আইন কানুন- আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন by আশরাফ-উল-আলম

মানবাধিকার সংরক্ষণ ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এই আইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্তের শাস্তির ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো মানবাধিকার আদালত স্থাপনের কথা। এ কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন যাঁরা, তাঁদের বিচার পাওয়া এ দেশে সহজলভ্য নয়। এ রকম মন্তব্য করে মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ রয়েছে খোদ সরকারের বিরুদ্ধেই। বর্তমানে প্রচলিত আইনে মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা মানছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কেউ কমিশনের সুপারিশ না মানলে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে তাও আইনে স্পষ্ট করা নেই। এসব ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশনকে অসহায় মনে হয়। কাজেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন একটি অপূর্ণাঙ্গ আইন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
তাঁদের মতে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার একজন ব্যক্তিকে এই আইনের আওতায় প্রতিকার পেতে হলেও তাঁকে রীতিমতো ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকারের প্রক্রিয়া কয়েক স্তরবিশিষ্ট হওয়ায় মানবাধিকার কমিশনের মুখোমুখি হতে সহজে কেউ রাজি হবে না। ফলে মানবাধিকার কমিশনই একসময় কাগুজে প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০০৯ সালের ১৪ জুলাই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন পাস হয়। এর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ জারি করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের ১২ ধারায় কমিশনের কাজ কী হবে বা কমিশন কী কী তদন্ত করবে_তা বর্ণনা করা হয়েছে ১৯টি উপধারায়। এক. কোনো ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের প্ররোচনা সম্পর্কিত কোনো অভিযোগ স্বতঃই বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক দাখিলকৃত আবেদনের ভিত্তিতে তদন্ত করা। দুই. কোনো জনসেবক কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের প্ররোচনা বা অনুরূপ লঙ্ঘন প্রতিরোধের অবহেলা করা সম্পর্কিত কোনো অভিযোগ স্বতঃই বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক দাখিলকৃত আবেদনের ভিত্তিতে তদন্ত করা। তিন. জেল বা সংশোধনাগার, হেফাজত, চিকিৎসা বা ভিন্নরূপ কল্যাণের জন্য মানুষকে আটক রাখা হয় এমন কোনো স্থানের বাসিন্দাদের বসবাসের অবস্থা পরিদর্শন করা এবং এরূপ স্থান ও অবস্থার উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা। চার. মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য সংবিধান বা আপাতত বলবৎ কোনো আইনের অধীন স্বীকৃত ব্যবস্থাদি পর্যালোচনা করা ও তা কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা। পাঁচ. মানবাধিকার সংরক্ষণের পথে বাধাস্বরূপ সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা ও যথাযথ প্রতিকারের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা। ছয়. মানবাধিকারবিষয়ক চুক্তি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক দলিলাদির ওপর গবেষণা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা ইত্যাদি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজ অনেক। তার মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন বা লঙ্ঘন হতে পারে এমন অভিযোগের তদন্ত করবে মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে কী কী কাজ করলে তা এই আইনে বলা হয়নি। এমনকি মানবাধিকারের সংজ্ঞাও আইনে স্পষ্ট করা হয়নি। আইনের ধারা ২-এর উপধারা (চ)-তে মানবাধিকার অর্থ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ঘোষিত মৌলিক অধিকার এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে ঘোষিত মানবাধিকার, যা প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত। সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিল অনুযায়ী মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা সংঘটিত হয়। অথচ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় বাংলাদেশের আইনে আপস-মীমাংসার বিধান রাখা হয়েছে। যেমন_বিশেষজ্ঞরা বলেন, ধরা যাক, র‌্যাব বিনাবিচারে একজনকে ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করেছে। এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এ ঘটনার আপস-মীমাংসা কিভাবে সম্ভব? আইনের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, কমিশন কর্তৃক পরিচালিত তদন্তে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রকাশ পায়, তা হলে কমিশন বিষয়টি মধ্যস্থতা ও সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে পারবে। এই ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, সমঝোতা সম্ভব না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে মামলা বা অন্য কোনো কার্যধারা গ্রহণ করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবে কমিশন। তবে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন না করলে কী হবে তা আইনে উল্লেখ নেই।
