আলোচনা- 'কানকুন সম্মেলনে আমাদের প্রত্যাশা' by শিরীন আখতার

আর ক'দিন পরেই মেক্সিকোর'র কানকুনে জাতিসংঘ আয়োজিত জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলনের ১৬তম সভা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করবে জলবায়ু বিপর্যয়ের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসাবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বের নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এই বিষয়টিকে বিশ্ব দরবারে উত্থাপন করতে। বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীরা তার সাথে প্রায় ২০০টির বেশি সংগঠন সারা দেশব্যাপী এ সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে কাজ করছে। এবারের কানকুন সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হবে যে সকল বিষয়ে তা হলো: ১. জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক তহবিলের অর্থ রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুদান হিসাবে বাংলাদেশকে দিতে হবে ২. অর্থ ব্যয়ে দাতাদের মুরবি্বপনা থাকতে পারবে না।
তহবিল কমিটিতে উন্নত দেশের পাশাপাশি স্বল্পোন্নত দেশের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে ৩. ২০২০ সালের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলিকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ১৯৯০ সালের তুলনায় ৪৫ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১৯৯০ সালের তুলনায় তা প্রায় ৯৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে ৪. গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ সর্বোচ্চমাত্রা ২০১৫ সালের মাত্রা কখনও অতিক্রম করবে না ৫. প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে এই শতাব্দীতে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দেয়া যাবে না। জলবায়ু তহবিলের জন্য শিল্পোন্নত ৩৭টি দেশকে তাদের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) দেড় শতাংশ দেয়ার দাবি তোলা।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের একটি জাতীয় সমস্যা। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশ গভীর সংকটের আবর্তে পড়ছে। এ কথা আজ সবাই জানে জলবায়ু বিপর্যয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। দুর্ভাবনার বিষয়টি হল, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। বিগত দিনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় তারই চাক্ষুস প্রমাণ। বাংলাদেশ দরিদ্র ও জনআধিক্য দেশ। তাই এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব নানামুখী ও সুদূরপ্রসারী সংকট তৈরি করছে। এটাও আজ সর্বজনস্বীকৃত যে জলবায়ু পরিবর্তন সকল মানুষের, বিশেষত দরিদ্রদের অস্তিত্বকে সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিপন্নতার মাত্রা নিয়ে আজ আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আইপিসিসি ইউএনএফসিসি'র চিহ্নিত সর্বাধিক বিপন্ন দেশের একটি বাংলাদেশ। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর দি এনভায়রনমেন্ট-এর ড. ক্যারোলিন সুলিভান প্রস্তাবিত ক্লাইমেট ভালনারিবিলিটি ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশ সবচেয়ে বিপন্ন একটি দেশ। জাতিসংঘ প্রণীত মোর্টালিটি রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী ভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিধসের কারণে সবচেয়ে বিপন্ন দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে। যুক্তরাজ্যের ম্যাপলক্রফট বিশ্বের ১৭০টি দেশে ৪২টি মাপকাঠি ব্যবহার করে জরিপ চালিয়ে সমপ্রতি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেটা অনুসারে আগামী ৩০ বছরে যে ১৬টি দেশ সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হিসেবে সামনে এসেছে বাংলাদেশ তার এক নম্বরে।
দক্ষিণ এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশ বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বিবেচনায় যেসব প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয় মনে রাখা জরুরি: বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ, এখনও যার ভূমি গঠন প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতের চেরাপুঞ্জি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের এলাকা; এই পানি প্রবাহিত হয় বাংলাদেশের উপর দিয়ে।
