আন্তর্জাতিক- 'চেচনিয়ার ‘যুদ্ধবাজ ইমাম’ by মিজান মল্লিক

চেচেন রাজধানী গ্রোজনির ঝলমলে দোকানে ভরা নতুন সরণি ‘পুতিন প্রসপেক্ট’ দিয়ে ধীরগতিতে চলছিল কালো লাদা গাড়িটি। পেছনের জানালা দিয়ে বেরিয়ে ছিল একটি বন্দুকের নল। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুই নারীকে লক্ষ্য করে গুলি করল গাড়ির বন্দুকধারী। দুই নারী আর্তনাদ করে উঠলেন। তাঁদের গায়ের কাপড় লাল রঙে ভরে গেল। কিন্তু কেউই পড়ে গেলেন না। ব্যাপার হলো, তাঁদের গুলি করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বুলেটের জায়গায় ছিল রঙের গোলা। (ছবিঃ নিজের প্রাসাদে রমজান কাদিরভ)
পথচারী ওই দুই নারীর ‘অপরাধ’ তাঁরা পায়ের পাতা পর্যন্ত লম্বা স্কার্ট পরলেও মাথায় স্কার্ফ পরেননি। চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ গত বছর কট্টর তালেবানি কায়দার নৈতিকতা পুলিশ গঠন করেছেন। এ ছাড়া চেচেন মিলিশিয়ারা কালো পোশাক পরে, কালো গাড়িতে টহল দেয়। চেচনিয়ার নারীরা চুল খোলা রাখেন কি না, ছোট টি-শার্ট গায়ে দেন কি না, কিংবা জনসমক্ষে প্রণয় করেন কি না, এসব বিষয় দেখাশোনা করে তারা। নারীরা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকবার রঙের গোলায় আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ করলেও প্রেসিডেন্ট তা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, তাঁর রাজনীতিকে কালিমালিপ্ত করতেই কেউ কেউ এ ধরনের কুৎসা রটায়।
কাদিরভ অবশ্য নিজেই সম্প্রতি নিউজউইক পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমার স্বপ্ন ইসলামি আইন অনুযায়ী সব নারী স্কার্ফ পরবে।’ কিন্তু তাঁর ইসলাম তালেবানদের চর্চা করা কট্টর ওয়াহাবি ইসলাম নয়। তিনি সুফিবাদের মরমি ইসলামের অনুসারী। চেচনিয়ার ঐতিহ্য সেটাই। কাদিরভের মধ্য দিয়ে রাশিয়া চেচনিয়ার উগ্র ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে উদারপন্থী ইসলামচর্চায় নানাভাবে উৎসাহ দিচ্ছে মস্কো। কিন্তু রাশিয়ার এ চেষ্টা কাজে আসছে, না কি তা বরং উগ্রপন্থাকেই উসকে দিচ্ছে সে প্রশ্ন উঠেছে।
চিরদিনের বিদ্রোহী উত্তর ককেসাসকে এবার স্থায়ীভাবে ‘সোজা করতে’ মস্কো বেছে নিয়েছে রমজান কাদিরভকে। তাঁর গা-জোয়ারি কৌশল চেচনিয়ায় আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হলেও সাফল্য এনেছে।
এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ায় বসবাসকারী প্রায় দুই কোটি মুসলমানকে উগ্রবাদ থেকে দূরে রাখতে নতুন কৌশল হাতে নিয়েছে ক্রেমলিন। প্রকৃত ইসলাম শিক্ষা দিতে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে রাশিয়ায় সাতটি নতুন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা এবং শত শত শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়ে সিরিয়া ও সৌদি আরবের বিভিন্ন অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ স্বীকৃত ইমামদের ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ককেশীয় সমাজে ইমামদের একটি ‘বিশেষ স্থান’ রয়েছে। ‘আধ্যাত্মিকতা ও উচ্চমানের নৈতিকতা’ দিয়ে চেচেন বিদ্রোহীদের দমনে ক্রেমলিনকে সহায়তা করার জন্য ইমামদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
রমজান কাদিরভের বাবা আহমেদ কাদিরভ ১৯৯০-এর দশকে চেচনিয়ার রুশ-নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টার সময় ছিলেন ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্রটির প্রধান মুফতি। পরে ক্রেমলিনের সঙ্গে সমঝোতা হয় আহমেদ কাদিরভের। কিন্তু ২০০৪ সালে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন তিনি। নিজেকে বাবার আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী মনে করেন রমজান কাদিরভ। মনে করা হচ্ছিল রমজানই চেচনিয়ায় শান্তি আনতে ক্রেমলিনের আসল লোক হবেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই তালেবান বা চেচেন জঙ্গিদের ওয়াহাবিবাদ থেকে রমজানের আদর্শকে আলাদা করা কঠিন। যেমন চেচেন নারীদের বোরকা পরার ব্যাপারে তিনিও কড়াকড়ি আরোপ করেন। মদ বিক্রিতে জারি করেন বিধিনিষেধ। মানবাধিকারকর্মীদের অভিযোগ, কাদিরভের নৈতিকতা পুলিশ চেচনিয়ার সন্দেহভাজন যৌনকর্মীদের মাথা মুড়িয়ে ও ভ্রু কামিয়ে ন্যাড়া মাথায় ইসলামি সবুজ রং মাখিয়ে দেয়।
