স্মরণ- 'মীর শওকত আলী বীর উত্তম : একজন বীরের প্রতিকৃতি' by ড. আশকার ইবনে শাইখ

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও সাবেক মন্ত্রী লে. জে. (অব.) মীর শওকত আলীর পরলোকগমন অনেকটাই আকস্মিক বলা চলে। ২০ নভেম্বর ঢাকার গুলশানের বাসভবনে হঠাৎ থেমে যায় তাঁর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া। যদিও তিনি বেশ কিছুদিন যাবৎই লিম্ফোমা নামে একধরনের ক্যান্সারে ভুগছিলেন; কিন্তু তাঁর মৃত্যুর মূল কারণ সেটি নয় বলেই ঢাকা থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি। মীর শওকত আলীর কথা নতুন করে বলা নিষ্প্রয়োজন। দেশের সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন তাঁর অবদানের কথা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে তাঁর সাফল্য ছিল অসাধারণ। আর এ জন্যই তাঁর খেতাবও জুটেছিল বীর উত্তম। অসীম সাহসী, স্পষ্টবাদী, ত্যাগী, মুক্তিযুদ্ধের এই সমরনায়ককে দেখেছি রণাঙ্গনে। বয়স তখন আমার পঁচিশের কোঠায়। কয়েকবার তাঁর সঙ্গে অস্ত্র হাতে কথাও হয়েছে। এসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টেনে এই নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করা আমার উদ্দেশ্য নয়, তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতেই আজ তাঁকে নিয়ে কয়েক লাইনের এই নিবন্ধ।
১৯৮১ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তারপর তিনি দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া ছাড়াও দুটি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা মেনে নিতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সমরনায়ক দলীয় ফোরামেও এ ব্যাপারে বরাবরই ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। এ জন্য দলের উঁচু স্তরের অনেকের কাছে তিনি পরিণত হয়েছিলেন চক্ষুশূলে। তার পরও তিনি তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসেননি এবং একপর্যায়ে দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পদত্যাগপত্র জমা দেন। ওই পদত্যাগপত্র দলের চেয়ারপারসন গ্রহণ না করে দফায় দফায় তাঁকে দলে সক্রিয় থাকার আহ্বান জানানো হলেও তিনি রাজনীতিতে আর সক্রিয় হয়ে ওঠেননি। এখানেই তাঁর মহত্ত্ব, বীরত্ব। মীর শওকত দেখিয়ে দিয়ে গেছেন ব্যক্তি ও দলের স্বার্থের চেয়েও দেশের স্বার্থ অনেক বড়। রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে নিয়ে তথাকথিত উন্নয়নের রাজনীতির ধারায় তিনি স্ববিরোধিতা দেখাননি। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের ব্যাপারে থেকে গেছেন আপসহীন। বিভিন্ন ফোরামে তিনি বরাবরই বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেই হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানের সঙ্গে, মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে দিতে হবে। আজ যখন দেশে মহাজোট সরকার গণদাবি ও তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে, তখন মীর শওকতের আকস্মিক এই প্রয়াণ খুব ব্যথিত করল আমাদের। ক্ষতিও করল অশেষ।
মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনা ধারণকারী বীর সৈনিক মীর শওকত অপরাজনীতির নষ্ট পানিতে নিজেকে ভাসিয়ে দেননি। তিনি এ ব্যাপারে কতটা অবিচল ছিলেন, এর প্রমাণ তো রয়ে গেছে তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলোর কর্মকাণ্ডে। আবারও বলি, এই স্পষ্টবাদী বীরের অনেক কিছুই অনুকরণ-অনুসরণযোগ্য। হ্যাঁ, রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল; কিন্তু তা কখনোই প্রকট রূপ নেয়নি। ক্ষমতা তাঁর কাছে মুখ্য ছিল না। দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমুক্তির যুদ্ধে তিনি যেমন ছিলেন আপসহীন তেমনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ঘাতক-দালালদের ব্যাপারেও