আসুন, ওদের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিইঃ গোলটেবিল বৈঠক। এইচআইভি ও এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার

এইচআইভি/এইডস ঝুঁকিপূর্ণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি তাদের সার্বিক মানবাধিকার নিশ্চিত করাও জরুরি। তাদের দূরে ঠেলে দিয়ে বা বঞ্চিত রেখে নয়; বরং মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে কাছে টেনে নিয়েই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়াতে হবে। গতকাল বুধবার রাজধানীতে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ইউনেস্কোর সহযোগিতায় দৈনিক কালের কণ্ঠ, বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ও হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট জার্নালিস্ট ফোরাম_বাংলাদেশ (এইচইজেএফবি) যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে।
কালের কণ্ঠের সভাকক্ষে 'এইচআইভি/এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার' শীর্ষক বৈঠকে এইচআইভি/এইডস ঝুঁকিপূর্ণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ করে হিজড়া (ট্রান্স জেন্ডার) ও পুরুষ সমকামীদের (এমএসএম) মানবাধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
আলোচকরা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত না হওয়ায় দেশে এইডসের ঝুঁকিও বাড়ছে। অবশ্য পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সুন্দর আগামীর লক্ষ্যে আরো পরিবর্তন প্রয়োজন। এ জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
বৈঠকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিসহ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি, দেশীয় এনজিও প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক, সাংবাদিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন।
বৈঠকের সূত্রপাত করে দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক আবেদ খান বলেন, 'আমাদের মূল্যবোধ ও মমতা দিয়ে এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদেরকে এখনো আমরা সবাই সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখি না। এটা খুবই মর্মান্তিক।'
তিনি বলেন, এইচআইভি/এইডস
নিয়ে কাজ হয়েছে অনেক। বিশ্বের অনেক দেশ ও মানুষ এ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবায় যে অর্থ দান করছে তা কতটা কাজে আসছে সেটাও মূল্যায়ন করতে হবে। এগুলো কতটা সমন্বিত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় হচ্ছে তা-ও দেখা উচিত।
আবেদ খান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মানবাধিকারের আলোকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সর্বস্তরের আরো জাগরণ তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কালের কণ্ঠ সেই দায়বোধ থেকেই কাজ শুরু করেছে।
অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. হাসান মাহমুদ।
অনুষ্ঠানের আলোচনায় আইসিডিডিআরবির গবেষক ড. তাসনিম আজিম বলেন, মাঠপর্যায়ে এক জরিপ চালিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে মোট এক লাখ ৪৩ হাজার পুরুষ সমকামী ও ৯ হাজার হিজড়ার খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে এই জরিপ পরিচালনায় নানান প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ঘরে ঘরে গিয়ে এটা করা যায় না। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এলাকা খুঁজে বের করে এটা করা হয়। তাই এই হিসাবের বাইরে আরো এমএসএম থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির ভারপ্রাপ্ত লাইন ডাইরেক্টর ডা. মো. আব্দুল ওয়াহিদ বলেন, মাত্র ৩০-৪০ কোটি টাকা ব্যয় করলেই দেশের প্রায় দেড় লাখ পুরুষ সমকামী ও ৯ হাজার হিজড়ার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খুব একটা দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে না।
ইউএনএইডস-বাংলাদেশের সামাজিক আন্দোলন বিভাগের উপদেষ্টা ড. মনির আহম্মেদ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেবা ও মানবাধিকারের সমন্বিত কার্যক্রম। কিন্তু বাংলাদেশে পুরুষ সমকামীদের চলমান কর্মসূচি বন্ধে নানান তৎপরতা হয়। এমনকি সংসদেও এর বিরুদ্ধে কথা বলা হয়।
ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের জাতীয় কর্মসূচি কর্মকর্তা ড. এজাজুল হক বলেন, শুধু সামাজিক সচেতনতা বাড়ালেই চলবে না, যাদের জন্য এই কার্যক্রম তাদেরকেও নিজেদের অধিকারের বিষয়ে আরো এগিয়ে আসতে হবে। এখানে সে বিষয়টির ঘাটতি দেখা যায়।
বাঁধন হিজড়া সংঘের নির্বাহী পরিচালক পিংকি সিকদার বলেন, 'আমাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। আমরা শুধু মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি চাই। হিজড়াদের কেউ চাকরি দিতে চায় না, বাসা ভাড়া দিতে চায় না। আমাদের সম্পর্কে সামাজিকভাবে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আমরা আর বঞ্চিত থাকতে চাই না।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবিব বলেন, 'বিশ্বের ৮৬টি দেশে এখনো পুরুষ সমকামীদের অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরাও আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এদেরকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দেখতে পারছি না। এদেরকে আড়ালে না রেখে চিকিৎসাসেবাসহ সব ক্ষেত্রেই মূলধারায় নিয়ে আসা উচিত।'
সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার বলেন, 'প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে কাজ করার জন্য সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে অনেক কিছু করার আছে। আমরা কেউ কেউ তা করছি, তবে সবারই এ কাজে যুক্ত হওয়া দরকার।'
এটিএন বাংলার অতিরিক্ত প্রধান প্রতিবেদক শাহনাজ মুন্নী বলেন, পুরুষ সমকামী বা হিজড়াদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে মিডিয়া অনেকটা পিছিয়ে আছে। আবার যারা এসব নিয়ে কাজ করছেন তাঁরাও মিডিয়াকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করেন না। অবস্থাটা এমন যে, কেবল এইচআইভি/এইডস প্রসঙ্গ এলেই হিজড়া ও সমকামীদের কথা আলোচিত হয়। এটা না করে তাদেরকে মানুষ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েই তাদের মর্যাদা দিতে হবে।'
সমকামী ও হিজড়াদেরকে বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত অধিকারের আলোকেই মূল্যায়ন করা উচিত মন্তব্য করে এসটিআই/এইডস নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মাকসুদ বলেন, অন্য সবার মতোই সমকামী ও হিজড়াদেরকে ঘৃণামুক্ত ও বৈষম্যহীন পরিবেশে সব চিকিৎসাকেন্দ্রে সেবা দেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রাইটস) মহুয়া লিয়া ফালিয়া বলেন, 'সামাজিক ও শারীরিকভাবে একজন মানুষ যা-ই হোক না কেন, তাকে মানুষ হিসেবেই সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। সংবিধানে এ স্বীকৃতি দিলেও বাস্তবে সেটা দেখতে পাই না।'
বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির অনন্যা হিজড়া নিজের ঘুরে দাঁড়ানোর কথা তুলে ধরে বলেন, 'সবার সহযোগিতা পেয়ে আমি আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। তবে সবাই তো আমার মতো সুযোগ পাচ্ছে না। আমাদের যেভাবে প্রতিবন্ধী ভাবা হয়, সেটা আমাদের জন্য কষ্টকর। আমরা চাই আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশ, রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অবদান রাখতে।'
ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার ড. নাদিয়া ফারহিন রহমান এইচআইভি/এইডস টেস্ট ঠিকভাবে হচ্ছে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, চার হাজার ৮৫০ জনকে নিয়ে কাজ করে মাত্র এক হাজার ৯৮৯ জনের টেস্ট করা গেছে। এর মধ্যে আটজন এইডস আক্রান্ত পাওয়া গেছে। যার শতকরা হার মাত্র ০ দশমিক ৪৮ ভাগ। যেটা প্রায় দেড় লাখ পুরুষ সমকামীর মাত্র শতকরা ৩ ভাগ। আর টেস্টে এখন নেগেটিভ হলেও পরে যে পজেটিভ হবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম হিরু বলেন, 'এইডস আক্রান্ত মানুষ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমরা চাই, ভালোবাসা দিয়ে সবাই যেন তাদের কাছে টেনে নেই। স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ক্ষেত্রেই তারা যেন অন্য মানুষের মতোই সুবিধা পায়।'
দৈনিক কালের কণ্ঠের প্লানিং এডিটর ও এইচইজেএফবির সভাপতি মুস্তাফিজ শফি বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। আশা করা যায়, সুন্দর আগামী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।' এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এখনো সেটাকে কাজে লাগাতে পারছে না। তিনি গণমাধ্যমের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে কর্মকৌশল নির্ধারণের প্রস্তাব করেন।
এ ছাড়া বৈঠকে বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহম্মেদ, ওডিপিইউপির নির্বাহী পরিচালক বায়েজিদ আহমেদ, হাসাবের সেলিনা বেগমসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা আলোচনা করেন।
==========================
আলোচনা- 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'  আলোচনা- 'নেত্রীর অশ্রুপাত, হরতাল এবং অ্যাকশনে বিএনপি' by সঞ্জীব রায়  আলোচনা- 'আরো আলোকিত হোক জনশক্তি রপ্তানি খাত'  আলোচনা- 'কানকুন সম্মেলনে আমাদের প্রত্যাশা' by শিরীন আখতার  আলোচনা- 'জনসংখ্যার বিপদ ও পরিত্রাণের পথ'  শিল্প-অর্থনীতি 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি:দুর্ভাবনার বিষয়' by ড. আর. এম. দেবনাথ  গল্পসল্প- 'হায়রে নাড়ি ছেঁড়াধন' by শিখা ব্যানার্জী  গল্পসল্প- 'জননী ও জন্মভূমি' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- ''বিভীষণ' বিদায় ও হরতাল সমাচার' by শুভ রহমান  খবর- হরতালের বিরুদ্ধে একজোট, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা  আলোচনা- 'হজ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে কিছু কথা' by এয়ার কমোডর (অব.) মুহম্মদ জাকীউল ইসলাম  শিল্প-অর্থনীতি 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেতন-কাঠামো' by খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ  স্মরণ- 'মীর শওকত আলী বীর উত্তম : একজন বীরের প্রতিকৃতি' by ড. আশকার ইবনে শাইখ  আন্তর্জাতিক- 'মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ' by আহসান হাবীব  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিচিত্র সংকটের আবর্তে একটি বাড়ি' by এবিএম মূসা  ইতিহাস- 'হাজংমাতা শহীদ রাশিমনির স্মৃতিসৌধে' by দীপংকর চন্দ  গল্প- 'ঈর্ষার রং ও রূপ' by আতাউর রহমান  ডিজিটাল-প্রযুক্তি কি মানবতাবিরোধী প্রবণতা তৈরি করে? by মোহীত উল আলম  খবর- এক দশক পর ছেলের সঙ্গে দেখা হলো সু চির  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'ট্রানজিটঃ অর্থের বাইরে বাইরে প্রাপ্তিযোগও ভাবতে হবে' by কে এ এস মুরশিদ  খবর- আমনের বাম্পার ফলনেও বাড়ছে চালের দাম by ইফতেখার মাহমুদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি' by ফজলুল বারী

দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.