নিজ বাসভবনে কাদিরভ ব্যতিক্রমধর্মী সুফি আর পুরোনো ধাঁচের বিলাসী যুদ্ধবাজের এক বিচিত্র সংমিশ্রণ। মাঝেমধ্যে তিনি তাঁর বিশাল প্রাসাদে অনুসারীদের ডেকে পাঠান। সেখানে হাজারো ভক্ত একনাগাড়ে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা নেচে নেচে জিকির করেন।
কাদিরভ বলেন, তাঁর অনুসৃত ইসলামই জঙ্গিবাদী আদর্শ থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারবে। তাঁর কথা: ‘অন্যসব তরিকার মতো ওয়াহাবিবাদ আমাদের দেশের জন্য নতুন আবিষ্কার। এটা আমাদের ঐতিহ্যে ছিল না এবং আমরা তা কখনোই গ্রহণ করব না।’
এদিকে রাশিয়া একই সঙ্গে চেচনিয়ার ব্যাপারে তার পুরোনো নির্মম দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে যা তার সমান্তরাল শান্তিমুখী তৎপরতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রুশ সরকার স্থানীয় মুসলিমদের কট্টর পন্থা থেকে বিরত রাখতে সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই কাতার ও মিসরের মতো দেশ থেকে শরিয়া আইন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের নিপীড়ন থেকে যে ক্ষোভ ও ঘৃণার পাহাড় জমেছে তা রাতারাতি দূর হওয়ার নয়। অন্যদিকে মস্কোভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন মেমোরিয়ালের পরিচালক ওলেগ অরলভ অভিযোগ করেছেন, উত্তর ককেসাসে সরকারও ধরপাকড় আর বন্দী অবস্থায় নির্যাতন সমানে চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, হতে পারে কাদিরভের সুফিবাদী ইসলামচর্চা, বিচারবহির্ভূত গুম, খুন ও নির্যাতন ককেসাসের বিদ্রোহীদের সাময়িকভাবে দুর্বল করবে। কিন্তু ওই সব তৎপরতা রুশ মুসলিমদের জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিলে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি সুদূরপরাহত হয়েই থাকবে। কাদিরভ খুব আশাবাদী। তাঁর কথা: ‘পুতিন আমাকে যত দিন সহায়তা দেবেন, তত দিন আমি সবকিছু করতে সক্ষম। আল্লাহু আকবর!’
========================
আন্তর্জাতিক- আমি স্বাধীনতা চাই না: রমজান কাদিরভ  সাহিত্যালোচনা- 'মৃত্যুশতবার্ষিকীর তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  গল্পসল্প- 'দুঃখটাকে ভাগাভাগি করি' by মুহম্মদ জাফর ইকবাল  গল্প- 'দাদার দোকানে শূন্য দশক' by সালাহউদ্দিন  শিল্পি- 'সফিউদ্দিন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র-অশেষ আলোর আলোর আধার' by সৈয়দ আজিজুল হক  নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান  গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী  ইতিহাস- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি' by দেবেশ রায়  স্মরণ- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের মৃত্যু-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' by বেলাল চৌধুরী  ইতিহাস- 'বাংলায় সিপাহি বিদ্রোহ' by রিদওয়ান আক্রাম  শিল্প-অর্থনীতি 'এখন প্রয়োজন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের' by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্র : চাইলেই ধরা দেয় না' by এমাজউদ্দীন আহমদ  আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী  আলোচনা- 'মানসিক নির্যাতনের প্রতিকার কোথায়' by আশরাফ-উল-আলম  আসুন, ওদের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিইঃ গোলটেবিল বৈঠক।এইচআইভি/এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার  আলোচনা- 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'  আলোচনা- 'নেত্রীর অশ্রুপাত, হরতাল এবং অ্যাকশনে বিএনপি' by সঞ্জীব রায়  আলোচনা- 'আরো আলোকিত হোক জনশক্তি রপ্তানি খাত'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লিখেছেনঃ মিজান মল্লিক


এই লিখা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.