নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান

যত বৈশ্বিক হোক, শিল্পকলার ভাষা_সব শিল্পের আলাদা মা-মাটির পরিচয় নিশ্চয়ই থাকে। শিল্প রচিত হয় যে প্রকৃতির সাহচর্যে, মাটি তার জন্মদাত্রী। বাংলার মাটি এক নন্দী নিসর্গগর্ভা। অপরূপ সে নিসর্গে অনাবিল প্রাণের স্পন্দন। বাংলার নদীজল, আকাশ, ফুল, পাখি, তরুলতা, বৃক্ষ_সব মায়াবী প্রাণ একেকটি। নন্দনবৈচিত্র্য তাদের অভিব্যক্তিতে। শিল্প শিক্ষার্থীদের নবিশি পর্বে এসব প্রাণস্পন্দনকে ধারণ করতে হয়। দীক্ষা নিতে হয় প্রকৃতি-গুরুর কাছে।
শিল্পচর্চার এ ধারায় যেন ভাটা পড়ছে। ঔপনিবেশিক স্তর পেরিয়ে শিল্পবোধ ঢুকে পড়ছে করপোরেট ভাবনার পেটের মধ্যে। অনেক নবীন শিল্পী সে প্রবণতা থেকে বেরোনোর আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল। দেশ-কাল সমাজ ভৌগোলিক পরিপ্রেক্ষিতে হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছিল যে শিল্পধারা, অনার্য আদিভূমিতে অন্বেষ চলছে সেই প্রত্নসম্পদ। ফারহানা ফেরদৌসী তাদের সহচরী বলে মনে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে সম্প্রতি শেষ হয়েছে তাঁর প্রদর্শনী।
শিল্পীর প্রদর্শিত শিল্পকর্ম দেখে মনে হয় তিনি অধ্যবসায়ী শ্রমনিষ্ঠ। লোক-কারুশিল্পের প্রতি দরদি। চারুকলায় ভর্তির আগেই তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন হাতুড়ি-বাটালির মতো সুতারাস্ত্র। ব্যাকরণকে তিনি যেমন মেনে চলেন সতর্কতার সঙ্গে, তেমনি ব্যাকরণ ভাঙার প্রবণতাও লক্ষণীয় কোনো কোনো কাজে।
শিল্পীর কাজের অনুষঙ্গ ফুল, পাখি, গৃহপালিত জন্তু এবং এর সঙ্গে মানুষের মানবিক সম্পর্ক। কখনো তার কাজে পৌরাণিক চরিত্র এসেছে নারী-পুরুষের চিরায়ত সম্পর্কের আবেদন নিয়ে। নারীত্বের স্বাভাবিকতায় তাঁর চোখ এড়ায়নি, নারীর সঙ্গে তাঁর পারিপাশ্বর্িক বাস্তবতার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে অস্তিত্বের সংগ্রাম। এসব অভিব্যক্তি প্রকাশে তিনি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন ট্যাপেস্ট্রি, উডওয়ার্ক, অ্যাপলিক, মেটাল ওয়ার্ক, সিল্ক স্ক্রিন প্রিন্ট ও বাটিক।
ট্যাপেস্ট্রিতে বাংলাদেশে অনবদ্য কাজ করেছেন রশিদ চৌধুরী। সম্প্রতি কেউ কেউ এ মাধ্যম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। ফারহানাও এ কাজে অংশ নিয়েছেন। ট্যাপেস্ট্রি বা বোনাই শিল্পে তাঁর চমৎকার সৌন্দর্য ও চিত্র-ছন্দময়তা দেখা গেছে। এখানে তিনি ছবির ধর্মেই রঙের বিন্যাস ও টানাপড়েন এনেছেন। 'টু ফিশ' কিংবা 'বার্ডস অ্যান্ড লিলি'-তে তিনি যে রং ব্যবহার করেছেন তা যেন কিছুটা নির্জীব মনে হয়। সেই তুলনায় 'ফেস' সিরিজে ব্যবহার করেছেন উজ্জ্বল রং। উজ্জ্বল রঙেরও হয়তো আলাদা একটা অর্থ আছে।
ফারহানা এখনো তরুণ। এখনো তাঁর ঢের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি। ক্রমাগত নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি যে নিজেকে শুদ্ধতমদের কাতারে আনতে চান, তা বেশ লক্ষণীয়। স্ক্রিন প্রিন্ট মাধ্যমে যে কাজগুলো তিনি প্রথম বছর করেছেন এবং সেখানে স্পেসকে ব্যবহার ও আঙ্গিক বিন্যাসে নান্দনিকতার যে ঘাটতি ছিল, পরের বছর একই সিরিজের পাঁচ নম্বর কাজটিতে সেই ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার প্রবণতা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
শিল্পীর উডওয়ার্ক মাধ্যমে নৈসর্গিক বোধের পরিচয় মেলে। তিনি হয়তো ফুলের অপার সৌন্দর্যকে ধরতে চাননি, বরং ফুলের যূথবদ্ধ অবস্থানকে তুলতে চেয়েছেন। কিংবা ফুলকে কেন্দ্র করে তৈরি করতে চেয়েছেন কোনো শান্ত রসের বেষ্টনী।
