আলোচনা- জেগে ওঠার গল্প by হাসান ফেরদৌস

কদিন ধ্যানমগ্ন গৌতম একাকী প্রার্থনায় বসেছেন। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন সাধু। অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে তিনি বুদ্ধকে দেখলেন। একা চোখ বুজে কী যেন ভাবছেন তিনি, মুখজুড়ে তাঁর কী প্রশান্তি! কৌতূহলী হয়ে সেই সাধু গৌতম বুদ্ধকে প্রশ্ন করলেন, ‘মহাত্মন, আপনি কি প্রার্থনা করছেন?’ উত্তরে চোখ না খুলেই বুদ্ধ বললেন, ‘না, আমি জেগে ওঠার চেষ্টা করছি।’
নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম ‘থ্রি ফেইথস’ শিরোনামের একটি প্রদর্শনী দেখতে। সেখানে গল্পটি মনে পড়ল। থ্রি ফেইথস মানে ইহুদিধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলাম—এই তিন ধর্মের উদ্ভব মোটামুটি একই অঞ্চলে, তাদের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। তারা প্রত্যেকে একেশ্বরবাদী, তাদের প্রত্যেকের রয়েছে সুনির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ, অনেক আচার-অনুষ্ঠানই এক রকম, মৃত্যুর পর পরজন্মেও তারা বিশ্বাসী। পৃথিবীর প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ এই তিন ধর্মের অনুসারী। একই অঞ্চলের মানুষ। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে একে অপরের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে জড়িত। হয়তো রক্তের সম্পর্কও আছে। অথচ তা সত্ত্বেও তাদের তিনজনের মধ্যে গলাগলির চেয়ে গালাগালিটাই বেশি। প্রদর্শনীতে এই তিন ধর্মের অভিন্নতার কথাই তুলে ধরা হয়েছে। তা দেখতে দেখতে আমার মনে প্রশ্ন জাগল, সে সত্যে আমরা জেগে উঠব কবে?
আগে প্রদর্শনীর কথাটা বলে নিই। বছর তিনেক আগে ব্রিটিশ মিউজিয়াম ‘স্যাকরেড’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। তিন ধর্মের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ও পবিত্র বলে বিবেচিত এমন সব কাগজপত্র ওই প্রদর্শনীতে স্থান পায়। কথা ছিল, ওই প্রদর্শনী নিউইয়র্কেও হবে। কিন্তু যখন জানা গেল, প্রদর্শনীর প্রতিটি দর্শনীয় বস্তু মার্কিন কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে তার নিরাপত্তা বিভাগ খুলে দেখবে, তখন ব্রিটিশ মিউজিয়াম বেঁকে বসল। দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, কোনো কোনোটির বয়স হাজার-দেড় হাজার বছর। কাগজের নয়, পুরোনো প্যাপিরাসে বা ছাগলের চামড়ার ওপর লেখা সেই সব গ্রন্থ। টানাটানিতে তা নষ্ট হতে পারে। ভয় পেয়ে ব্রিটিশ মিউজিয়াম সরে পড়লে নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরি ঠিক করল, তাদের নিজের সংগ্রহে যা যা আছে, শুধু তা দিয়েই প্রদর্শনী হবে।
