গল্পসল্প- দাহকালের কথাঃ বাঘ by মাহমুদুজ্জামান বাবু

চালক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, যাত্রীসহ মোট মানুষের সংখ্যা ২২০০। ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দর থেকে একটি প্রমোদতরী নোঙর তুলে ভেসে পড়ল আটলান্টিক মহাসাগরে। গন্তব্য আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর। টাইটানিক নামের এই বিশাল জাহাজটি কখনোই আর নিউইয়র্কে পৌঁছায়নি। মহাসাগরে ভাসমান বরফখণ্ডগুলো কখনো কখনো ১০টি জাহাজের সমান আয়তনের হয়। তারই একটির সঙ্গে টাইটানিকের ধাক্কা লেগেছিল।
ফলে, যাত্রা শুরুর চার দিন পরই, ১৪ এপ্রিল টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল আটলান্টিক মহাসাগরে। উদ্ধারকারী দল বাঁচাতে পেরেছিল ৭০৫ জনকে। মৃতের সংখ্যা ১৫২২। মর্মস্পর্শী এই কাহিনি নিয়ে হলিউডের পরিচালক জেমস ক্যামেরন ১৯৯৭ সালে টাইটানিক নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে সারা দুনিয়ায় সেটি ব্যবসাসফল হয়েছিল দারুণ। নিদারুণ একটি মানবিক বিপর্যয়ের চলচ্চিত্র টাইটানিক-এর আয় ১৮৪ কোটি ৩২ লাখ এক হাজার ২৬৮ আমেরিকান ডলার। বাংলাদেশি টাকায় তার পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা শহরে প্রদর্শনীর সময় শত শত যুগল সেই ছবির প্রদর্শনীতে একাধিকবার গিয়েছিল, অনেক চড়া মূল্যে টিকিট সংগ্রহ করেছিল, প্রদর্শনী শেষে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল। কাঁদল কেন? কাঁদবেই তো! চলচ্চিত্রটিতে নায়ক লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও নিজে আটলান্টিকের বরফশীতল পানিতে ডুবে মরে প্রেমিকা কেটকে লাইফবোটে তুলে বাঁচিয়েছিল। আত্মত্যাগ দেখলে মানুষ কাঁদবে না? পুরুষতন্ত্রের প্রতিদিনের নিগ্রহ গায়ে মাথায় মনে মেখে যে মেয়েরা ভারতবর্ষীয় সমাজে বাঁচে, তাদের কাছে সেই দিন লিওনার্দো তো স্বপ্নপুরুষের মুখচ্ছবি। পুরুষেরাও নিশ্চয়ই কুপিত বোধ করেছে এই ভেবে, আহা...আমরা কেন অমন হই না!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টাইটানিক চলচ্চিত্র দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু ১৯১২ সালে তিনি বেঁচে ছিলেন। জাহাজডুবির ঘটনাটি তাকে আলোড়িত করেছিল। লিখেছেন,...‘দুই হাজার যাত্রী লইয়া আটলান্টিক সুমদ্রে এক জাহাজ পাড়ি দিতেছিল; সেই জাহাজ অর্ধরাত্রে চলমান হিমশৈলে ঠেকিয়া যখন ডুবিবার উপক্রম করিল তখন অধিকাংশ য়ুরোপীয় ও আমেরিকান যাত্রী নিজের জীবন রক্ষার প্রতি ব্যাকুলতা প্রকাশ না করিয়া স্ত্রীলোক ও বালকদিগকে উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিয়াছে। এই প্রকাণ্ড অপমৃত্যুর অভিঘাতে য়ুরোপের বাহিরের আবরণ সরিয়া যাওয়াতে আমরা এক মুহূর্তে তাহার অন্তরতর মানবাত্মার একটি সত্য মূর্তি দেখিতে পাইয়াছি।...’ (পথের সঞ্চয়—র.র. ১৩ খণ্ড)
বুঝতে কষ্ট হয় না, রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সমাজের সভ্যতার আলোকিত দিকটিই দেখে, দেখিয়েছিলেন আমাদের। নারী ও শিশুরা সমাজে সম্মান না পেলে সভ্যতার মানে কী! আজকের আমেরিকা-ইউরোপ হয়তো ওই সময়ের মতো নেই, পৃথিবীটা অর্থলোলুপদের ব্যবসাক্ষেত্র মাত্র, বাংলাদেশেও তা-ই হচ্ছে, তাই সুকুমার বৃত্তি মানবিক অনুভূতি—এসব কথা পাখি পড়ানোর মতো করে পড়াতে হচ্ছে সবাইকে। তাও মগজের বিকার নেই।
২৮ নভেম্বর কক্সবাজার পৌরসভা মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সেমিনারে দেওয়া বক্তব্যে ইসলামী ঐক্যজোটের জেলা সম্পাদক মাওলানা ইয়াসিন হাবিব বলেছেন, ‘ইভ টিজিং না থাকলে পৃথিবীর সব পুরুষ হিজড়া হয়ে যাবে। ইভ টিজিং না থাকলে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হবে। ইভ টিজিং করতে হবে শালীনতার মাধ্যমে। অনেক মহিলা হালকা কাপড় পরে বের হন পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। তাঁরা নিজেদের কারণেই ইভ টিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন।’ (আমাদের সময়, ২৯ নভেম্বর) ভাবুন একবার! এই মগজের মধ্যে গহিন অরণ্যের কী এক হিংস্র বাঘ জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে!