মানবাধিকার কমিশনকে অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আইনের ১২(ক) ধারায়। কমিশনকে তদন্তে সহায়তা করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতাও কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। তবে কমিশনের ওই নির্দেশ না মানলে কমিশনের কিছু করার ক্ষমতা আইনে নেই।
কথিত 'ক্রসফায়ারে' বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কালিদাসিয়া গ্রামের আলাউদ্দিন হাওলাদারের মৃত্যুর বিষয়ে মানবাধিকার কমিশন পুলিশকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে একাধিকবার নির্দেশ দেওয়ার পরও পুলিশ ছিল নিশ্চুপ। এ বিষয়ে পুলিশের তৎকালীন আইজি নুর মোহাম্মদকে একাধিকবার চিঠি লিখেও তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি বলে সাবেক চেয়ারম্যান আমীরুল কবীর চৌধুরী অভিযোগ করেছিলেন। কাজেই এই কমিশন মানবাধিকার সংরক্ষণে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ ড. খন্দকার মোহাম্মদ মুশফিকুল হুদা (ব্যারিস্টার) কালের কণ্ঠকে বলেন, আগে মানবাধিকার আইন, তারপর মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। আইন করে দেশের জেলায় জেলায় মানবাধিকার আদালত গঠন করা না হলে মানবাধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্য সফল হবে না।
ড. মুশফিক বলেন, মানবাধিকারের সংজ্ঞার ভিত্তিতে কী কী কাজ করলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হবে, কারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেন তা আগে স্পষ্ট হতে হবে। বর্তমান আইনে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হলেও তাঁকে ঢাকায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আসতে হবে। তারপর তাঁর অভিযোগ তদন্ত হবে। এরপর সমঝোতার চেষ্টা হবে। এত কিছুর পর কমিশন অভিযোগের সত্যতা পেলে লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগ সুপারিশ অনুযায়ী কাজ না করলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান এই আইনে নেই। কাজেই কে মানবাধিকার কমিশনে নালিশ জানাতে আসবে? আবার এত দীর্ঘ প্রক্রিয়ার জন্যই বা কে বসে থাকবে? তাই অভিযোগকারী মানবাধিকার কমিশনে যাবেন না, সরাসরি হাইকোর্টে আসবেন। তিনি আরো বলেন, মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ নিয়ে যাওয়া যদি আরেক ভোগান্তি হয়, তা হলে এই কমিশনের দ্বারস্থ হবে না কেউ। এখন হয়তো কেউ কেউ যাচ্ছে; ভবিষ্যতে কেউ যাবে না।
=============================
১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের  কানকুনঃ মুমূর্ষু পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ  নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক  সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন  সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প  রাষ্ট্রীয় সমাজে চিন্তা করার স্বাধীনতার প্রয়োজন  বাঙালের জলবায়ু দর্শন: ইঁদুরই কি শ্রেষ্ঠ জীব  প্রকৃতি- পাহাড়টির সঙ্গে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যও  স্মরণ- আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়া  আলোচনা- উইকিলিকসঃ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংগ্রাম  মুক্তিযুদ্ধ- মুজিব বললেনঃ তোমাদের এখনই ঢাকা ত্যাগ করা উচিত  আলোচনা- ডিজিটাল-প্র্রযুক্তিই মানুষকে আরও বেশি মানবিক করে!  খবর- সংরক্ষিত বনে শুঁটকিপল্লি  ট্রেনের ওপর ট্রেন  সংকেত অমান্য, দুই ট্রেনের সংঘর্ষ  আলোচনা- রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন ভাবনা  আলোচনা- 'ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ঠাঁয় নেই দরিদ্রর উচ্চ শিক্ষা  বিশেষ আলোচনা- ফিরে দেখা গঙ্গা চুক্তি  আলোচনা- 'সংসদ বর্জনের অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক'  আলোচনা- 'উইকিলিকসে বাংলাদেশ, তারপর?  আলোচনা- 'ওয়াংগালাঃ গারোদের জাতীয় উৎসব'  স্মরণ- 'বাঘা যতীনঃ অগ্নিযুগের মহানায়ক'  খবর, কালের কণ্ঠের- আগেই ধ্বংস মহাস্থানগঃ হাইকোর্টের নির্দেশে কাজ বন্ধ  কেয়ার্নের সঙ্গে স্বার্থবিরোধী চুক্তির পেছনেও জ্বালানি উপদেষ্টা  উইকিলিকস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের আত্মসমর্পণ  সবুজ মাঠ পেরিয়ে  আলোচনা- 'আরো অনুদানের টাকা সরিয়েছিলেন ইউনূস'  আলোচনা- 'একটি 'উজ্জ্বল ভাবমূর্তির' এভারেস্ট থেকে পতন


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আশরাফ-উল-আলম


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.