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে পবিত্র বলে বিবেচিত এমন ২০০টির মতো দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, নথি ও স্ক্রল। সবচেয়ে পুরোনো দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে ৯১৭ সালে ফ্রান্সের ব্রিটানির গির্জাঘরে সংরক্ষিত একটি বাইবেল। ভাইকিং জলদস্যুদের আক্রমণে পুরো অঞ্চল পুড়ে ছাই হয়, কিন্তু এই বাইবেলটি প্রায় অক্ষত অবস্থায় রয়ে যায়। ছাপাখানা শুরু হওয়ার পর প্রথম যে বাইবেল মুদ্রিত, তার একটি কপিও এখানে রয়েছে। ‘গুটেনবার্গ বাইবেল’ নামে পরিচিত এই গ্রন্থটি মুদ্রিত হয় ১৪৫৪-৫৫ সালের মধ্যে। প্রথম কোরআন মুদ্রিত হয় ১৬৪৯ সালে, তারও একটি কপি রয়েছে। এখানে সবচেয়ে পুরোনো যে ইহুদি ধর্মগ্রন্থটি রয়েছে, যা ‘হিব্রু বাইবেল’ নামে পরিচিত, সেটি হাতে লেখা, লিখিত হয়েছিল ১২৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। রয়েছে তুর্কি সম্রাটের জন্য হস্তে লিখিত অপূর্ব কারুকাজ সজ্জিত একটি কোরআন। মোগল আমলে প্রস্তুত ও কারুকাজ করা মিনিয়েচার কোরআনও রয়েছে একাধিক। জালাল উদ্দিন রুমির এক শিষ্য হুসাইন ইবনে হাসামের হাতে লেখা ১৩৩৩ সালের একটি কোরআন দেখে কয়েক মুহূর্ত কাটাতে হলো। বড় বড় অক্ষরে লেখা, সম্ভবত সে সময়ে কোনো প্রদর্শনীর জন্য তা প্রস্তুত করা হয়েছিল। এই গ্রন্থটি, শুধু এই গ্রন্থ কেন, সব কটি গ্রন্থই মুদ্রিত হয়েছে অসীম যত্নের সঙ্গে। হাতে লেখা বইগুলো দেখে বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। পরিষ্কার, গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, প্রতিটি পাতা অপূর্ব কারুকাজে সজ্জিত। যদি একজনের হাতে এসব পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে থাকে, তো তা শেষ করতে লেগেছে কয়েক মাস, হয়তো কয়েক বছর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজন্যবর্গের নির্দেশে, বা তাদের খুশি করতেই গ্রন্থগুলো হাতে লেখা। কিন্তু শুধু পুরস্কৃত হওয়া যাবে ভেবে এ গ্রন্থগুলো যে কেউ লেখেননি, তা বোঝা কঠিন নয়। এত যত্ন সম্ভব শুধু গভীর ভালোবাসা থেকেই।
যেভাবে এক হাজার-দেড় হাজার বছর আগে কাগজ বা মুদ্রণযোগ্য ট্যাবলেট বানানো হতো, রয়েছে তার সচিত্র বিবরণ। যে ধরনের কলম দিয়ে লেখা হতো—তার কোনোটি পাখির পালক, কোনোটি গাছের ডাল, কোনোটি প্রস্তর বা ধাতব, সেসবও সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অনেক গ্রন্থ লিখিত হয়েছে প্রাচীন পার্চমেন্ট কাগজে, কোনোটি আবার ছাগল বা হরিণের চামড়ায়। এলুম ও ডিমের সাদা অংশ দিয়ে তৈরি কাগজও রয়েছে। এসব কাগজ কীভাবে তৈরি হতো, তার সচিত্র বিবরণ রয়েছে। যে প্রাচীন ভাষায় এই গ্রন্থগুলো রচিত, তাদের লিপিতে বিস্তর মিল। হিব্রু ও আরবি—দুই ভাষাই লেখা হয় বাঁ দিক থেকে ডানে, তার মধ্যে মিল তো অভাবনীয়। অনেক শব্দ দুই ভাষাতেই ব্যবহূত হয়, তাদের উচ্চারণেও অনেক মিল। এই মিলটা আরও ভালোভাবে বোঝানোর জন্য তিন ভাষার হস্তলিপি বা ক্যালিগ্রাফি শেখার ব্যবস্থাও রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। প্রথমে ভিডিওতে দেখে নিতে হবে কীভাবে অক্ষরগুলো লিখতে হয়। কোন কলম দিয়ে, তার বাঁটের কোথায় আঙুল রেখে, কত ডিগ্রি কোনাকুনি ধরে সে কলম বা পাখির পালক দিয়ে লিখতে হবে, তাও শিখে নিতে হবে। তারপর প্রদর্শনীকক্ষে রাখা টেবিলে পছন্দের ভাষা অনুযায়ী হাতের লেখা মকশ করতে হবে। কাগজ, কলম—সবই মজুদ রয়েছে। প্রাচীন লিপিসহ মুদ্রিত কাগজ রয়েছে, কাচের ওপর আপনার কাগজখানা ধরে সে লিপি অনুকরণ করা এবার। যতক্ষণ না একজন সন্তুষ্ট হচ্ছেন, ততক্ষণ অনুকরণ করে যেতে পারেন, কেউ বাধা দেবে না। নানা বয়সের ছেলে-বুড়োকে দেখলাম, অধিকাংশই প্রাচীন ভাষায় নিজেদের নাম লেখার চেষ্টা করছে।
