শিল্পি- 'সফিউদ্দিন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র-অশেষ আলোর আধার' by সৈয়দ আজিজুল হক

বাংলাদেশের শিল্পানুরাগীদের জন্য এ এক গভীর আনন্দের খবর যে, এ দেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক ও এ দেশের পথিকৃৎ শিল্পীদের অন্যতম শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদের (জন্ম ১৯২২) সমগ্র শিল্পকর্মের এক প্রদর্শনীর দ্বারোদ্ঘাটন করা হবে আজ। ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ে দুই পর্বে অনুষ্ঠেয় এ প্রদর্শনীর প্রথম ভাগে (২৬ নভেম্বর-৯ডিসেম্বর) থাকবে তাঁর ছাপচিত্রসমূহ এবং দ্বিতীয় ভাগে (৯-২৩ ডিসেম্বর) থাকবে রেখাচিত্র ও তেলচিত্রসমূহ। ১৯৩৬ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর যিনি তাঁর জীবনকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেন শিল্পের জন্য এবং শিল্পচর্চাকে গ্রহণ করেন গভীরতর সাধনা হিসেবে এবং ৮৬ বছর বয়স পর্যন্ত (অসুস্থ থাকার কারণে গত দুই বছর ধরে কাজ করতে অপারগ)
নিরবচ্ছিন্নভাবে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন সৃষ্টিশীলতার মধ্যে, তিনি কিন্তু একক প্রদর্শনীর ব্যাপারে ছিলেন বরাবরই অনাগ্রহী। তাঁর ৮৮ বছরের জীবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র দুটি একক প্রদর্শনী: প্রথমটি লন্ডনে (১৯৫৯), দ্বিতীয়টি ঢাকায় (২০০৮) শুধু রেখাচিত্র নিয়ে। এই পর্যন্তই। যদিও গুরুত্বপূর্ণ যৌথ প্রদর্শনীসমূহে তিনি সব সময়ই অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তাতে শিল্পানুরাগী দর্শক তাঁর সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে কতটুকুই বা পরিচিত হতে পেরেছে। সে কারণে তাঁর সকল শিল্পকর্মের এই প্রদর্শনী দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের জন্যই এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে। দেশের শিল্পরসিক দর্শক তাঁর দীর্ঘ বাহাত্তর বছরের (১৯৩৬-২০০৮) একান্ত শিল্পসাধনার মাধ্যমে অর্জিত সকল সৃষ্টিকে আগামী চার সপ্তাহ ধরে দেখার সুযোগ পেয়ে নিজেদের নিশ্চিতভাবে ধন্য মনে করবেন।
সফিউদ্দিন আহমেদকে বাংলাদেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক বললে কম বলা হয়। বিশ শতকের প্রথমার্ধে ছাপচিত্রকে উন্নত আধুনিক শিল্পের মহিমায় উন্নীত করার ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় পর্যায়ে যে অল্প কয়েকজন শিল্পীর নাম অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, সফিউদ্দিন আহমেদ তাঁদের অন্যতম। ছাপচিত্রের যেসব মাধ্যমে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি সার্থক হয়েছেন সেগুলো হলো: উড এনগ্রেভিং, ড্রাই পয়েন্ট, এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, মেটাল এনগ্রেভিং প্রভৃতি। শুধু ছাপচিত্র না, একই সঙ্গে তেলচিত্র ও রেখাচিত্রেও তিনি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্পর্শ করেছেন সাফল্যের চূড়া। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি যে দুটি মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন তা হলো: রেখাচিত্র ও তেলচিত্র। এতগুলো মাধ্যমে সফলভাবে কাজ করার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের চিত্রকলা জগতে আর নেই।