ছিলেন অনুকম্পাহীন। এখানেও মুক্তিযোদ্ধা, বীর সৈনিক মীর শওকতের ভেতরকার দেশপ্রেমিক মীর শওকত আলীকে আমরা দেখতে পেয়েছি। তিনি রেখে গেলেন বীরত্বের ইতিহাস। তিনি যখন একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মিসর, জার্মানি, ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল ও সুদানে দায়িত্ব পালন করেছেন তখনো তাঁর কর্মোজ্জ্বল দক্ষতা আমাদের দৃষ্টি কেড়েছে। প্রথমে খাদ্য এবং পরে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীনও স্বচ্ছতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। জাতি ও দেশের প্রতি অকৃত্রিম দায়বদ্ধতার জন্যও তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ এই বীরের কাছে আমরা তাঁর জন্যই হয়ে রইলাম চিরঋণী। একজন মানুষের জীবনে এত অর্জন চাট্টিখানি কথা নয়। তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে বলতে চাই, বর্তমানের স্ববিরোধী রাজনীতিকরা তাঁর কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিলে দেশের ও মানুষের কল্যাণ হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক মীর শওকত আলী শারীরিকভাবে আজ আমাদের মধ্যে নেই বটে; কিন্তু তিনি তো তাঁর কৃতকর্মের মধ্য দিয়েই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন দীর্ঘকাল। মুক্তিযুদ্ধ ও এ দেশের সামগ্রিক ইতিহাসে তাঁর স্থানটি নির্দিষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। তাঁকে একজন সফল সমরনায়ক, সফল রাজনীতিবিদ এবং স্পষ্টবাদী, অঙ্গীকারবদ্ধ, প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতেই হবে। এক কথায় তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম বীর সেনানীর বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটল। তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
============================
আন্তর্জাতিক- 'মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ' by আহসান হাবীব  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিচিত্র সংকটের আবর্তে একটি বাড়ি' by এবিএম মূসা  ইতিহাস- 'হাজংমাতা শহীদ রাশিমনির স্মৃতিসৌধে' by দীপংকর চন্দ  গল্প- 'ঈর্ষার রং ও রূপ' by আতাউর রহমান  ডিজিটাল-প্রযুক্তি কি মানবতাবিরোধী প্রবণতা তৈরি করে? by মোহীত উল আলম  খবর- এক দশক পর ছেলের সঙ্গে দেখা হলো সু চির  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'ট্রানজিটঃ অর্থের বাইরে বাইরে প্রাপ্তিযোগও ভাবতে হবে' by কে এ এস মুরশিদ  খবর- আমনের বাম্পার ফলনেও বাড়ছে চালের দাম by ইফতেখার মাহমুদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি' by ফজলুল বারী  আলোচনা- 'খাদ্যনিরাপত্তা ও পশুসম্পদ' by ড. মো. সিদ আলোচনা- 'আমি বাস্তুহারা'_এ কথার মানে কী?' by এ এন রাশেদা  গল্পালোচনা- 'বাংলাদেশকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র' by মোস্তফা কামাল  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের যন্ত্রণা এবং নতুন মুক্তিযোদ্ধা সনদ' by হারুন হাবীব  খবর ও ফিচার- কয়েন-কাহিনী  প্রকৃতি- 'বৈরিতায় বিপন্ন বাঘ' by বিপ্লব রহমান  প্রকৃতি- 'সুন্দরবন ঘেঁষে রেললাইন!' by পার্থ সারথি দাস  খবর- কোরীয় সীমান্তে ব্যাপক গোলাবিনিময়ে নিহত ২  শিল্প-অর্থনীতি 'চামড়াশিল্প শিগগিরই সরছে না' by আলী আসিফ  ফিচার- ‘র‌্যাগিং : পৌষ মাস না সর্বনাশ?' by সমুদ্র সৈকত  ভর্তি এবার লটারিতে! by হাবিবুর রহমান তারেক ও তমাল আবদুল কাইয়ুম  আলোচনা- 'পেট্রোবাংলার ভূমিকা এবং কিছু প্রশ্ন' by ড. এম শামসুল আলম


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. আশকার ইবনে শাইখ
নিউইয়র্ক প্রবাসী গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধা


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.