীদের ওপর যেমন অ-আদিবাসীদের ওপরও গবেষণামূলক বই আছে, তেমনি এখানকার আদিবাসীরাও তাদের ইতিহাস ও স্মৃতিচারণামূলক প্রবন্ধ ও বই লিখছেন প্রচুর।
আদিবাসীদের লেখা বইগুলো পড়ে আমার খুব ভালো লাগছে। কারণ তাঁদের লেখায় অন্য রকম স্বাদ পাওয়া যায়। ইতিহাসের যে প্রধান ধারার সঙ্গে আমাদের পরিচয়, এরা তার বিপরীত ধারার ইতিহাসের জন্ম নিচ্ছে বলে আমার মনে হয়। আজকের ইতিহাস ইউরোপকেন্দ্রিক। কারণ বর্তমান 'সভ্যতার' জনক তারাই। আমরাও ২০০ বছর তাদেরই অধীনে ছিলাম। আমরা আজও যথেষ্ট শিক্ষিত হইনি, সভ্য হইনি, আধুনিক হইনি বলে তাদের যেমন অভিযোগ আছে; আমরাও সে জন্য লজ্জাবোধ করি। আমরা তাদের লেখা ইতিহাস আজও ধর্ম পুস্তকের মতোই বিশ্বাস করি। আমরা কখনো চিন্তাও করি না, সে ইতিহাস কতটা সত্য বা মিথ্যা। আমরা আজও তাদের লেখা ইতিহাসের বৈধতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করিনি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ইউরোপকেন্দ্রিক ইতিহাসকে আজ সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে এক নতুন ধারার ইতিহাস রচনার কাজ শুরু করেছে।
তেমনি একটি বই লিনডা তুহিওয়াই স্মিথের (Linda Tuhiwai Smith) 'Decolonizing Methodologies : Research and Indigenous Peoples.' ১৯৯৯ সালে লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক থেকে জেড-বুকস লিমিটেড এবং নিউজিল্যান্ডের 'টহরাবৎংরঃু ড়ভ উধঃধমড় চৎবংং যৌথভাবে প্রকাশ করেছে। ২০০৫ সালে তার অষ্টম মুদ্রণ সম্পন্ন হয়েছে। আমি এই লেখাটি লিখতে আগ্রহী হলাম এই জন্য যে তিনি কলম্বাস সম্পর্কে যা লিখেছেন, তারই প্রতিধ্বনি আমি শুনতে পেলাম 'টহফবৎংঃধহফরহম চড়বিৎ : ঞযব ওহফরংঢ়বঁংধনষব ঈযড়সড়ংশু' বইয়ে চমস্কির কণ্ঠে। আমাদের জানা ইতিহাসের বিপরীত ধারা নিয়ে আমাদের দেশে কেউ কাজ করছেন বলে আমার জানা নেই।
দুই. আমরা সাধারণত কপারনিকাস, মার্টিন লুথার কিংবা ফ্রান্সিস বেকনকে আধুনিক সময়ের শুরুর নায়ক হিসেবে বর্ণনা করি। আধুনিক অর্থে আধুনিক বিজ্ঞান, পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং বুর্জোয়া সভ্যতা। স্মিথের কাছে কলম্বাস এদের চেয়েও বড়। ৫০০ বছর আগে কলম্বাস আমেরিকা 'আবিষ্কার' করে সর্বাত্মক ধ্বংস ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে 'আধুনিকতার' সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। উপনিবেশবাদী ইতিহাসে কলম্বাসের নাম আজও একজন দুঃসাহসিক অভিযাত্রী ও ভূখণ্ড আবিষ্কারক হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়। তারপর আরো অনেক অভিযাত্রী ইউরোপের মাটি ছেড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আবিষ্কারের সম্মান লাভ করেছেন। যেমন_ভাস্কো দা গামা, রবার্ট কুক প্রমুখ। তবে ওই সব দেশের আদিবাসীদের সঙ্গে পশ্চিমা (ইউরোপীয়) শক্তির সংঘাতের শুরু কলম্বাসের মাধ্যমে। ১৪৯২ সালে তিনি আমেরিকা 'আবিষ্কার' করেন। বিভিন্ন স্থান আবিষ্কারকরা একইভাবে গণহত্যা ও সম্পূর্ণ ধ্বংসের মাধ্যমে 'পশ্চিমাকে' স্থাপন করেন। তাই স্মিথ বলেন, 'কলম্বাসই হলেন উপনিবেশবাদের পিতা। তাঁদের পেছনে পেছনে আসে 'পুঁজিবাদ', পশ্চিমা রাজনৈতিক ভাবাদর্শ' এবং 'খ্রিস্টধর্ম'। আর তাঁদের সঙ্গে আসে নানা ধরনের অসুখ ও রোগবালাই। তাসমানিয়ান আদিবাসী গ্রেগ লেহম্যান মনে করেন, তাঁরা কোনো সভ্যতা ও জ্ঞান বিস্তারের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসেননি। আদিবাসীদের ধ্বংস করে তাদের জায়গা-জমি দখল করাই ছিল তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য। একে একে ডাচ, পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, ফ্রান্স বিভিন্ন দেশ দখল করে। 'আবিষ্কারকদের' মৃত্যুর পর প্রতিটি দেশে আসতে থাকে যুদ্ধবিশারদ, ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র, যাজক, মিশনারি, ঔপনিবেশিক অফিসার-বিচারক, শিল্পী, সাহিত্যিক যারা অধিকৃত অঞ্চলে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে। এভাবেই পৃথিবীতে ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপিত হয়।