আসলে মাধ্যমগত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্রতী হওয়ার বিষয়টি তাঁর শিল্পবৈশিষ্ট্যেরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেখা যায়, কোনো একটি মাধ্যম নিয়ে কিছুদিন অনুশীলনের পর সেটি ছেড়ে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছেন অন্য একটি মাধ্যমের চর্চায়। যেমন, নিয়মিত ছাত্রজীবনের (১৯৩৬-৪২) পর তিনি আর জলরং মাধ্যমে ছবি আঁকেননি। ছাত্রজীবনেই শুরু করেছিলেন উড এনগ্রেভিংয়ের চর্চা, সেটি লন্ডনে যাওয়ার (১৯৫৬) পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কলকাতায় শিক্ষকতা কোর্সে অধ্যয়নকালে (১৯৪৪-৪৬) ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন, তারপর আর আঁকেননি। ওই সময়েই কোর্সের প্রয়োজনে লিথোগ্রাফি ও মুরাল পেইন্টিংয়ের চর্চা করেছিলেন, কিন্তু পরে আর এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি। ওই সময়েই তিনি অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে চিত্র রচনা করেছেন। ঢাকায় এসেও এ মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন। এবং লন্ডন গিয়ে এচিং মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষা লাভের পর এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, সফটগ্রাউন্ড, লিফটগ্রাউন্ড, ডিপ এচ প্রভৃতি নানা মাধ্যমের মিশ্রণ ঘটিয়ে চিত্র রচনা করেছেন। লন্ডনে শিখেছেন আরেকটি নতুন মাধ্যম: কপার এনগ্রেভিং (তাম্রতক্ষণ)। সুতরাং উড এনগ্রেভিং পরিত্যাগ করে এরপর তিনি এই নতুন মাধ্যমেই তক্ষণশিল্প রচনা করেছেন। তাঁর ছাপচিত্রের অনুশীলন শুরু হয়েছিল উড-এনগ্রেভিং দিয়ে, শেষ হয়েছে কপার-এনগ্রেভিং-এর মাধ্যমে। তাঁর এই শিল্পযাত্রায় লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো: কোনো কোনো মাধ্যমের চর্চায় তিনি একপর্যায়ে নিজে আগ্রহ বোধ করেননি, কোনো কোনো মাধ্যমে যথেষ্ট উন্নতি সাধনের পর তাঁর মনে হয়েছে, এ ক্ষেত্রে তাঁর আর কিছু দেওয়ার নেই, কোনো কোনো মাধ্যমে তিনি নিজেকে দীর্ঘকাল গভীরভাবে নিয়োজিত রেখে ওই মাধ্যমের সম্ভাবনাসমূহকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে উৎকর্ষমণ্ডিত করে তুলেছেন।
সফিউদ্দিন আহমেদের শিল্পরুচি গঠনে তাঁর পরিচ্ছন্নতার প্রতি ঝোঁক, সংগীতানুরাগ, জ্ঞানানুশীলনে আগ্রহ, নিয়মনিষ্ঠা প্রভৃতির রয়েছে সুগভীর প্রভাব। তাঁর চিত্রের মধ্যে পরস্ফুিটিত হয়েছে নাগরিক রুচি ও বৈদগ্ধ্য। কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলীর উন্নত শিল্পাদর্শ ও ব্যক্তিত্ব তাঁর শিল্পভাবনায় এনেছে বিশুদ্ধতার প্রতি প্রবল আকর্ষণ এবং শিল্পচর্চাকে সাধনা হিসেবে গ্রহণের দৃঢ়তা। শিল্পের তৃষ্ণাই তাঁর মধ্যে জন্ম দিয়েছে নিসর্গ অনুশীলনের আগ্রহ। এ সূত্রেই তিনি অনুধাবন করেছেন প্রকৃতির বিশালত্বকে; তাঁর চিত্রে এসেছে বিরচন-কৌশলের দক্ষতা; এসেছে উন্নত পরিপ্রেক্ষিতের বোধ। সাঁওতাল পরগনার দুমকায় গিয়ে তিনি যথার্থভাবে অনুধাবন করেছেন প্রকৃতির স্বরূপসহ তার আত্মাকে। ফলে চিত্রের ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন প্রকৃতির বিশাল পরিপ্রেক্ষিতকে। ক্ষুদ্রায়তনে বিশালত্বের ব্যঞ্জনা সৃষ্টির বিষয়টি এভাবে পরিণত হয়েছে তাঁর চিত্রধারারই অন্যতম বৈশিষ্ট্যে।
