আলোচনা- 'মানসিক নির্যাতনের প্রতিকার কোথায়' by আশরাফ-উল-আলম

নারীর ওপর শারীরিক নির্যাতন রোধে বিভিন্ন আইন প্রচলিত থাকলেও মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতিকারের পাওয়ার জন্য কোনো আইন এত দিন দেশে ছিল না। সম্প্রতি জাতীয় সংসদ পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করেছে, যাতে মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে এ আইন কার্যকর করার বিধিমালা এখনো প্রণয়ন করা হয়নি। তা ছাড়া এতে আইনি প্রক্রিয়াও বেশ কঠিন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নারীরা কতজন এ আইনে সুবিধা নিতে আসবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
নতুন আইনে মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীকে মামলা দায়েরের জন্য শুধু আদালতে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটা সংশোধন করে নির্যাতনের শিকার নারীকে তাঁর সুবিধামতো থানা বা আদালতে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে আইনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
যৌতুকের জন্য মারধর, শারীরিক নির্যাতন, হত্যা, হত্যাচেষ্টার ঘটনা এ দেশে অহরহ ঘটে থাকে। এ জন্য যৌতুক নিরোধ আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রচলিত রয়েছে। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ, দেনমোহর আদায়, বিবাহবিচ্ছেদ, দাম্পত্য জীবন পুনরুদ্ধারের আইনও প্রচলিত আছে। কিন্তু মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন যে নারী, তাঁর প্রতিকারের জন্য এত দিন দেশে কোনো আইন ছিল না। পাশের দেশ ভারতে পারিবারিক নির্যাতন সুরক্ষা আইন বা পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ আইনের প্রচলন আগে থেকেই রয়েছে। ওই দেশে মানসিক নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। আমাদের দেশে অতি সম্প্রতি জাতীয় সংসদ পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন পাস করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এ দেশে নারীরা পারিবারিক যেসব নির্যাতনের শিকার হন, সেগুলো হচ্ছে_এক. মৌখিক নির্যাতন, যার মধ্যে নারীর প্রতি অবজ্ঞা, অপমান, ভয়ভীতি প্রদর্শন বা এরূপ কোনো কথা বলা, যার দ্বারা পারিবারিক সহিংসতার শিকার ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। দুই. নারীর প্রতি বল প্রয়োগ করা। তিন. নারীকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা। চার. নারীর সম্পদের ক্ষতি করা হয় এবং পাঁচ. নারীস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, যেমন_চলাচল, যোগাযোগ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশের ওপর হস্তক্ষেপ করা।
এ ছাড়া নারীকে অনেক সময় গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যা বিয়ের সময় পাওয়া উপহার, যৌথ মালিকানায় ব্যবহার করার জন্য জোরজবরদস্তি করা হয়, নারীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জোর জবরদস্তিমূলকভাবে যৌথ মালিকানায় ব্যবহারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় এবং যেসব সম্পদ নারীর ব্যবহারের অধিকার রয়েছে, তা থেকে বঞ্চিত করে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এসব মানসিক চাপ থেকে পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় নারীকে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। এই সহিংসতা রোধের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ অনুযায়ী এখন আর কোনো নারীকে তাঁর বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। আদালতে নালিশ জানালে মানসিক নির্যাতনকারীকে আদালতে তলব করে নির্যাতিতাকে সুরক্ষা দেওয়ার আদেশ দেবেন আদালত। ওই আদেশ না মানলে ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। তবে একজন নির্যাতিতাকে নালিশ জানাতে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হতে হবে। আমাদের দেশের আদালতব্যবস্থা এখনো নারীবান্ধব না হওয়ায় সেখানে নালিশ জানাতে যাওয়া নারীর সংখ্যা খুব বেশি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন না।
ভারতে নারী তাঁর অধিকার আদায়ে থানায় অভিযোগ জানাতে পারেন। বাংলাদেশে সরাসরি আদালতে নালিশ জানানোর বিধান করা হয়েছে, যা ব্যয়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মত।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভানেত্রী অ্যাডভোকেট ফওজিয়া করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত মহিলারা নালিশ জানাতে আদালতের মুখোমুখি হতে চান না। নতুন আইনে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশ জানাতে হবে এই বিধান রাখা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে নালিশ জানানোর বিধান রাখলে ভালো হতো। তিনি আরো বলেন, এ আইন বাস্তবায়ন করতে হলে বিধিমালা তৈরি করতে হবে। সেটা দ্রুত করা উচিত। পারিবারিক সুরক্ষা কর্মকর্তাও নিয়োগ দিতে হবে।
২০০৫ সালে ভারতে পারিবারিক নির্যাতন সুরক্ষা আইন প্রণীত হয়। ভারতের এই আইনে কোনো নারী একটি মাত্র অভিযোগপত্রের মাধ্যমে তাঁর খোরপোশের অর্থ, সন্তানের হেফাজত, অত্যাচার নিবারণ, সম্পত্তি নষ্ট হওয়ার জন্য ক্ষতিপূরণ, উচ্ছেদ প্রতিরোধের প্রতিকার পেয়ে থাকে। আগে এগুলোর জন্য পৃথক মামলা করতে হতো। আমাদের দেশের এ-সংক্রান্ত আইনে নারীর দেনমোহর, খোরপোশ, সন্তানের হেফাজত পেতে আলাদা মামলা করতে হবে। অর্থাৎ ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য একজন নারীকে বারবার আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। এতে নারীর প্রতি আইনেই বৈষম্য রয়ে যাবে বলে আইনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
