গল্পসল্প- সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

শিরোনামটি পড়ামাত্র এই প্রশ্নটি উঠতেই পারে, আমি কাদের সঙ্গে গল্পসল্প করার জন্য এই লেখাটি শুরু করেছি। উত্তরটি হচ্ছে, যাঁরা ভোটার আমার মতো, তাঁদের সঙ্গে, অর্থাৎ যাঁরা জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচনে অংশ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেন না, তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু আজকের গল্পসল্পের আসরে তাঁদের নিমন্ত্রণ না থাকলেও সংসদীয় গণতন্ত্র মেনে নিলে এবং সেটা না মানার কোনো উপায় না থাকায় (কারণ সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থার চেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থার নকশা এখন পর্যন্ত উদ্ভাবন করা যায়নি) আমাদের আসরে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সদস্যরা আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছেনই। সংসদ সদস্য বা জনপ্রতিনিধি এবং ডেলিগেট বা প্রতিনিধি একই সংজ্ঞার অন্তর্গত নন। ধরা যাক, একটি জাতীয় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সে সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের অধিকাংশ কৃষকই থাকবেন, কিছু থাকতে পারেন নেতা, যাঁরা কৃষক সমাজের ভালো-মন্দ বিষয়ে সক্রিয় কর্মকাণ্ডে নিবেদিত। এই ডেলিগেটরা নির্বাচিত নন, তাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হয় কিংবা তাঁরা স্বমনোনীত হন তাঁদের কর্মকাণ্ডের প্রতি আস্থার কারণে।
ইতিহাস পাঠে দেখা যায়, সাধারণ নাগরিকদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থাটি আদায় করতে হয়েছে এবং সে ব্যবস্থাটি তৎকালের রাজা কিংবা শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে অনিচ্ছার সঙ্গে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এই ব্যবস্থাটি মেনে নেওয়া হয়েছিল 'নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো' প্রবাদ বাক্যটির মতো, যাতে সরাসরি জনকর্তৃত্বে সরকারব্যবস্থা না প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যেহেতু জনপ্রতিনিধিরা শ্রেণী-ছাঁকনির কারণে উচ্চ ও বিত্ত শ্রেণীরই হবেন। যেমন বালি-পাথর মেশানো জল ছাঁকনিতে ঢাললে বালিকণা (জনগণ) নিচে পড়ে যায় আর পাথরকণা (বিত্তবানরা) ছাঁকনিতে আটকে থাকে। রূপক নয়, এবার বাস্তব একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৬৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৪টি বেসরকারি ব্যাংক রাষ্ট্রীকৃত করেন এবং সেটার পক্ষে এক বেতার ভাষণে বলেন, ভারতের মতো এক দরিদ্র দেশে অর্থনৈতিক ক্ষমতার শিখর ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। ইতিপূর্বে পদত্যাগকারী অর্থমন্ত্রী, মোরারজি দেশাই জাতীয়করণের সিদ্ধান্তকে উপহাস করে বললেন, 'যেসব রিকশাওয়ালা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে জড়ো হয়ে ব্যাংক জাতীয়করণের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছে, তারা ব্যাংক অথবা জাতীয়করণ বিষয়ে কিছুই জানে না'। উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বললেন, 'কেউ কেউ বলছেন যে রিকশাওয়ালা, মুচি, যারা আমার বাসভবনে ভিড় করছে, তারা ব্যাংক কিংবা জাতীয়করণ বিষয়ে কিছু জানে না। আমি তাদের কাছে জানতে চাই, যখন আমরা তাদের কাছে ভোট চাই তখন কি তাদের বলি, তোমরা গণতন্ত্র বিষয়ে কিছু জানো না?'
ইন্দিরা গান্ধীর প্রশ্নটির সম্পূরক হিসেবে আর একটি প্রশ্ন করা যায়, এ জন্য কি মূর্খ ভোটারদের তাদের সাংসদরা তুচ্ছ ভাবেন? সে কারণেই কি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েও তাঁরা জাতীয় সংসদে যান না? প্রায় দুই বছর হলো জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে, অথচ বিরোধী নেত্রী সংসদে উপস্থিত থেকেছেন পাঁচ দিন। সংসদীয় গণতন্ত্রের খেলার মাঠটি জাতীয় সংসদ। একটি উদাহরণ দিয়ে এ কথাটির অর্থ খোলাসা করা যাক। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করা একটি জনস্বার্থ বিষয় এবং এটা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া একজন জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব। তিনি সরকারি কিংবা বিরোধী দলের হন না কেন, তাঁর কাজটি হচ্ছে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণগুলো খুঁজে বের করা ও সমাধান করা। কিন্তু সেটা না করে সংসদ বর্জন করে হরতাল-মিছিল-বিক্ষোভ করে কি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? বরং সেটা করলে যানবাহনব্যবস্থা বিঘি্নত হয়ে দ্রব্যমূল্য আরো বৃদ্ধি পাবে কি না?