এই প্রদর্শনীকে আমি ধর্মীয় বলব না, যদিও ধর্মই তার একমাত্র প্রতিপাদ্য। এখানে আসলে যা রয়েছে তা হলো ইতিহাস। গত দুই হাজার বছরের এই ইতিহাস আসলে পৃথিবীর তিন ধর্মের মানুষের অভিন্ন ইতিহাস। আমরা কোনো কোনো আধুনিক পণ্ডিতের কাছে শুনেছি, এই তিন ধর্মের মানুষের মধ্যে ধর্ম নিয়েই ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ নাকি অনিবার্য। নিজের ধর্ম অন্য সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সে কথার বয়ান দিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন সেই পণ্ডিতদের কেউ কেউ। অথচ ঘনিষ্ঠভাবে দেখলে বোঝা যায়, এই তিন ধর্মের মানুষই একই ঈশ্বরের উপাসক, তাদের মূলমন্ত্রও অভিন্ন। মিল না খুঁজে আমরা অমিল খুঁজতে ব্যস্ত, ঠিক সে কারণেই দেখা দেয় সভ্যতার সংঘর্ষ।
তিন ধর্মের মিল নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় বিস্তর আলোচনা হয়েছে। হয়েছে এ ধরনের প্রামাণ্য প্রদর্শনী। কিন্তু আমাদের মতো দেশে অথবা কোনো আরব দেশে—এ রকম কোনো প্রদর্শনী হয়েছে বলে শুনিনি। হলে ভালো হতো, তাহলে যাকে শত্রু বলে জানি, সে যে আমার আত্মার আত্মীয়, সেই আশ্চর্য সত্যটি উদ্ধার সম্ভব হতো। সম্ভব হতো ঘুম থেকে জেগে ওঠা।
২২ অক্টোবর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে প্রদর্শনীটি। ইন্টারনেটে এই ঠিকানায় প্রদর্শনীটি দেখা যাবে: http://exhibitions.nypl.org/threefaiths
==========================
এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের  কানকুনঃ মুমূর্ষু পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ  নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক  সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন  সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প  রাষ্ট্রীয় সমাজে চিন্তা করার স্বাধীনতার প্রয়োজন  বাঙালের জলবায়ু দর্শন: ইঁদুরই কি শ্রেষ্ঠ জীব  প্রকৃতি- পাহাড়টির সঙ্গে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যও  স্মরণ- আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়া  আলোচনা- উইকিলিকসঃ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংগ্রাম  মুক্তিযুদ্ধ- মুজিব বললেনঃ তোমাদের এখনই ঢাকা ত্যাগ করা উচিত  আলোচনা- ডিজিটাল-প্র্রযুক্তিই মানুষকে আরও বেশি মানবিক করে!  খবর- সংরক্ষিত বনে শুঁটকিপল্লি  ট্রেনের ওপর ট্রেন  সংকেত অমান্য, দুই ট্রেনের সংঘর্ষ  আলোচনা- রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন ভাবনা


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ হাসান ফেরদৌস


এই লেখা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.