১৯৪৭-এ নিজ জন্মস্থান কলকাতা থেকে উন্মূলিত হয়ে ঢাকায় নতুন বসতি নির্মাণের পর তিনি নতুন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। দুই বাংলার প্রাকৃতিক স্বাতন্ত্র্য সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। ওখানকার প্রকৃতিতে ছিল ধূসরতা, এখানে এসে দেখেন নীলাভ সবুজের ছড়াছড়ি। নীল ও সবুজকে মিশিয়ে আকাঙ্ক্ষিত এফেক্ট আনতে তাঁর লেগেছে বেশ কয়েক বছর। তাঁর তেলচিত্রে নীল ও সবুজের সূক্ষ্ম ও পরিমার্জিত ব্যবহার দেখলে এই সাধনার বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। এ ছাড়া তিনি পরিচিত হন এখানকার বন্যার সঙ্গে। সেই সঙ্গে জাল-মাছ ও নৌকার সঙ্গে। তিনি দেখেন লোকজীবনের বৈচিত্র্য। এ কালপর্বে তাঁর ছবিতে পরস্ফুিটিত হয় লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্য।
লন্ডনে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সফিউদ্দিন আহমেদের চিত্রধারায় অবয়বধর্মী বাস্তবতাই ছিল মুখ্য। অবয়বকে তিনি ইতিমধ্যে ভাঙলেও তা নিজ পরিচিত রূপকে পুরোপুরিভাবে বিনাশ করেনি। কিন্তু লন্ডনে যাওয়ার পর অবয়বকে তিনি এতটাই ভাঙচুর করেন যে তা তাঁর পরিচিত রূপকে পুরোপুরিভাবে হারিয়ে ফেলে। এভাবেই তিনি বিশ শতকের মধ্য লগ্নে বিশ্বশিল্পে সংঘটিত আধুনিক ধারাকে অঙ্গীকার করেন। ফলে তাঁর চিত্রের জমিনে এসে ভিড় করে নানা অপরিচিত রূপকল্প (ইমেজ)। প্রতীক ও রূপকের ব্যাপক ব্যবহারে তাঁর চিত্র সম্পূর্ণ নতুন রূপ ধারণ করে। সেই সঙ্গে তিনি ব্রতী হন টেকনিকের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। সূক্ষ্ম রেখার পাশাপাশি ছাপচিত্রে স্থূল ও মোটা রেখা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিরীক্ষায় রত হন তিনি।
লন্ডনের শিক্ষা তাঁর চিত্রের বিষয় ও কলাকৌশলে যে পরিবর্তন আনে, তাতে রূপক-প্রতীকের আশ্রয় গ্রহণ হয়ে ওঠে অনিবার্য। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও অব্যাহত থাকে এই ধারা। একালে চোখ তাঁর ছবিতে বিশেষভাবে প্রতীকী ব্যঞ্জনার দ্যোতক হয়ে ওঠে। একথা ঠিক, ষাটের দশকে মাছের রূপাবয়ব ও নৌকার গলুই তাঁর চিত্রে চোখের আদল পেয়েছে। কিন্তু আশির দশকে তিনি সরাসরি চোখের মোটিফ ব্যবহার করে আঁকেন একগুচ্ছ তাম্রতক্ষণচিত্র, যা চোখের এক নতুন রূপ বা অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা শহরে অবস্থানকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করেন শিল্পী। সীমাহীন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই তিনি লক্ষ করেন ওই বর্বর বাহিনীর রক্তলোলুপ আক্রমণের দৃশ্য। এসব আতঙ্কজনক পরিস্থিতির ভয়াবহ স্মৃতি তাঁর মস্তিষ্ককোষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান ছিল। চোখের নানা অভিব্যক্তি পরস্ফুিটিত করার মধ্য দিয়ে তিনি ওই পরিস্থিতিকেই যেন আভাসিত করেন। এ পর্বেই তেলচিত্রে নারীর বিষাদমাখা চোখ এঁকেও তিনি একাত্তরের নির্যাতন-নিপীড়নসহ ভয়ংকর দুঃখকাতর পরিস্থিতিকে প্রতীকায়িত করেছেন।
এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, মেটাল এনগ্রেভিং মাধ্যমে তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেন সার্থক সব চিত্রকর্ম। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সবচেয়ে সার্থক দৃষ্টান্ত তাঁর ‘জলের নিনাদ’ (১৯৮৫) শীর্ষক শিল্পকর্মটি। এটি করার জন্য তিনি ছাপচিত্রের প্রায় সবগুলো মাধ্যমকে একসঙ্গে ব্যবহার করেন। এর আইডিয়াটা তিনি নেন অর্কেস্ট্রা থেকে। অর্কেষ্ট্রায় একসঙ্গে শত লোক বাদ্যযন্ত্র বাজায়, কখনো তার সুর হয়ে যায় ভীষণ চড়া, আবার কখনো তা নামতে নামতে নেমে যায় একবারে সূক্ষ্ম খাদে, আচ্ছন্ন হয়ে যায় বিষাদে। এই যে চড়া সুর থেকে খাদে নামিয়ে আনা, সবগুলো যন্ত্রকে একসঙ্গে বাজানো এবং তার মধ্যে এক অপূর্ব সমন্বয় সাধনের অসাধারণ দক্ষতা অর্কেস্ট্রায় আছে, তা থেকেই তিনি পরিকল্পনা করেন ছাপচিত্রের সবগুলো মাধ্যমকে ব্যবহার করে একটি চিত্র সৃষ্টির। এভাবেই তিন বছরের সাধনার ফল হিসেবে সৃষ্টি হয় ‘জলের নিনাদ’ ছবিটি, যাতে এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, সুগার অ্যাকুয়াটিন্ট, মেজোটিন্ট, লিফটগ্রাউন্ড, এনগ্রেভিং, ডিপ এচ, ড্রাই পয়েন্ট প্রভৃতি মাধ্যমের আশ্রয় নেওয়া হয়।
ছাত্রাবস্থা থেকেই কালো রঙের প্রতি একধরনের দুর্বলতা সৃষ্টি হয় সফিউদ্দীন আহমেদের মনে। কালো তাঁর কাছে বিবেচিত হয় রঙের রাজা হিসেবে। এই রংকে আয়ত্ত করা রীতিমতো দুরূহ মনে হয় তাঁর কাছে। ফলে কালো রঙের অনুশীলনের জন্য ত্রিশ-চল্লিশের দশকেই বহুবার রাতের বেলা গেছেন কলকাতার শিয়ালদা স্টেশনে। উড এনগ্রেভিং মাধ্যমে চিত্র রচনার সময়ে তিনি এই রঙের সমৃদ্ধি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। লন্ডনে গিয়েও তিনি কালোর প্রতি এই আকর্ষণ ও কৌতূহল থেকে দূরে যেতে পারেননি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কালোর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার করেন এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে। এর পরও কালোর এই অনুশীলনে তৃপ্ত হয়নি তাঁর মন। নব্বইয়ের দশকে এসে তিন বছরের অধিককাল তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যাপৃত হন একগুচ্ছ রেখাচিত্র রচনায়, যেসব চিত্রে কালো রঙের বিচিত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শিল্পীজীবনের শেষপ্রান্তে এসে যেন কিছুটা পরিতৃপ্তি লাভ করেন। এসব চিত্রকে তিনি নাম দেন ‘ব্ল্যাক সিরিজ’ বা ‘কালো চিত্রমালা’। এসব চিত্রে কালো রং ব্যবহারে তাঁর এক প্রকার সিদ্ধিকে আমরা দেখতে পাই। আলোর আকাঙ্ক্ষায়ই যেন কালোর এরূপ তপস্যা।
আলোর এই আকাঙ্ক্ষাটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর বহু চিত্রে সূর্যের রূপকল্প ব্যবহারের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানা চিত্রে ব্যবহূত সূর্যের রূপকল্প শিল্পীর অচেতন মনের গভীরে লালিত সুন্দরের প্রত্যাশাটিকেই যেন বাঙ্ময় করে তোলে।