সম্প্রতি ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারি ধরা পড়েছে। টু-জি স্পেকট্রাম দুর্নীতি ফাঁস হওয়ায় সে দেশের কেন্দ্রীয় টেলিযোগাযোগমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তাঁর ও তাঁর সহযোগীদের দুর্নীতির ফলে রাষ্ট্র তথা জনগণের হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সেখানে বিরোধী দলগুলো হরতাল-মিছিল-বিক্ষোভ করছে না। দিলি্লর সড়কগুলোতে টায়ার পুড়ছে না কিংবা যানবাহনে অগি্নসংযোগ ও ভাঙচুর করা হচ্ছে না। তবে রাষ্ট্রের এত বড় ক্ষতিতে বিরোধী দলের পার্লামেন্ট সদস্যরা চুপ করে নেই। তাঁরা এই দুর্নীতির তদন্ত করার জন্য পার্লামেন্টে সর্বদলীয় সাংসদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের দাবিতে রীতিমতো চিৎকার করছেন। তবে সে চিৎকার রাস্তায় নয়, পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে করছেন। সরকারপক্ষ এ দাবি না মানায় তাঁরা পার্লামেন্ট অধিবেশন চলা বন্ধ করে দিয়েছেন চিৎকার-হৈচৈ-প্রতিবাদের মাধ্যমে। এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধিতা করার কায়দা।
প্রিয় পাঠক, আজকের গল্পসল্প বোধ করি গুরুগম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। এটাকে হাসিঠাট্টার পর্যায়ে এখন আনা যাক এবং সে কাজটিতে খ্যাতনামা সাহিত্যিক বনফুলের সাহায্য নিচ্ছি। তাঁর লেখা দুটি ছোটগল্পের অতিসংক্ষেপিত উদ্ধৃতি বা প্রতিলিখন দেব। গল্প দুটির একটির নাম 'মহামানব কেনারাম' এবং অপরটির নাম 'দেশ-দরদি কেনারাম'। সবাই জানে কেনারাম উদার-হৃদয় লোক। কেনারাম নতুন বিয়ে করেছে এবং তার বউ পুঁটিবালা সুন্দরী। বিধুভূষণ বলেছিল, তোমার বারান্দায় রোজ 'ক' এসে বসছে। ওকে আশকারা দিয়ো না। কেনারাম সেটা শুনল না, বরং আশকারা দিতে থাকল। সে একদিন দেখল 'ক' শুধু যে তার শয়নকক্ষে রয়েছে তা-ই নয়, বিছানায় উঠে বসেছে। তাকে দেখে 'ক' যে হাসি দিল, সেটা কেনারামের মনে হলো লজ্জা। এই উপলব্ধি হওয়ামাত্র কেনারামের সব রাগ জল হয়ে গেল। পরদিন পুঁটিবালা অন্তর্ধান করল। 'ক'কেও আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
কেনারাম তার যথাসর্বস্ব বিক্রি করে চৌমাথার কাছে এক টুকরো জমি কিনল। সেখানে ঠিক করল একটা উঁচু মর্মরবেদি বানিয়ে সে প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যা যে বাণীটি ঘোষণা করবে তার সারমর্ম এই, 'অপরের দোষ দেখিয়া নিজের দোষের কথা ভুলিও না। 'ক' চরিত্রহীন গুণ্ডা, কিন্তু আমি এ কথা ভুলিতে পারি না যে, আমার পিসতুতো শালার মাসতুতো ভাইও তাই। চন্দ্রে কলঙ্ক আছে, সূর্যে স্পট আছে, গোলাপে কণ্টক আছে। অপরের বীভৎস আচরণ দেখিলে বারবার এ কথাই আওড়াই যে, আমরাও বীভৎস। তাহা হইলেই শান্তি পাইবে, সমস্যারও সমাধান হইয়া যাইবে।' (মহামানব এখনো পাগলাগারদের বাইরেই আছে)।
দেশ-দরদি কেনারামের রোজনামচা : মাঝে মাঝে ভাবি আমি যেভাবে দেশের দুঃখ প্রত্যহ অনুভব করি, তেমনভাবে আর কেউ করেন কি না। আমি প্রত্যহ তিনখানি সংবাদপত্র পাঠ করিয়া বিচলিত হই, বিগলিত হই, বিহ্বল হই। ইচ্ছা করে চিৎকার করিয়া কাঁদি। কিন্তু কাঁদিতে পারি না। বোধ হয় দেশের দুর্দশার কথা ভাবিবামাত্র অশ্রু জমাট হইয়া যায়। আজ লক্ষ্য করিলাম চা ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে। শুধু তাহা-ই নয়, চায়ে একটি মাছি পড়িয়া ছটফট করিতেছে। মনে হইল