বাংলাদেশের আয়তন গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বেসিনের প্রায় ৭ ভাগ, কিন্তু এ অঞ্চলের প্রায় ৯৩ ভাগ পানি এর উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।
বিশ্বের ২৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জনঘনত্ব ষষ্ঠতম, জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশের বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন এবং চাষযোগ্য কৃষি জমি কমছে প্রতিবছর এক শতাংশ হারে। সবুজ-সুন্দর বাংলাদেশ, কৃষি ও প্রতিবেশ প্রকৃতি অনুসারে এতে ৩০টি স্বতন্ত্র কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল বিদ্যমান। ফলে এ দেশের প্রকৃতি ও মানুষের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বহুমুখী। এসব বহুমুখী প্রভাবের উলেস্নখযোগ্য হল: তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ ও তীব্রতা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জোয়ার-ভাটার উচ্চতা ও তীব্রতা, উপকূলীয় পস্নাবন ও জলাবদ্ধতা এবং উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মৌসুমি বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা ও হঠাৎ বন্যার ব্যাপকতা এবং নদী ভাঙ্গন বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং অনাবৃষ্টি, ঋতুপ্রকৃতির ধারাবাহিকতায় অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি। দিনে দিনে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব বাংলাদেশের জীব-বৈচিত্র্য ও মানুষের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠছে।। খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙ্গন এখানকার জনজীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'নারী' বলে উপকূল এলাকার নারীগোষ্ঠীর উপর এই ক্ষতির প্রভাব আরও এক ধাপ বেশি এবং সেই সাথে শিশুরাও এর ক্ষতির শিকার হচ্ছে ।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি ও অসংখ্য মানুষ মারা যায়। ১৯৬০, ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালে সংঘটিত তীব্র ঘূর্ণিঝড়কে মোকাবেলা করে উপকূলবতর্ী মানুষ যখন জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছে তখন ২০০৭ সালের টনক নাড়ানো বিধ্বংসী দুর্যোগ 'সিডর' তাদের সকল স্বপ্নকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ১৫ নভেম্বর, ২০০৭ উপকূলবাসীর জন্য একটি ভয়াল রাত। সেই রাতে ঘূর্ণিঝড় সিডর প্রলয়ঙ্করী রূপধারণ করে ঘন্টায় ২২০ থেকে ২৪০ কিলোমিটার গতিবেগে প্রথমে বংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা বরগুনায় এবং পরে একে একে আঘাত হানে পটুয়াখালী, বরিশাল, বাগেরহাট, খুলনা, মাদারীপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ সব উপকূলীয় জেলায়। বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। সিডর সুন্দরবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। হারিয়েছে অনেক পশু-পাখি ও ধ্বংস হয়েছে নানা প্রজাতির গাছ-পালা। জলোচ্ছ্বাস আর ঘূর্ণিঝড়ে ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেছে প্রায় চার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধকে। পর পর আরও কয়েকটি ছোট ছোট ঘূর্ণিঝড় হলেও আবারও ২০০৯ সালের ২৭ মে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় আইলা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হানে।
পরিবেশবিদরাও মনে করেন মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তনে দিনে দিনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে এবং এর ফলে বেশি বেশি জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা হবে। সিডর ও আইলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি এই সকল দুর্যোগ কিভাবে নারীর জীবনকে বিপর্যস্ত ও বিপদগ্রস্ত করে তোলে। ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী ও শিশুরা। আর যে সব নারী বেঁচে আছে দেখা যাচ্ছে সংসারের হাল সে সব নারীদের কাঁধে নিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বাস করে। শুধু পরিবেশগত দিক নয় অর্থনৈতিক দিক থেকেও ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত। উন্নয়ন সুবিধা না থাকায় দুর্গত এলাকায় কোন শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। কাজের অভাবে অমানবেতর জীবন-যাপন করছে নারী-পুরুষ সকলে। উপায় না দেখে পুরুষেরা কাজের সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে। শহরমুখী অনেকে পরিবারের খোঁজ-খবর নেয় না, টাকা-পয়সা পাঠায় না। এমনকি তারা আবার অন্যত্র বিয়ে করে। কিন্তু নারীরা ভিটা-মাটি পাহারা, সন্তানের একমাত্র অবলম্বন, তথ্যের অভাব (কোথায় গেলে কাজ পাওয়া যাবে), সিদ্ধান্তহীনতা, অসচেতনতা, নিরাত্তার অভাব ইত্যাদি কারণে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। আর যে নারী সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার দুর্ভোগ আরেক ধাপ বেশি। এরকম হাজারো সমস্যার মাঝে দিন অতিবাহিত করছে ঘূর্ণিঝড়-দুর্গত এলাকার নারীরা।
বাংলাদেশে সক্রিয় প্রায় ২০০টি স্থানীয়-আঞ্চলিক-জাতীয়-আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠনের জোট গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান (সিএসআরএল)। ২০০৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এই প্রচারাভিযানের যাত্রা শুরু হয়। প্রচারাভিযানের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হল জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশগুলোর নির্গমন কমানোর জন্য বৈশ্বিক পরিসরে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা, ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনসহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুভিটাচু্যতদের নির্গমনকারী দেশে অভিবাসনে অগ্রাধিকার প্রদান।
৮ নভেম্বর সিএসআরএল'র পক্ষ থেকে প্রতীকী জলবায়ু আদালত বসেছিল ঢাকায়। জলবায়ুর বিপর্যয়ের শিকার চারজন নারী-পুরুষের জবানবন্দী নেয়া হয়েছে। সবদিক বিচার করে এ আদালত বলেছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলো দায়ী এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য অভিযুক্ত দেশগুলোর প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। জলবায়ু আদালতের মূল উদ্দেশ্য হল ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে নিজেদের দাবি তুলে ধরতে উৎসাহিত করে দায়ী দেশগুলোর উপর চাপ দিতে জনমত তৈরি করা।
প্রতীকী জলবায়ু আদালতে ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য, জলবায়ু বিজ্ঞানী ও আইনবিদদের বক্তব্যের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ তুলে ধরেন বিজ্ঞ জুরি প্যানেল। পাঁচ সদস্যের এ জুরি প্যানেলের সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। প্যানেলের অন্য সদস্যরা হলেন- ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, হাসানুল হক ইনু এমপি, সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি ও এডভোকেট তারানা হালিম এমপি। এছাড়া প্রতীকী এ আদালতে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটেনের প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপি রুশানারা আলী, ব্রিটেনের কুইন্স কাউন্সিলর রিচার্ড লর্ড, খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ পিটার কাস্টার্স, ইউরোপিয়ান এ্যাকশন গ্রুপ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ-এর সমন্বয়কারী আনসার আহমেদ উলস্ন্লাহ্সহ দেশী-বিদেশী জনপ্রতিনিধি, আইন প্রণেতা, নীতি-নির্ধারক, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, জলবায়ু বিজ্ঞানী ও সম্পাদকবৃন্দ। আদালতে ভুক্তভোগী মানুষের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, ব্রাসেলসভিত্তিক আইনবিদ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন ও বিশিষ্ট জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ। জলবায়ু আদালতের সম্মানিত জুরি প্যানেলের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সুপারিশ করা হয়: উপস্থ্থাপিত সাক্ষ্য ও তথ্যের ভিত্তিতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, আদালতে উপস্থি্থত এই জেলে সম্প্রদায়ের মানুষের দুর্ভোগের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী। উপস্থ্থাপিত সাক্ষ্য ও আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত তথ্যাদির ভিত্তিতে আমরা নিশ্চিত, জেলে সম্প্রদায়সহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগের জন্য অধিক নির্গমনকারী সংযুক্তি-১ ভুক্ত দেশগুলোই দায়ী। তাই পরিবর্তনের যে অভিঘাত তার দায়ভার এ সকল রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে।