বিষয়-গৌরব কিংবা রূপক-প্রতীকের ব্যঞ্জনা সৃষ্টির মাধ্যমে নিজ শিল্পকর্মকে গভীরভাবে তাৎপর্যময় করে তোলার পাশাপাশি প্রশংসনীয় তাঁর নির্মাণকৌশল ও সৃষ্টিশৈলীর দক্ষতার দিকটি। প্রতিটি শিল্পকর্ম সম্পাদনেই যুক্ত হয়েছে তাঁর দীর্ঘ অভিনিবেশ। মাধ্যমগত আন্তধর্মীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও তিনি সফলতা দেখিয়েছেন। অর্থাৎ এক মাধ্যমের বৈশিষ্ট্যকে অন্য মাধ্যমের চিত্রে প্রয়োগ করেছেন সার্থকভাবে। যেমন—ছাপচিত্র ও তেলচিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলোকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন রেখাচিত্রে। এচিংয়ের সূক্ষ্ম-সরু রেখা, এনগ্রেভিংয়ের বঙ্কিম গতিশীল রেখা, ড্রাই পয়েন্টের কাব্যিক মাধুর্যময় রেখা যেমন রেখাচিত্রে অন্বিষ্ট হয়েছে, তেমনই অ্যাকুয়াটিন্টের মিহি দানাদার বৈশিষ্ট্য, তেলচিত্রের নানা স্তরময় রঙের প্রলেপগত মসৃণতা প্রভৃতি সমৃদ্ধ করেছে তাঁর রেখাচিত্রের জমিন। আবার ছাপচিত্রের বিচিত্রগামী রেখা যেমন তেলচিত্রের জমিনকে বৈচিত্র্যময় করেছে, তেমনই অ্যাকুয়াটিন্টের মিহি-দানাদার বৈশিষ্ট্যও তেলচিত্রের তলকে করেছে আকর্ষণীয়। এনগ্রেভিংয়ের গুণাগুণও তিনি সঞ্চার করার চেষ্টা করেছেন তেলরং মাধ্যমে। অন্যদিকে তেলচিত্রের টেক্সচারসহ অন্যান্য গুণও কখনো কখনো অন্বিষ্ট হয়েছে ছাপচিত্রে কিংবা রেখাচিত্রে।
তবে তাঁর সৃষ্টিকর্মে শৈলীগত ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকলেও তা টেকনিকসর্বস্ব নয়, বিষয়ের বৈচিত্র্যে ও সৃজনশীলতায় তা সমান সমৃদ্ধ। এ কথা ঠিক, কল্পনার ঐশ্বর্য ছাড়া একটি ছবি সার্থক হতে পারে না। তিনি মনে করেন, ছবি হবে সুন্দর এবং একই সঙ্গে শৈলীগতভাবে সমৃদ্ধ।
তাঁর চিত্রবৈশিষ্ট্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাঁর সব ছবির ভেতরেই স্পষ্ট হোক কিংবা অস্পষ্ট হোক, বিষয়বস্তুর উপস্থিতি লক্ষযোগ্য। তাঁর চিত্র-পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে এই বিষয়গত উপাদানের বৈভব। বিষয়ের এই মহিমা সৃষ্টি হয়েছে দেশের উপাদান থেকে। এদিক থেকে তাঁর ছবি বাস্তবধর্মী। বিষয়-আহরণে তিনি দেশের আত্মাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। কলকাতা-পর্বে যেমন অন্বিষ্ট হয়েছে সেই মহানগরের বস্তিজীবনের পারাবত, বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলের নিসর্গ, দুমকার প্রকৃতি ও সাঁওতাল-জীবন, তেমনই ঢাকা-পর্বে বন্যা, জাল, মাছ, নৌকা, ঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি তাঁর চিত্রের উপজীব্য হয়েছে নানা শ্রমজীবী মানুষ। বাংলার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যসহ দেশের শ্রমঘনিষ্ঠ জীবনই যে কেবল তাঁকে আলোড়িত করেছে, তা নয়। এ দেশের সংগ্রামশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনধারাকেও তিনি অবলোকন করেছেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে। এই গৌরবময় সংগ্রামের একদিকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, অন্যদিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বিভিন্ন মাধ্যমে রচিত তাঁর চিত্রমালায় বায়ান্ন ও একাত্তরের স্মরণে সৃষ্টি হয়েছে নানা চোখের ফর্ম, তার অশ্রু ও বিষাদের আখ্যান।
এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় তাঁর দেশাত্মবোধের বিষয়টি। চিত্রে তিনি সব সময়ই দেশের স্বরূপসহ একটি জাতির যন্ত্রণাকে তার আবেগসহ তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাঁর দুমকাবিষয়ক চিত্রমালা কিংবা বন্যা-জল-মাছ-জাল শীর্ষক চিত্রগুচ্ছে গভীর স্বদেশানুরাগসহ আপন মাটির টান অনুভব করা যায়। তবে এই দেশচেতনা তাঁকে স্লোগানমুখরিত করে না, জীবনের মর্মমূলে গভীর বোধের কাছে তা আবেদন সৃষ্টি করে। এর কারণ, বিষয়বৈভবের সঙ্গে সব সময়ই সমৃদ্ধ শৈলীর একটা অসামান্য সমন্বয় ঘটাতে তিনি চেয়েছেন। এই সমন্বয়চেতনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যভাবনারও সম্মিলন ঘটেছে। তিনি মনে করেন, আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। কিন্তু পাশ্চাত্য অনেক উন্নতি লাভ করেছে টেকনিক্যাল দিকগুলোতে। সে কারণে ওদের কলাকৌশলকে তিনি গভীরভাবে আয়ত্ত করেছেন। আবার বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেছেন ভীষণভাবে। এভাবে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়ের ভালো দিকগুলোকে সমন্বিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। বিশ্বশিল্পের সমকালীন আধুনিকতার সব নির্যাসকে আয়ত্ত করে নিজ শিল্পভুবনকে সার্থকতায় করেছেন মণ্ডিত।
==============================
নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান  গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী  ইতিহাস- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি' by দেবেশ রায়  স্মরণ- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের মৃত্যু-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' by বেলাল চৌধুরী  ইতিহাস- 'বাংলায় সিপাহি বিদ্রোহ' by রিদওয়ান আক্রাম  শিল্প-অর্থনীতি 'এখন প্রয়োজন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের' by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্র : চাইলেই ধরা দেয় না' by এমাজউদ্দীন আহমদ  আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী  আলোচনা- 'মানসিক নির্যাতনের প্রতিকার কোথায়' by আশরাফ-উল-আলম  আসুন, ওদের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিইঃ গোলটেবিল বৈঠক।এইচআইভি/এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার  আলোচনা- 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'  আলোচনা- 'নেত্রীর অশ্রুপাত, হরতাল এবং অ্যাকশনে বিএনপি' by সঞ্জীব রায়  আলোচনা- 'আরো আলোকিত হোক জনশক্তি রপ্তানি খাত'  আলোচনা- 'কানকুন সম্মেলনে আমাদের প্রত্যাশা' by শিরীন আখতার  আলোচনা- 'জনসংখ্যার বিপদ ও পরিত্রাণের পথ'  শিল্প-অর্থনীতি 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি:দুর্ভাবনার বিষয়' by ড. আর. এম. দেবনাথ  গল্পসল্প- 'হায়রে নাড়ি ছেঁড়াধন' by শিখা ব্যানার্জী  গল্পসল্প- 'জননী ও জন্মভূমি' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- ''বিভীষণ' বিদায় ও হরতাল সমাচার' by শুভ রহমান 



দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ সৈয়দ আজিজুল হক


এই নিবন্ধ'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.