মানুষের অন্তর্রাজ্যে যত কাহিনী, সব কোথায় লিপিবদ্ধ হয়? নিশ্চয়ই মুখাবয়বে। অভিব্যক্তিবাদী স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ পটপট করে তা পড়ে ফেলে। অভিনয়ের মাধ্যমে মুখাবয়ব লুকানোর প্রবণতা তাই নিত্য লক্ষণীয়। অভিনয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা মুখোশের। ফারহানার মেটাল ওয়ার্ক মাধ্যমে তৈরি মুখোশ অশুভ ইঙ্গিতবাহী। এই ইঙ্গিতের পেছনে তাঁর কোনো মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে? এটি স্পষ্ট করতে তিনি ব্যবহার করেছেন একটি পৌরাণিক চরিত্রকে। গাজী কালু চম্পাবতীর কাহিনী এ দেশের ঘরে ঘরে পরিচিত। এই গাজীকে তিনি ব্যবহার করেছেন উদ্ধারকর্তা হিসেবে। গাজী পীরের বীরত্বপূর্ণ অলৌকিক কর্মকাণ্ড চিত্রিত হয়েছে। মাছ আর হাতির মিশেলে অদ্ভুত বাহনে সওয়ার হয়ে লড়াই করতে চলেছেন। হাতে উদ্ধত তলোয়ার। মাথায় রাজমুকুট।
ফারহানার শিল্পে মিথের ব্যবহার দেখা যায় বাটিক মাধ্যমেও। এখানে রাধাকৃষ্ণ ছাড়াও স্থান পেয়েছে বাংলার সেই চিরায়ত লোকজ উপকরণ। পাখি, কুলা, নকশি পাখা, হাতি, পালকি, মহেশের মস্তক_এসব। ফারহানার অ্যাপলিক মাধ্যমের কাজগুলোকে উল্লেখযোগ্য কাজ বলে মনে হয়েছে। ছেঁড়াফাড়া বর্ণিল কাপড় এ ক্ষেত্রে প্রধান উপকরণ। নীলের নীলিমায় মাছের পাখি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আকাশ আর জল নীলের বন্যায় একাকার। এই নীল বিরহে কাঁদায় না। এই নীল প্রেমে অভিষিক্ত করে। এ নীল শিল্পীর একান্তই নিজস্ব রং। শিল্পীর আত্মার আকুতি। চূড়ান্ত অভিনিবেশ। স্পেসকে ব্যবহার এবং পরিমিতিবোধের চমৎকার নিদর্শন। রঙিন মাছের এই ওড়াউড়ি দেখেই কাছেপিঠে ডেকে ওঠে বর্ণিল বনমোরগ। শিল্পীর এ কাজে ব্যবহৃত উজ্জ্বল রং ঘরের পরিবেশ ঝলমলে করে তুলবে। অ্যাপলিক মাধ্যমে তাঁর সব কাজের মধ্যেই সেই উপাদান রয়েছে। শিল্পী ফারহানা ফেরদৌসীর প্রদর্শনী প্রকৃতই তাঁর গূঢ় সংবেদের উপস্থাপন। বাংলার নিসর্গ, বাংলার আদি লোকজ উপাদান তাঁর শিল্পের প্রধান উপজীব্য। মানুষের দ্বারা মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্ট শিল্পকলা সমাজেরই অংশ_এই শিল্প দর্শনে তাঁর শিল্পচর্চা এগিয়ে যাবে আরো সামনে।
====================
গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী  ইতিহাস- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি' by দেবেশ রায়  স্মরণ- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের মৃত্যু-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' by বেলাল চৌধুরী  ইতিহাস- 'বাংলায় সিপাহি বিদ্রোহ' by রিদওয়ান আক্রাম  শিল্প-অর্থনীতি 'এখন প্রয়োজন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের' by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্র : চাইলেই ধরা দেয় না' by এমাজউদ্দীন আহমদ  আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী  আলোচনা- 'মানসিক নির্যাতনের প্রতিকার কোথায়' by আশরাফ-উল-আলম  আসুন, ওদের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিইঃ গোলটেবিল বৈঠক।এইচআইভি/এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার  আলোচনা- 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'  আলোচনা- 'নেত্রীর অশ্রুপাত, হরতাল এবং অ্যাকশনে বিএনপি' by সঞ্জীব রায়  আলোচনা- 'আরো আলোকিত হোক জনশক্তি রপ্তানি খাত'  আলোচনা- 'কানকুন সম্মেলনে আমাদের প্রত্যাশা' by শিরীন আখতার  আলোচনা- 'জনসংখ্যার বিপদ ও পরিত্রাণের পথ'  শিল্প-অর্থনীতি 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি:দুর্ভাবনার বিষয়' by ড. আর. এম. দেবনাথ  গল্পসল্প- 'হায়রে নাড়ি ছেঁড়াধন' by শিখা ব্যানার্জী  গল্পসল্প- 'জননী ও জন্মভূমি' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- ''বিভীষণ' বিদায় ও হরতাল সমাচার' by শুভ রহমান 



দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ খান মিজান


এই নিবন্ধ'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.