সাক্ষীদের সাক্ষ্য, সাক্ষ্যের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং আইনি প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে এটা সুপ্রতিষ্ঠিত যে, ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় জেলেদের একাধিক মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে। যা বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ দ্বারা স্বীকৃত। উপরোলিস্ন্লখিত মানবাধিকার লংঘনের প্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবার আইনি প্রতিকার পাওয়ার অধিকার এবং একই সাথে ক্ষতিপূরণসহ ক্ষতি পূর্ববর্তী জীবনে ফেরত যাওয়ার অধিকার রাখে।
জলবায়ু পরিবর্তন যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, জাতীয় উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ইত্যাদির জন্য হুমকি, সেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। এবং সে প্রেক্ষিতে জলবায়ু সংক্রান্ত ধারা যথোপযুক্তভাবে বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে সনি্নবেশিত করার সুপারিশ করছি। একই সাথে বাংলাদেশের জলবায়ু সংক্রান্ত কোন সুনির্দিষ্ট আইন নেই। ফলে এ আদালত দ্রুততম সময়ে এ সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করার সুপারিশ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা ইতিমধ্যেই ক্ষতির মুখে পড়েছে তাদের চিহ্নিত করে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানাচ্ছে।
ভবিষ্যতে যারা ক্ষতির হুমকিতে রয়েছে, তাদের ক্ষয়-ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে পরিকল্পিত অভিযোজনের ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানাচ্ছে। আদালত মনে করে যে, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে, এজন্য উপযুক্ত বরাদ্দ রাখতে হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তাবলয় আরো শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষ করে, উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নারীর বিশেষ বিপন্নতা বিবেচনায় উক্ত অভিযোজন পরিকল্পনায় নারী সংবেদনশীল কার্যক্রম হাতে নেয়া এবং তহবিল বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় বর্তমান আইনি কাঠামোটি যথেষ্ট নয় বিবেচনায় এই আদালত আরও দ্রুত এবং ব্যাপকমাত্রায় নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্যে একটি নতুন আন্তর্জাতিক বাধ্য-বাধকতামূলক আইন প্রণয়নের তাগিদ দিচ্ছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করছে।
যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন দায়ী, সেহেতু আন্তর্জাতিক পরিসরে দ্রুত নির্গমন হ্রাস করার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন রোধের জন্য আইনি বাধ্য-বাধকতাসম্পন্ন চুক্তির আলোচনায় সরকারকে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের অন্তভর্ুক্তি নিশ্চিত করতে হবে:
_ উষ্ণতা বৃদ্ধি যেন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম না করে তার কার্যকর ব্যবস্থ্থা নেয়া _ কার্বন- ডাই -অক্সাইড ঘনত্বের সর্বোচ্চ মাত্রা ২০১৫ সালের মধ্যে সীমিত করে ফেলা_ ব্যাপক নির্গমন হ্রাসের আইনি বাধ্য-বাধকতার সীমা বেঁধে দেয়া, (যা ২০২০ সালের মধ্যে নিরীক্ষাযোগ্য)_ দ্বিতীয় কমিটমেন্ট সময়কাল ২০১৭ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, যাতে উপরোক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হতে পারে। এবং তৃতীয় কমিটমেন্ট সময়কালের জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বেশি নির্গমনকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাধ্য-বাধকতার আওতায় আনা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচু্যত জনগোষ্ঠীর জন্য সহযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক অভিবাসন নিশ্চিত করতে একটি যথোপযুক্ত আন্তর্জাতিক বিধান ও কাঠামো তৈরি করা জরুরি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে সংশ্লিস্নষ্ট ফোরামে যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করছে। এ আদালত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছে যে, নারীর বিপন্নতা হ্রাসে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে যথোপযুক্ত স্থ্থানে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানাই।
মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সব পর্যায়ের আলোচনা ও সিদ্ধান্তে মানবাধিকারের বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা ও নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের আইনি সহায়তা দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি স্বাধীন স্থায়ী জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ট্রাইবু্যনাল (ওহফবঢ়বহফবহঃ, ঢ়বৎসধহবহঃ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঞৎরনঁহধষ ড়হ ঈষরসধঃব ঈযধহমব) প্রতিষ্ঠার সুপারিশ, মানুষের বাসযোগ্য করবার এক পৃথিবী গড়বার যে লড়াই চলছে ক্রমাগত সেখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় কিভাবে বাসযোগ্য হতে পারে এই পৃথিবী। কোটি কোটি মানুষের জীবনধারণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই উন্নত পরিবেশ এবং জনজীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বিশ্ববাসী। সম্পদ বাড়ছে কিন্তু তার বন্টন সুনিশ্চিত হচ্ছে না। বৈষম্য পাহাড়ের সমান উঁচু হচ্ছে ধীরে ধীরে। দেশে দেশে এই বৈষম্য, মানুষে মানুষে এই বৈষম্য, পুঁজিবাদী বিশ্বে ভোগবাদী নীতিমালায় এই বৈষম্য আরও জটিল হয়ে উঠছে। ভোগবাদীতারই এক চরম আকার ধারণ করেছে জলবায়ু বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন নীতি এই ভোগবাদী নীতির সঙ্গে যুক্ত। ধনী দেশগুলোর এই নীতির পরিণামে গরীব দেশগুলো আক্রান্ত হচ্ছে বার বার। সে কারণেই এই বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের এই অধিবেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দয়া- দাক্ষিণ্য, অনুদান পাবার জন্য নয় বরঞ্চ বাংলাদেশ এবং তার আঞ্চলিক হিস্যা আদায় করাই হবে মূল উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। সেই বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকাতে দাতা সংস্থার সাহায্য চায় না বরঞ্চ যে সকল ধনী দেশের পরিকল্পনাহীন নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে গরীব দেশগুলো তাদেরকে চিহ্নিত করে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ চাইবার জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। তাই কানকুন সম্মেলন হবে মর্যাদা রক্ষা করবার সম্মেলন।
===========================
আলোচনা- 'জনসংখ্যার বিপদ ও পরিত্রাণের পথ'  শিল্প-অর্থনীতি 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি:দুর্ভাবনার বিষয়' by ড. আর. এম. দেবনাথ  গল্পসল্প- 'হায়রে নাড়ি ছেঁড়াধন' by শিখা ব্যানার্জী  গল্পসল্প- 'জননী ও জন্মভূমি' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- ''বিভীষণ' বিদায় ও হরতাল সমাচার' by শুভ রহমান  খবর- হরতালের বিরুদ্ধে একজোট, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা  আলোচনা- 'হজ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে কিছু কথা' by এয়ার কমোডর (অব.) মুহম্মদ জাকীউল ইসলাম  শিল্প-অর্থনীতি 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেতন-কাঠামো' by খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ  স্মরণ- 'মীর শওকত আলী বীর উত্তম : একজন বীরের প্রতিকৃতি' by ড. আশকার ইবনে শাইখ  আন্তর্জাতিক- 'মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ' by আহসান হাবীব  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিচিত্র সংকটের আবর্তে একটি বাড়ি' by এবিএম মূসা  ইতিহাস- 'হাজংমাতা শহীদ রাশিমনির স্মৃতিসৌধে' by দীপংকর চন্দ  গল্প- 'ঈর্ষার রং ও রূপ' by আতাউর রহমান  ডিজিটাল-প্রযুক্তি কি মানবতাবিরোধী প্রবণতা তৈরি করে? by মোহীত উল আলম  খবর- এক দশক পর ছেলের সঙ্গে দেখা হলো সু চির  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'ট্রানজিটঃ অর্থের বাইরে বাইরে প্রাপ্তিযোগও ভাবতে হবে' by কে এ এস মুরশিদ  খবর- আমনের বাম্পার ফলনেও বাড়ছে চালের দাম by ইফতেখার মাহমুদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি' by ফজলুল বারী


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ অধ্যাপক শিরীন আখতার
রাজনীতিক ও নারী নেত্রী


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.