তিন. এ বছর ৭ জানুয়ারি লিনডার এই বইটি সম্পর্কে লিখেছিলাম। ঢাকার একটি দৈনিকে ছাপাও হয়েছিল। তখন চমস্কির বইটি হাতের কাছে ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক গণবিক্ষোভ নিয়ে লেখার জন্য কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বইটি আনিয়ে নিই। অন্যায়ভাবে প্যালেস্টাইনদের বাস্তচ্যুত করে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হলেও সময়ের সঙ্গে একসময় ইসরায়েল বৈধতা পেয়ে যাবে কি না, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে চমস্কি কলম্বাসের কথা টেনে আনেন। লিনডা স্মিথের বিশ্লেষণের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যায় একালের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমআইটির প্রফেসর ইমেরিটাস নোয়াম চমস্কির বিশ্লেষণ। পাঠকদের এই খবরটি জানানোর জন্য আজকের এই লেখা। এটা প্রমাণ করে যুগে যুগে ইতিহাসের নতুন করে মূল্যায়ন হয়।
আধুনিক যুগের ইতিহাস নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে এবং সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী ইতিহাস আজ ক্রমেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। উত্তরে চমস্কি বলেন, 'হ্যাঁ বলতেই হয়। না বললেও আমাদের আবার বন্য শিকারি যুগে ফিরে যেতে হয়। কারণ ইতিহাস মাত্রই অবৈধ, যা একসময় বৈধতা পেয়ে যায়।' বলে তিনি প্যালেস্টাইনের সঙ্গে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারের সঙ্গে আমেরিকার আদিবাসীদের চমস্কির পূর্বপুরুষরা কেমন ব্যবহার করেছিল, তার তুলনা করে বলেন, 'প্যালেস্টাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের আচরণ তাঁর কাছে স্বর্গীয়। কলম্বাসের আগমনের পর আমাদের পূর্বপুরুষ এখানে রীতিমতো গণহত্যা করেছিল। শুধু এখানে নয়_সারা পৃথিবীতে। কলম্বাস যখন আমেরিকার উত্তরে রিও গ্রান্ডে পদার্পণ করেন, তখন সেখানে ১২ থেকে ১৫ মিলিয়ন আদিবাসী আমেরিকান বাস করত। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী সেশনে আসার পর লোকসংখ্যা দুই লাখে নেমে আসে। গণহত্যা যাকে বলে। পশ্চিম গোলার্ধের লোকসংখ্যা সম্ভবত ১০০ মিলিয়ন থেকে মাত্র পাঁচ মিলিয়নে নেমে আসে।
১৭ শতকের গোড়া থেকে শুরু হয় এই গণহত্যা। যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পর অবস্থার চরম অবনতি ঘটে। আদিবাসীদের ধরে এনে ছোট ঘেটোর মধ্যে বন্দি করে রাখে।
চার. সেই গণহত্যার ৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে_কলম্বাস 'আমেরিকা আবিষ্কারের' ৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নয়_জার্মানিতে 'ঞযব ঋরাব নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯২ সালে। বইটি পরে জার্মানরা বুঝতে পারে যে হিটলার 'ঞযড়ঁংধহফ ণবধৎ জবরপয' প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। বইটির আসল বক্তব্য হলো, হিটলারীয় পদ্ধতিতে সে সময়ের উপনিবেশবাদীরা পশ্চিম গোলার্ধকে উপনিবেশভুক্ত করতে চেয়েছিল। সেটা ৫০০ বছর টিকে আছে। এ কথা বলার পর চমস্কি বলেন, 'আমেরিকার ইতিহাসে সেই গণহত্যাকে বৈধ বলেই লেখা হয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক স্যামুয়েল ইলিয়ট মরিসন কলম্বাসের ইতিহাস লিখেছেন। ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সেই 'মহান' মানুষটি কী ভয়ানক মানুষ ছিলেন, সেই বইটা পড়লে তা বোঝা যায়। তাঁর বইয়ের মূল কথা 'Complete genocide'_সম্পূর্ণ গণহত্যা। তিনি নিজেই সেই গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ঔপনিবেশিক ইতিহাসে 'বীর' বলে পরিচিত। ইতিহাসে হালাকু খান, চেঙ্গিস খান গণহত্যাকারী বলে চিহ্নিত। আজ নয়া ইতিহাসে প্রমাণ হতে চলেছে যে 'আমেরিকা আবিষ্কারক' কলম্বাস তাদের চেয়ে কম বড় গণহত্যাকারী নয়। এভাবে মূল ঔপনিবেশিক মূলধারার ইতিহাস ক্রমেই হুমকির মধ্যে পড়তে চলেছে। পৃথিবীর আদিবাসীরাই সব নতুন করে ইতিহাস লিখতে শুরু করেছে শুধু তা-ই নয়, চমস্কির মতো মানুষও সেই ইতিহাস খুঁজে ফিরছেন। আমাদের দেশের ইতিহাসবিদদেরও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা উচিত বলে আমার মনে হয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.