ছাদ ধসের আতঙ্কে চলছে পাঠদান

ক্লাসরুমের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে এযাবৎ পাঁচ ছাত্রী মাথায় জখমপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রায়ই ছাদের একটু-আধটু পলেস্তারা খসে পড়ছে। ক্লাসে বসে আতঙ্কে থাকি, কখন যে মাথায় ছাদ ধসে পড়ে! এর মধ্যেই চলছে পাঠদান।' গতকাল বুধবার এ কথাগুলো বলল পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া মডেল কে এম লতিফ ইনস্টিটিউশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সাকিলা তারিন। আতঙ্কিত তারিন জানায়, ছয় কক্ষবিশিষ্ট ৮৩ বছরের পুরনো মূল স্কুল ভবনটি পরিত্যক্ত হওয়ার পর দুই বছর আগে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়েছে। দুই বছর ধরে বাইরে ত্রিপল টানিয়ে এবং বর্ষা মৌসুমে চার কক্ষের ঝুঁকিপূর্ণ বিজ্ঞান ভবনটি শ্রেণীকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে পাঠদান চলছে।
এতে শিক্ষার্থীরা একদিকে মৃত্যুর আতঙ্কে ক্লাসের সময় পার করছে, অন্যদিকে বিজ্ঞান ভবনে পাঠদান করায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিজ্ঞানাগারের অভাবে ব্যবহারিক যন্ত্রপাতি বাঙ্বন্দি হয়ে পড়ে আছে। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাই শুধু নয়, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া মডেল কে এম লতিফ ইনস্টিটিউশনের এক হাজার ৩১৯ শিক্ষার্থীর পাঠদান চলছে ভবনের ছাদধসের আতঙ্কের মধ্যে। সরকারি কাগজপত্রে বিদ্যালয়টি মডেল বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত। কয়েক বছর ধরে বরিশাল বিভাগের শ্রেষ্ঠ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং অব্যাহতভাবে ভালো ফল অর্জনকারী হিসেবে ৮৩ বছর ধরে বেশ সুনামের সঙ্গে চলছে বিদ্যালয়টি। অথচ মডেল স্কুল হয়েও বিদ্যালয়টি দুই বছর ধরে শ্রেণীকক্ষের সংকটে ভুগছে। মডেল স্কুলের আওতায় নতুন বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রায় ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। দরপত্র প্রকাশের এক বছর পেরোলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মো. রফিকুল ইসলাম বলে, 'এক বছর ধরে শুনছি আমাদের নতুন স্কুল ভবন হবে। বিজ্ঞান ভবনের ছাদ ধসে পড়ার আতঙ্ক নিয়ে ক্লাস করতে হচ্ছে। আতঙ্কে পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন স্কুল ভবন না হলে যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে শিক্ষা কার্যক্রম।' বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯২৮ সালে ১৫.৪৭ শতাংশ জমিজুড়ে মঠবাড়িয়া কে এম লতিফ ইনস্টিটিউশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিদ্যালয় উপজেলার ৪৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো। মানসম্মত শিক্ষার কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখানকার ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ী স্বীকৃতি লাভ করে। ৮৩ বছরের পুরনো কো-এডুকেশন পর্যায়ের এ স্কুলে ২৬টি শাখায় এক হাজার ৩১৯ ছাত্রছাত্রী নিয়মিত পড়াশোনা করছে। বিদ্যালয়টি প্রতিবছর ভালো ফল অর্জন করে। ১৯৮৮ ও ১৯৯৩ সালে পর পর দুইবার বরিশাল বিভাগে শ্রেষ্ঠ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছে। এসএসসি পরীক্ষায় এযাবৎ ১৯৬৬, ১৯৬৭, ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে মোট চারবার যশোর বোর্ডে প্রথম স্থান। ১৯৭৩ ও ১৯৮৩ সালে দুইবার দ্বিতীয় স্থান। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বোর্ডে পঞ্চম স্থান। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বোর্ডে অষ্টম স্থান। ১৯৮৯ সালে যশোর বোর্ডে ১৮তম এবং ১৯৮২ সালে যশোর বোর্ডে ১৬তম স্থান অর্জন করে। এ ছাড়া প্রতিবছর এ বিদ্যালয় থেকে গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি জিপিএ ৫ অর্জনসহ শতকরা ৯৬ ভাগ পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হওয়ার কৃতিত্ব অব্যাহত রয়েছে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ৮৩ বছরের পুরনো ছয় কক্ষবিশিষ্ট স্কুল ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় গত পাঁচ বছর আগে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। দুই বছর আগে ধসে পড়ার উপক্রম হলে ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। এতে বিদ্যালয়ে ছয়টি শ্রেণীকক্ষের মারাত্মক সংকট দেখা দেয়। এর পর থেকে শুকনো মৌসুমে স্কুলের সামনে ত্রিপল টানিয়ে এবং বর্ষা মৌসুমে চার কক্ষের জরাজীর্ণ বিজ্ঞান ভবনটিতে শ্রেণীকক্ষ হিসেবে পাঠদান করানো হচ্ছে। এতে বিজ্ঞান বিভাগের ব্যবহারিক ক্লাস যথাযথভাবে চলছে না। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানটি মডেল বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পেয়ে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা আবার বাতিল করা হয়। পরে আবার যাচাই-বাছাইয়ের পর দেশের ৩০৬টি বেসরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় এ প্রতিষ্ঠানও তালিকাভুক্ত হয়। ২০০৯ সালের ৯ মার্চ মডেল স্কুল উন্নীতকরণ প্রকল্পের পরিচালক প্রায় পাঁচ লাখ টাকার আসবাবপত্রসহ আনুষঙ্গিক শিক্ষা উপকরণ বরাদ্দ হয়েছে বলে চিঠি দিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চাহিদাপত্র নেন। অদ্যাবধি ওই বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। এরপর ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আবদুল হাই তালুকদার স্কুলের প্রকল্প পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন। এ সময় তাঁরা বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ ও বিজ্ঞান ভবন সংস্কারের আশ্বাস দেন। এর জন্য ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী দরপত্র আহ্বানের পর আবার তা অজ্ঞাত কারণে স্থগিত করা হয়। বর্তমানে নতুন ভবন নির্মাণ প্রকল্পটি এক রকম ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোস্তফা জামান খান বলেন, বর্তমানে স্কুল ভবনের অভাবে এক হাজার ৩১৯ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করতে হচ্ছে শ্রেণীকক্ষের তীব্র সংকটের মধ্যে। বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিজ্ঞান ভবনটি শ্রেণীকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে যথাযথভাবে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাস নেওয়া যাচ্ছে না। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় প্রায়ই ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে ছাত্রছাত্রী আহত হচ্ছে। এ ব্যাপারে শিক্ষা বিভাগের মডেল স্কুল প্রকল্পের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিদ্যালয়টি উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্যে একটি ভালো ও মডেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখেছি শ্রেণীকক্ষের সংকট। নতুন বিদ্যালয় ভবন অতীব জরুরি।' তবে ভবন নির্মাণের প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন বলে জানান তিনি

No comments

Powered by Blogger.