প্রচলিত আইনেও বৈষম্য
আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে নারীর প্রতি বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০ (সংশোধিত-২০০৩)-এর ২৩ ধারায় নির্যাতিত নারীকে চিকিৎসক কর্তৃক পরীক্ষা করানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু নির্যাতিত নারীকে একজন মহিলা চিকিৎসক পরীক্ষা করবেন_এ ধরনের কিছু উল্লেখ নেই। এ কারণে নির্যাতিত নারীকে পুরুষ চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে থাকেন। ফলে অনেক নির্যাতিতা চিকিৎসক দ্বারা শারীরিক পরীক্ষা করাতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি পরীক্ষা করাতে গিয়ে পুরুষ চিকিৎসকের দ্বারা নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। ঢাকার দক্ষিণ খান থানার এক কিশোরী গত সেপ্টেম্বরে অপহৃত হয়। অপহরণকারীরা তাকে চাঁদপুরে নিয়ে আটকে রাখে। পরে র‌্যাবের সহযোগিতায় মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। দক্ষিণ খান থানায় এ বিষয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলাও হয় (মামলা নম্বর ২)। মামলায় কিশোরীর ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য আদালত নির্দেশ দেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিশোরীকে নেওয়ার পর এক পুরুষ চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা করার প্রস্তুতি নিলে কিশোরীটি পুরুষ চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করাতে অস্বীকৃতি জানায়। তার আর শারীরিক পরীক্ষা করা হয়নি। এ কারণে অপহরণকারীরা মামলা থেকে খালাস পেয়ে যেতে পারে বলেও আইনজীবীরা জানান। এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে বলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। অথচ আইনে যদি মহিলা চিকিৎসক মহিলাদের শারীরিক পরীক্ষা করবেন বলে উল্লেখ থাকত তাহলে পুরুষ চিকিসকদের কাছে যেতে হতো না। এ ক্ষেত্রে নারী মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। নতুন আইনেও এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই।
অ্যাডভোকেট ফওজিয়া করিম এ প্রসঙ্গে বলেন, কেউ পুরুষ ডাক্তার দ্বারা শারীরিক পরীক্ষা করাতে না চাইলে অবশ্যই নারী ডাক্তার দিয়ে তাঁর পরীক্ষা করানো উচিত। মহিলা ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করাতে হবে বলে আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলে যেখানে মহিলা ডাক্তার নেই সেখানে কী হবে? তবে আইনে উল্লেখ থাকলে অবশ্যই ভালো হতো। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে প্রত্যেক হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসকের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশে দেওয়ানি আইন সংশোধন করে ভাই-বোনের সম্পত্তির সমান বণ্টনের ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি। বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত নারী সম্মেলনসহ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে এ বিষয়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো অঙ্গীকার করে এলেও দেওয়ানি আইন সংশোধন করা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাতিলকৃত বিধান আবার বলবৎ করার কথা সরকার বারবার উচ্চারণ করলেও এখনো তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। নারী পাচার রোধে পৃথক কোনো আইন নেই। ফতোয়ার নামে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত আইন প্রণয়ন করে বিচারবহির্ভূত শাস্তি বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
=========================
আসুন, ওদের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিইঃ গোলটেবিল বৈঠক।এইচআইভি/এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার  আলোচনা- 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'  আলোচনা- 'নেত্রীর অশ্রুপাত, হরতাল এবং অ্যাকশনে বিএনপি' by সঞ্জীব রায়  আলোচনা- 'আরো আলোকিত হোক জনশক্তি রপ্তানি খাত'  আলোচনা- 'কানকুন সম্মেলনে আমাদের প্রত্যাশা' by শিরীন আখতার  আলোচনা- 'জনসংখ্যার বিপদ ও পরিত্রাণের পথ'  শিল্প-অর্থনীতি 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি:দুর্ভাবনার বিষয়' by ড. আর. এম. দেবনাথ  গল্পসল্প- 'হায়রে নাড়ি ছেঁড়াধন' by শিখা ব্যানার্জী  গল্পসল্প- 'জননী ও জন্মভূমি' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- ''বিভীষণ' বিদায় ও হরতাল সমাচার' by শুভ রহমান  খবর- হরতালের বিরুদ্ধে একজোট, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা  আলোচনা- 'হজ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে কিছু কথা' by এয়ার কমোডর (অব.) মুহম্মদ জাকীউল ইসলাম  শিল্প-অর্থনীতি 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেতন-কাঠামো' by খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ  স্মরণ- 'মীর শওকত আলী বীর উত্তম : একজন বীরের প্রতিকৃতি' by ড. আশকার ইবনে শাইখ  আন্তর্জাতিক- 'মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ' by আহসান হাবীব  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিচিত্র সংকটের আবর্তে একটি বাড়ি' by এবিএম মূসা  ইতিহাস- 'হাজংমাতা শহীদ রাশিমনির স্মৃতিসৌধে' by দীপংকর চন্দ


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আশরাফ-উল-আলম


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.