স্বাধীনতাকাপে পড়িয়া দেশও ওইরূপ হাবুডুবু খাইতেছে। সকালে বাগানে বেড়াইতেছিলাম। সহজে একটি কালো জিনিস নজরে পড়িল। তুলিয়া দেখিলাম আমসি। একদিন আম ছিল, আজ আমসি হইয়াছে। মনে হইল, আমাদের দেশের অবস্থাও কি এইরূপ নয়? আমাদের দেশও একদিন আম ছিল, আজ আমসি হইয়াছে। একটি সিগারেট ধরাইয়া দেশের কথাই চিন্তা করিতে লাগিলাম। প্রতিটি খবরের কাগজের স্তম্ভে স্তম্ভে ক্রমাগত দুঃসংবাদ পড়িয়া অস্থির হইয়া পড়িয়াছিলাম। কিছুক্ষণ ভুলিয়া থাকিবার জন্য অবশেষে তাই সিনেমায় গেলাম। ছবি আরম্ভ হইল। দশটি যুবতীর নৃত্য-ভেলা আঁকড়াইয়া ধরিয়া গজল শুনিতে শুনিতে বেদনা-সমুদ্র পার হইতে লাগিলাম। (দেশ-দরদি কেনারামের রোজনামচার উপরোক্ত অংশটুকু তাঁহার ত্রিতল বাড়ির সম্মুখস্থ ডাস্টবিন হইতে পাওয়া গিয়াছিল।)
=========================
রাষ্ট্রীয় সমাজে চিন্তা করার স্বাধীনতার প্রয়োজন  বাঙালের জলবায়ু দর্শন: ইঁদুরই কি শ্রেষ্ঠ জীব  প্রকৃতি- পাহাড়টির সঙ্গে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যও  স্মরণ- আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়া  আলোচনা- উইকিলিকসঃ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংগ্রাম  মুক্তিযুদ্ধ- মুজিব বললেনঃ তোমাদের এখনই ঢাকা ত্যাগ করা উচিত  আলোচনা- ডিজিটাল-প্র্রযুক্তিই মানুষকে আরও বেশি মানবিক করে!  খবর- সংরক্ষিত বনে শুঁটকিপল্লি  ট্রেনের ওপর ট্রেন  সংকেত অমান্য, দুই ট্রেনের সংঘর্ষ  আলোচনা- রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন ভাবনা  আলোচনা- 'ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ঠাঁয় নেই দরিদ্রর উচ্চ শিক্ষা  বিশেষ আলোচনা- ফিরে দেখা গঙ্গা চুক্তি  আলোচনা- 'সংসদ বর্জনের অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক'  আলোচনা- 'উইকিলিকসে বাংলাদেশ, তারপর?  আলোচনা- 'ওয়াংগালাঃ গারোদের জাতীয় উৎসব'  স্মরণ- 'বাঘা যতীনঃ অগ্নিযুগের মহানায়ক'  খবর, কালের কণ্ঠের- আগেই ধ্বংস মহাস্থানগঃ হাইকোর্টের নির্দেশে কাজ বন্ধ  কেয়ার্নের সঙ্গে স্বার্থবিরোধী চুক্তির পেছনেও জ্বালানি উপদেষ্টা  উইকিলিকস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের আত্মসমর্পণ  সবুজ মাঠ পেরিয়ে  আলোচনা- 'আরো অনুদানের টাকা সরিয়েছিলেন ইউনূস'  আলোচনা- 'একটি 'উজ্জ্বল ভাবমূর্তির' এভারেস্ট থেকে পতন  গল্পালোচনা- 'আসি আসি করে আশিতে আসবে!'  রাষ্ট্র ও রাজনীতিঃ সবুজ মাঠ পেরিয়ে  স্মরণ- 'রবীন্দ্রনাথ—সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে'  স্মরণ- 'জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী'  আলোচনা- 'প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন পর্যায়'  আলোচনা- 'কর্মপরিবেশঃ স্বর্গে তৈরি'  গল্পালোচনা- ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...’  আন্তর্জাতিক- উইকিলিকসঃ হাটে হাঁড়ি ভাঙা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  গল্পসল্প- ওরা ধান কুড়ানির দল  শিক্ষা- আদিবাসী পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চাই  জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অর্থের মূল উৎস সৌদি আরব


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ,সুপ্রিম কোর্ট


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.