বাঘ তো এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কদিন আগে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক ছবিতে দেখলাম, দ্বীপরাষ্ট্র হাইতির একদল শীর্ণকায় মানুষ একটি ব্যানার উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজি ভাষায় সেখানে লেখা, ‘কলেরা এনেছে জাতিসংঘ’। পাঠক, জানেন নিশ্চয়ই, কিছুদিন আগের ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দেশটিতে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের বহুজাতিক সেনারা কাজ করছেন। এখন সেখানে মহামারি আকারে কলেরা ছড়িয়েছে। পাশের দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিকেও কলেরা শুরু হয়েছে। হাইতির মানুষের অভিযোগ, কলেরার জীবাণু বহন করে এনেছে শান্তি মিশনের নেপালি সেনারা। সে যা-ই হোক, মানবিক বিপর্যয়ের এই মূর্ত ও জ্বলন্ত সংকটটি প্রধান না হয়ে ‘বাঘ’ বড় হয়ে উঠল, কারণ বাঘও আজ বিপন্ন। অর্থে-বিত্তে উন্নত দেশগুলোর নানা রকমের রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে বাতাসে কার্বনের মাত্রা ছড়িয়েছে, বনভূমি বিপন্ন হচ্ছে, পৃথিবীর সবুজ শেষ হয়ে যাচ্ছে, তো বাঘ এখন কোথায় যাবে? চোরাশিকারি হামলা আর বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচতে মানুষের ধারালো পাল্টা আঘাতে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা কমছে বলেই প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ায় বাঘ সম্মেলনে গেলেন বাঘ বাঁচানোর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মতামত দিতে। টাইটানিক-এর নায়ক লিওনার্দো ১০ লাখ মার্কিন ডলার অনুদান দিলেন বাঘ রক্ষা তহবিলে। আর বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেল।
চাল, ডাল, তেল, আলু—এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লিওনার্দো বা বাঘের কারণে বাড়ছে না। বাড়ছে দেশের ‘সিন্ডিকেট’ নামের মানুষরূপী বাঘের জন্য। ‘সিন্ডিকেট’ শব্দের ব্যাখায় বাংলা একাডেমী অভিধান বলছে, ‘একই উদ্দেশ্যে বা স্বার্থে মিলিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সমবায়।’ এই সিন্ডিকেট কী করে? সহজ উত্তর, বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। বিনিময়ে লাভ করে। কত টাকা? চলুন, পরিসংখ্যান দেখি।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১০-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০-এ মোট খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে ৩৯৪ লাখ মেট্রিক টন। ৪০ শতাংশ কৃষকের হাতে রেখে বাকিটা আসে বাজারে। সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন কমিটির হিসাব অনুযায়ী, আমন মৌসুমে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ১৫ টাকা ও চালে ২১ টাকা খরচ হয়েছে। কেজিপ্রতি চার টাকা বা মণপ্রতি ১৫০ টাকা লাভ ধরলে এক কেজি চালের দাম হওয়ার কথা ২৫ টাকা। এই টাকায় চাল পাওয়া যাচ্ছে? খাদ্য দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে বাংলাদেশে চাল লাগে ৭০ কোটি কেজি। কেজিপ্রতি ১০ টাকা বাড়ালে লাভ প্রতিদিন ৭০ কোটি টাকা, মাসে দুই হাজার ১০০ কোটি, বছরে ২৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। গম, ভোজ্যতেল ও অন্যান্য পণ্যের হিসাবও দেওয়া যাবে এখানে। রাষ্ট্রের নাকের ডগায় বা পৃষ্ঠপোষকতায় ‘সিন্ডিকেট’ নামের এই দানবগোষ্ঠী বাংলাদেশকে কোথায় নিচ্ছে? মানুষকে?
ভাবনাহীন মগজের ভেতর ‘সিন্ডিকেট’ হাসছে। শুনতে পাচ্ছি?
===============================
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের  কানকুনঃ মুমূর্ষু পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ  নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক  সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন  সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প  রাষ্ট্রীয় সমাজে চিন্তা করার স্বাধীনতার প্রয়োজন  বাঙালের জলবায়ু দর্শন: ইঁদুরই কি শ্রেষ্ঠ জীব  প্রকৃতি- পাহাড়টির সঙ্গে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যও  স্মরণ- আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়া  আলোচনা- উইকিলিকসঃ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংগ্রাম  মুক্তিযুদ্ধ- মুজিব বললেনঃ তোমাদের এখনই ঢাকা ত্যাগ করা উচিত  আলোচনা- ডিজিটাল-প্র্রযুক্তিই মানুষকে আরও বেশি মানবিক করে!  খবর- সংরক্ষিত বনে শুঁটকিপল্লি  ট্রেনের ওপর ট্রেন  সংকেত অমান্য, দুই ট্রেনের সংঘর্ষ  আলোচনা- রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন ভাবনা  আলোচনা- 'ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ঠাঁয় নেই দরিদ্রর উচ্চ শিক্ষা  বিশেষ আলোচনা- ফিরে দেখা গঙ্গা চুক্তি


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ মাহমুদুজ্জামান বাবু
গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.